বুধবার, ২০ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

রানী প্রথম এলিজাবেথ কাহিনী

তার শাসনামলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এত বিশাল ছিল যে সেখানে কখনো সূর্য ডুবত না!

রানী প্রথম এলিজাবেথ কাহিনী

রানী প্রথম এলিজাবেথ ছিলেন অসম্ভব রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারিণী। নারী হয়েও যে রাষ্ট্র শাসনের ভার সফলভাবে পালন করা যায়, সেটির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় তার  মাধ্যমেই। ইতিহাসে তার স্থানটি রয়েছে তাই বিশেষ মর্যাদায়। রানী প্রথম এলিজাবেথ ছিলেন ইংল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ডের রানী। তিনি আনুমানিক ১৭ নভেম্বর ১৫৫৮ থেকে শুরু করে ২৪ মার্চ ১৬০৩ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তার রাজকীয় অভিষেক হয়েছিল ১৫ জানুয়ারি ১৫৫৯ সালে। তার পূর্বসূরি ছিলেন ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরি। তিনি ছোটবেলা থেকেই রাজবংশের  রাজকীয় পরিবেশে বেড়ে ওঠেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ইংল্যান্ডের রানী, ফ্রান্সের রানী ও আয়ারল্যান্ডের রানীও ছিলেন। তিনি কুমারী ছিলেন। বিয়ে করেননি বলে তাকে কুমারী রানী বলা হতো। কুমারী রানী এলিজাবেথের বুদ্ধিমত্তার এখনো প্রশংসা করা হয়। রাষ্ট্র পরিচালনার দিক থেকে চিন্তা করলেও তার দক্ষতা নিয়ে কখনই প্রশ্ন ওঠেনি।

বরং তার শাসনামলে দেশের উন্নতির প্রমাণ পেয়েছেন গবেষকরা। রানী প্রথম এলিজাবেথ যে নারী নেতৃত্বের আধুনিক উপস্থাপনা রেখে গেছেন সে কারণেই যুগে যুগে আসা আধুনিক নারী নেতৃত্বেরও একজন সফল উদাহরণ তিনি। বিস্তারিত লিখেছেন- সাইফ ইমন

 

মানব সভ্যতার বিকাশে পুরুষের পাশাপাশি সমানতালে কাজ করে গেছেন নারীরা। তাদের অবদান কোনো অংশেই কম ছিল না। যুগে যুগে তাদের কীর্তি লেখা হয়েছে ইতিহাসের পাতায়। তেমনি একজন মহীয়সী নারী ব্যক্তিত্বকে নিয়ে আমাদের আজকের এই আয়োজন রানী প্রথম এলিজাবেথ কাহিনী। ইংল্যান্ডের ইতিহাসে যে রানীর অবদান অপরিসীম। ইংল্যান্ডকে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন সবার হৃদয়ে। তার সময়েই ইংল্যান্ডের কাছে স্পেনের ‘দ্য ইনভিন্সিবল আর্মাডা’ পরাজিত হয়, ফলে সামরিক ক্ষেত্রেও ইউরোপে ইংল্যান্ডের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। রানী প্রথম এলিজাবেথের কাহিনীতে মূলত তার সারা জীবন একা থাকাই বেশি গুরুত্ব পায় ইতিহাসে।

রানী ছিলেন অবিবাহিত। তাই ইতিহাসের পাতায় চিরকুমারী রানী হিসেবেই বেশি পরিচিতি পান তিনি। স্বাভাবিকভাবেই কেন তিনি অবিবাহিত ছিলেন এই নিয়ে হয়েছে বিস্তর আলোচনা। যখন স্বামীর ঘর-সংসার করার কথা, যখন ছেলেমেয়ের স্নেহময়ী মা হওয়ার কথা তখন তার রাজ্যাভিষেক ঘটে। দিনটি ছিল ১৫৫৯ সালের ১৫ জানুয়ারি। মাত্র ২৬ বছর বয়সে এলিজাবেথের অভিষেক হয়। রানী হয়ে রাজ্য পরিচালনা শুরু করার পরই একটি প্রশ্ন সবার সামনে এসে দাঁড়ায় আর তা হলো- কে হবে রানীর স্বামী? টিউডর রাজবংশের শেষ উত্তরাধিকারিণী রাজত্বের প্রথম দিকেই এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল বিয়ে করা।

