শুক্রবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

শরম (ষষ্ঠ পর্ব)

তসলিমা নাসরিন

শরম (ষষ্ঠ পর্ব)

ঘরের অন্যদিকে একটি টেবিল, ওতে টেলিভিশন। বাটিকের লাল হলুদ একটি কাপড় দিয়ে ঢাকা দেওয়া। আরেক ঘরে একটা ছোট খাট। একটা টেবিল, কয়েকটা চেয়ার। কাঠের একটা আলমারি। কাঠের তাকে কিছু বই। একটা হেলমেট। কোনও খাবার ঘর, খাবার টেবিল এসব নেই। অনুমান করি, এরা বিছানায় বসেই খায়, কারণ চা টা এনে বিছানার ওপরই একটা খবরের কাগজ পেতে রাখলো। ঢাকায় সুধাময়ের বাড়িটি এর চেয়ে অনেক ভালো ছিল, জীবন যাপনের মান ছিল অনেক উন্নত। নিঃসন্দেহে অভাবের কামড় এরা নিয়তই ভোগ করছে। অভাব আছে, থাকলেও একধরনের নিরাপত্তা আছে। মুসলমান মৌলবাদীদের অজ্ঞতার এবং অশিক্ষার টার্গেট হচ্ছে না। কিন্তু বেলঘড়িয়া থেকে বা দমদম থেকে এখানে এই পার্ক সার্কাসে মুসলিম-প্রধান এলাকায় বাড়ি ভাড়া নেওয়ার কী প্রয়োজন তাদের ছিল? প্রশ্নটি আমার ভেতরে থাকে, আমাকে নাড়ায় চাড়ায়।

-একটা চাকরি করে। ওই ওদিকেই বন্ডেলগেটে। একটা ওষুধ কোম্পানিতে।

-বেতন ভালো পায়?

-ভালো আর কত! ছ সাত হাজারের মতো।

-এই টাকা দিয়ে আজকাল কি আর কিছু হয়?

-ওর টাকা দিয়েই তো ওর চলতে হয়। স্বামী যা রোজগার করে, তা মায়ার আর দেখা হয় না।

-কোথায় যায়?

-কোথায় আর?

কিরণময়ীর চোখ উপচে তখন জল। সুরঞ্জন তার হাতের চা নিয়ে অন্য ঘরে চলে যায়।

-আর সুরঞ্জন। ওরও তো বোধহয় কিছু...

-কলেজের চাকরিটা যাওয়ার পর আরও কিছু চাকরি তো করলো। সবখান থেকেই ভালো লাগে না বলে বেরিয়ে পড়ে। এখন আমি শাড়ি কাপড় বিক্রি করে সংসার চালাই। ও যে কিছু টিউশনি করে ওতেই ওর হাত খরচ চলে। কিছু অবশ্য দেয় সংসারে সংসার আর কি? এর নাম কি সংসার? সুরঞ্জনের বাবা মারা যাবার পর একে আর সংসার বলে মনে হয় না। কোনেওভাবে টিকে আছি। ভগবান যত তাড়াতাড়ি নিয়ে যান, তত ভালো।

তার ফুঁপিয়ে কাঁদা শেষ হওয়া অবধি থামি আমি। শেষ হলে বলি,-আত্দীয় স্বজন যারা আছে, খবর টবর নেয়। কোনও রকম সাহায্য করে?

-না। না। না।

কিরণময়ী জোরে মাথা নাড়লেন।

-দেশের মতো কিছুই না এখানে। সবাই খুব স্বার্থপর। সুরঞ্জনকে একটা ভালো চাকরি দিতে অনেকেই তো পারতো। কেউ তো দেয়নি। আর ও বাড়িতে থেকে... ওরা আত্দীয়ের নামে কলঙ্ক মা। ওরা আমাদের সর্বনাশ করেছে।

-কারা?

-প্রথম এ দেশে এসে যাদের বাড়িতে উঠেছিলাম।

কী সর্বনাশ করেছে তা আমি নিজ থেকে জিজ্ঞেস করি না। যদিও জানার ইচ্ছে ছিল ভেতরে। সর্বনাশের কথা না বলে সম্ভাবনার কথা শুনতে আমি আগ্রহী।

আমার দিকে করুণাময়ী বড় ব্যাকুল চোখে তাকালেন। কেন তাকালেন জানি না। তিনি কি ভাবছেন আমার খুব জানাশোনা আছে এই শহরে, ইচ্ছে করলে সুরঞ্জনের একটা ভালো ব্যবস্থা আমি করতে পারবো! কোনও ভালো কোম্পানির ভালো কোনও চাকরিতে, অথবা ভালো কোনোও ব্যবসায় ঢুকিয়ে দিতে পারবো। কিরণময়ী জানেন না, সে ক্ষমতা আমার নেই। আমার নিজেরই পায়ের তলায় মাটি নেই। যে কোনও দিন আমাকেই তাড়িয়ে দিতে পারে ওপরওয়ালারা। আমাকেই তল্পি তল্পা নিয়ে বিদেয় হতে হবে।

চা বিস্কুট খাওয়া শেষ হলে কিরণময়ীকে বললাম তার শাড়ির দোকানের কিছু শাড়ি দেখাতে। দোকান বলতে কিছু নেই। লোকে এ বাড়িতে এসেই শাড়ি দেখে শাড়ি কিনে নিয়ে যায়। শুধু শাড়ি নয়, সালোয়ার কামিজও আছে। তিলজলার কিছু মেয়ে দিয়ে কাপড়ে নিজে ডিজাইন করে এমব্রয়ডারি করিয়ে আনেন। এতে শাড়ির দাম সামান্য বাড়ে। আলমারির দরজা হ্যাঁ করে খুলে ভেতর থেকে মহা উৎসাহে শাড়ি এনে বিছানায় ফেললেন তিনি। সাধারণ সুতি শাড়ি। কিছু আবার সিল্ক। কিছু শাড়িতে রঙের অাঁকা। কিছু শাড়ির ওপর সুতোর কাজ। কোনওটাই, সত্যি বলতে কী, আমার খুব পছন্দের নয়। তবু ওর মধ্যেই সাতটা শাড়ি আমি বেছে নিই। বলি-এগুলো আমি কিনবো।

কিরণময়ী অাঁতকে উঠলেন। সাতটা শাড়ি একবারে কেউ কখনও কেনেনি তার কাছ থেকে। বললাম-দাম কত হলে হিসেব করে বলুন।

-তুমি কিনবে কেন? কোনটা তোমার পছন্দ হয়েছে বলো। আমি তোমাকে দেব।

-আমি কিনে নেব। সবগুলোই আমার পছন্দ হয়েছে। করুণাময়ী বড় লজ্জায় বললেন, -তুমি কি এগুলো পরবে? এগুলো তো...

-আমি খুব দামি শাড়ি পরি না। কম দামি শাড়িই আমি কিনি। দক্ষিণাপণ থেকে খুব কম কম দামেই তো শাড়ি কিনি। পাতলা সুতি শাড়িই আমার ভালো লাগে। গরমের দেশে তো তাই পরা উচিত।

কিরণময়ী অত্যন্ত কুণ্ঠিত। বুঝতে পারি তার ইচ্ছে করছে সবগুলো শাড়িই আমাক উপহার দিয়ে দিতে। কিন্তু বাস্তবতা তাকে সেটা করতে দিচ্ছে না। যদি ঢাকা হত, হয়তো দিয়ে দিতে পারতেন। বাংলাদেশের লোকেরা দুহাতে দান করে, এ দেশে সে অভ্যেস কারও নেই। বললেন। বলার সময় লক্ষ করলাম কিরণময়ীর চোখের কোণে কালি।

-শরীর ভালো তো আপনার!

-না, শরীরে কিছুই হয়নি। যা হয় মনেই হয়।

-ঘুম হয় না?