কারণ তার বিয়ের মধ্য দিয়েই উত্তরাধিকার নির্বাচিত করা যেত সহজেই। যাতে তার মৃত্যুর পর রাজসিংহাসন নিয়ে গৃহযুদ্ধের সূচনা না হয়।

স্বাভাবিকভাবেই সেই সময়ে ইউরোপের সবচেয়ে কাক্সিক্ষত পাত্রী ছিলেন রানী প্রথম এলিজাবেথ। গোটা ইউরোপের বিভিন্ন রাজপরিবার থেকে শুরু করে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা রানীকে বিয়ে করার জন্য মরিয়া হয়ে গিয়েছিলেন। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন এলিজাবেথের সৎ বোন রানী মেরির স্বামী স্পেনের রাজা ফিলিপ, তৎকালীন সুইডেনের প্রিন্স এরিক, রোমান হলি এমপেরোর ফার্ডিনান্দের ছেলে আর্চডিউক চার্লস এবং এমন আরও অনেকেই। এদের মধ্যে একমাত্র স্পেনের রাজা ফিলিপকে এলিজাবেথ সরাসরি ‘না’ করেন। সিংহাসনে আসীন রানীর বিয়ে অনেকটাই জটিল একটা বিষয় তা ইতিহাস উপলব্ধি করে। কারণ ভুল কাউকে বিয়ে করা মানে পুরো রাজ্যের ওপর তার প্রভাব পড়া। তাই এই বিষয়ে অনেক সাবধানী হওয়া জরুরি ছিল। আবার রাজনৈতিক কারণগুলোও এ ক্ষেত্রে খুব স্পষ্ট। যেমন ভুলের কারণে রানীর অবস্থা তার সৎ বোন রানী মেরির মতো হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল। এলিজাবেথকে এমন কাউকে স্বামী হিসেবে বেছে নিতে হবে যে ইউরোপের কোনো ক্ষমতাশালী রাজা হবে না, কিন্তু পদমর্যাদা খুব ভালো হবে এবং শুধু রানীর স্বামী হিসেবেই থাকবে। সব কিছু মিলিয়ে রানীর মন্ত্রীরা প্রাথমিকভাবে সুইডেনের প্রিন্স এরিককে রানীর স্বামী হিসেবে ভেবেছিলেন। কারণ, এরিক ছিলেন ইংল্যান্ডের জনগণের মাঝে তুমুল জনপ্রিয়।

ধর্মমত দিয়েও দুজন একই ধর্মের অনুসারী। কিন্তু সুইডেনের রাজপরিবারের খুব বেশি সম্পত্তি না থাকায় এই বিয়ে নাকচ করা হয়। এরই মধ্যে রানীর জীবনে প্রেম চলে আসে। ফলে তার বিয়ের প্রক্রিয়াটা আরও বেশি জটিল করে তোলেন তিনি প্রেমে পড়ার মধ্য দিয়ে। বাল্যবন্ধু লর্ড রবার্ট ডুডলির প্রেমে পড়েছিলেন তিনি। অথচ রবার্ট ডুডলি বিবাহিত ছিলেন। কিন্তু বাধা হয়ে আসে ডুডলির মৃত বাবা ডিউক অব নর্থাম্বারল্যান্ড। ডিউক বিশ্বাসঘাতকতার জন্য রানী মেরির রাজত্বের সময় মৃত্যুবরণ করেন। আবার ডুডলির স্ত্রীও রহস্যজনকভাবে সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে মারা যাওয়ায় এলিজাবেথকে  ডুডলিকে বিয়ে করা থেকে বিরত থাকতে হয়। যাতে এই রহস্যজনক মৃত্যুর সঙ্গে এলিজাবেথের কোনো সম্পৃক্ততা না থাকে। রবার্ট ডুডলির পর সবচেয়ে ভালো পাত্র ছিলেন ফ্রান্সের রাজার ভাই ডিউক অব এলেনকন, ফ্রান্সিস। ফ্রান্সিস ইংল্যান্ডে আসেন রানী এলিজাবেথকে বিয়ে করতে। রানীও তাকে পছন্দ করেন। কিন্তু আবারও ধর্ম এবং রাজনীতি বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এভাবেই মধ্যযুগে ইংল্যান্ডের সর্বশ্রেষ্ঠ রানীকেই আজীবন অবিবাহিত থাকতে হয়। রানীর এত ক্ষমতা ছিল কিন্তু কাউকে ভালোবাসা আর তার হয়ে ওঠেনি। রানীর মৃত্যু নিয়ে অনেক রকম কথা প্রচলিত আছে। যেমন অনেকে বলেন, রানীর প্রসাধনীর সঙ্গে বিষ মিশানো ছিল যা রক্তের সঙ্গে মিশলে মৃত্যুবরণ করেন রানী। আবার অনেকে বলেন, তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