-কোনও ঠিক নেই।

-ঘুম না হলে ওষুধ খেয়ে ঘুমোবেন।

-সুরঞ্জনটা বদলালো না। আগের মতোই আছে। আলসে। কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায়। কলেজে চাকরিটা যখন করতো, তখন ভেবেছিলাম, ছেলেটার একটা গতি হল। ও যে এমন উড়নচণ্ডিই রয়ে যাবে, তা কে জানতো। বসেই ছিল, অনেক বলে কয়ে টিউশনি ধরিয়েছি।

-বন্ধু-বান্ধব নেই? অন্যঘরের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করি।

-তেমন তো দেখি না।

তখনই কেউ এসে ঢুকলো পাশের ঘরে। যেটুকু কথোপকথন কানে এলো, তাতে বুঝি আমজাদ নামের এক লোক সুরঞ্জনের মোটরসাইকেলটা ফেরত দিতে এসেছে। আমজাদের সঙ্গে সখ্য যে বেশ, তা ভেসে আসা টুকরো টুকরো শব্দে বাক্যে বুঝি। সুরঞ্জন কিরণময়ীর ঘরে হাসিমুখে ঢুকলো। বললো, -দু'কাপ চা দাও।

-চা দাও মানে? নিজে করে নাও।

আমার এই কথায় সুরঞ্জন কিরণময়ী দুজনই অবাক। ছেলে চা চাইছে মায়ের কাছে। আর আমি কিনা বলছি, নিজে করে নাও। ওদের অবাক হওয়া মুখের দিক তাকিয়ে আমি একটু হাসলাম। না, আমার কথায় কিছু হবার নয়, বরং সুরঞ্জনের বাক্য একটি উপহার পেলাম, -এই কুটিরে এসেও নারীবাদ!

-আমার নারীবাদ তো শুধু প্রাসাদের জন্য নয় বাপু। কুটিরের জন্যও। তোমার জন্যও।

সুরঞ্জনের ঠোঁটে মিষ্টি হাসি। এই হাসিটি খুব সুন্দর। আমার সঙ্গে প্রথম বোধহয় ও এভাবে হাসলো। মনে কি কোনও কারণে স্ফূর্তি, কে জানে!

ওদিকে আমজাদের সঙ্গে প্রথম সিপিএম, নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর নিয়ে কথা হল। সুরঞ্জন শুনলাম সিপিএমের গালাগাল করলো। এরপর হঠাৎ আমজাদের খিদিরপুরের ব্যবসা নিয়ে সুরঞ্জনের দুশ্চিন্তা। ওটি বেগবাগানের কোথাও, সে কারও সঙ্গে কথা বলেছে, নাকি স্থানান্তরিত করা উচিত। ওখানে সন্ত্রাসীদের উৎপাত খুব বেশি। জীবনের ঝুঁকিও আছে। কী দরকার ঝুঁকি নিয়ে। কিরণময়ীর সঙ্গে আমি কথা চালিয়ে গেলেও কান আমার সুরঞ্জনদের আলোচনায়। এক ঘরের কথা আরেক ঘরে খুব সহজে না গেলেও শোনা যায়।

-এত এলাকা থাকতে এই এলাকায় কেন? কিরণময়ীকে জিজ্ঞেস করি।

-বেলঘরিয়ায় তো ছিলামই। ওখানে তার বাবা মারা যাবার পর থেকেই আর থাকতে চাইছিল না। কিন্তু বাসা বদলানো আর হয়ে ওঠেনি। এ বছর তো কিছুতেই থাকবে না। কী জানি কী হয়েছে। বদলালো বাসা। গোঁ ধরলো, বাসা বদলালে নাকি পার্ক সার্কাসেই বদলাতে হবে। কেন, কী উদ্দেশ্যে জানিও না। কাছে পিঠে যে কোথাও চাকরি যদি করতো তাহলে তো বুঝতাম।

-তবে কী কারণে?

প্রশ্নটি করার সময় উদ্বেগ কাঁপে কণ্ঠে। আমার ভালো লাগছে না এক মুসলমান ছেলের সঙ্গে সুরঞ্জনের এমন হৃদ্যতা। সুরঞ্জন কিসে জড়াচ্ছে তবে! এই এলাকায় বাস করার উৎসাহ তার কেন, কী কারণ এর পেছনে থাকতে পারে, তা আমাকে দুশ্চিন্তায় ফেলে। সে কি বিজেপি বা আর এসএসএর দূত হয়ে এখানে এসেছে! মুসলমানদের ভেতরের খবর নিয়ে তারপর এদেরই এক এক করে নাশ করবে!

আমি কার পক্ষ নেব। ওই নিরীহ আমজাদের, নাকি সুরঞ্জনের। আমজাদ নিরীহ কি না তাই বা কে জানে। আমজাদ লোকটি বা ছেলেটি আমাকে যেন না দেখতে পায়, এমন আড়ালে থাকি। কারণ, বলা যায় না, যদি সে মৌলবাদী হয় তবে এখানেই আমাকে জবাই করে ফেলে রাখবে। সুরঞ্জন আমাকে রহস্যের মধ্যে পাক খাওয়াতে থাকে। আমার কৌতূহল আর সংশয় ভরা মুখখানির দিকে সে চোখ ছোট করে বার দুয়েক তাকিয়েছে। ওই চোখে আরও রহস্যের আনাগোনা ছিল। কী চায় সে? কোনও তো অন্যায় করিনি যে প্রতিশোধ নিতে হবে। আমাকে বলে দাও আমি যে কট্টর হিন্দু হয়ে উঠেছিলাম, হিন্দু রাষ্ট্র কায়েমের জন্য মাঠে নেমেছি, এখন আমি দরিদ্র, বাস করছি খোদ মুসলিম এলাকায়। আমার উদ্দেশ্য এই এই এই। বলে দিলে মিটে যায়। আমাকে দুর্ভাবনার মধ্যে রেখে কী আনন্দ তার!

-এখানে মুসলমানদের সঙ্গে আপনাদের ওঠাবসা আছে নাকি?

-হ্যাঁ হ্যাঁ। ওরা খুব ভালো।

-ভালো?

-হ্যাঁ নিশ্চয়ই।

-এখানকার লোক?

-হ্যাঁ এখানকার। ওরা তো বাঙালি।

কিরণময়ী বাংলাদেশের মেয়ে বলেই হয়তো ভুলটা করেনি। বাঙালি মুসলমানদের মুসলমান বলা, আর বাঙালি হিন্দুদের বাঙালি বলাটা এখানকার লোকদের বদঅভ্যেস, এসব আসে চূড়ান্ত অশিক্ষা এবং কুশিক্ষা থেকে। বাঙালি হিন্দু আর বাঙালি মুসলমান বাংলাদেশে এক এলাকায় বাস করে বলেই দুজনের জানাশোনা বেশি হয়। এখানে এলাকা আলাদা। হিন্দু এলাকায় মুসলমানের বাস অসম্ভব। কিন্তু চারদিকে মুসলমানদের বাড়ি আর মাত্র দুএকটি বাড়ি হিন্দুর এখানে। কোনও হিন্দু ঠেকায় না পড়লে এই এলাকায় থাকতে আসে না। আর সুরঞ্জন শুনি শখ করে এসেছে। মুসলমান আছে বলে একটা দেশ, যেটা ওর নিজের দেশ, ত্যাগ করে চলে এল, আর এ শহরে হিন্দু এলাকা ছেড়ে কী স্বার্থে ও মুসলমানের এলাকায় বাস করতে এলো, তা না জানা অবদি আমি স্বস্তি পাচ্ছি না। সুরঞ্জনের রহস্য ইচ্ছে করে দুহাতে ছিঁড়ি।

সাতটা শাড়ির দাম সাড়ে তিন হাজার টাকা। টাকাটা খুব কুণ্ঠায় খুব লজ্জায় তিনি নিলেন বটে, কিন্তু একটা শাড়ি, ভালো একটা সিল্কের শাড়ি আমাকে দিলেন।

পাশের ঘরের আমজাদ আমার উপস্থিতির কথা কিছু যেন না জানে। কিন্তু এ কথা কাকে বলি। আমার নিরাপত্তা রক্ষীরা আমাকে এ বাড়িতে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছে। তারা জানে না কেউ ঢুকে গেছে বাড়িতে, তার নাম আমজাদ। আমজাদের মনে কী আছে, তা এক আমজাদ ছাড়া আর কেউ জানে না। সুরঞ্জন কি জানে!

সংশয় আমাকে স্বস্তি দেয় না।

-যে লোকটি এসেছে, তাকে চেনেন? কিরণময়ীকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করি। আমার সারা মুখ থমথমে। [ চলবে ]

 

 

 

সর্বশেষ খবর