 

দ্য কিংস ডিসেপশন

স্পেনের তৎকালীন শাসক তার বড় ছেলের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন এলিজাবেথকে। কিন্তু রানী প্রত্যাখ্যান করেন তা। এরপর  স্পেনের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন তিনি। প্রখ্যাত লেখক স্টিভ তার বইয়ে রানী এলিজাবেথকে তাই পুরুষ হিসেবে সন্দেহ করেন। বিবাহ সম্পর্ক তৈরি করে যে যুদ্ধ অনায়াসেই এড়ানো যেত সেখানে রানী হয়তো চেয়েছিলেন নিজের আসল পরিচয় ঢাকতে। অন্তত এমনটাই মনে করছেন লেখক স্টিভ। মার্কিন লেখক স্টিভ বেরি তার উপন্যাস নিউ ইয়র্কের ব্যালান্টাইন বুকস থেকে প্রকাশিত ‘দ্য কিংস ডিসেপশন’ এ এমনই দাবি করেছেন। যে পরিচয় লুকিয়ে আছে দক্ষিণ-পশ্চিম ব্রিটেনের গু­স্টারশায়ার কাউন্টির ছোট্ট গ্রাম কটসওল্ডে। স্টিভ লিখেছেন, ১৫৪৩ সালে বছর দশেকের ছোট্ট এলিজাবেথ তখন কটসওল্ডে। লন্ডনে প্লেগ ছড়িয়েছে। তাই মেয়েকে বাঁচাতে কটসওল্ডে পাঠিয়ে দিয়েছেন রাজা অষ্টম হেনরি। বেশ কিছুদিন পরে মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে এলেন তিনি। কিন্তু তার আগেই মারা গেলেন এলিজাবেথ। তাই তখন যা থাকে কপালে ভেবে গ্রামের এক সাদামাটা বালক নেভিলকে এলিজাবেথ সাজিয়ে হাজির করা হয়েছিল হেনরির সামনে। ফলে সেই গ্রাম্য বালককেই এত দিন ধরে প্রথম এলিজাবেথ জেনে এসেছে ব্রিটেন। 

 

 

 

 

একনজরে প্রথম এলিজাবেথ

রাজত্ব  : ১৭ নভেম্বর ১৫৫৮-২৪ মার্চ ১৬০৩

রাজ্যাভিষেক : ১৫ জানুয়ারি ১৫৫৯

পূর্বসূরি : প্রথম মেরি ও দ্বিতীয় ফিলিপ

উত্তরসূরি          : প্রথম জেমস

জন্ম     : ৭ সেপ্টেম্বর ১৫৩৩, প্লাসেন্টিয়া প্রসাদ, গ্রিনিচ, ইংল্যান্ড

মৃত্যু     : ২৪ মার্চ ১৬০৩, রিচমন্ড প্রাসাদ, সারে, ইংল্যান্ড

সমাধি  : ওয়েস্টমিন্সটার অ্যাবে

রাজবংশ           : টিউডর বংশীয়

পিতা    : রাজা ৮ম হেনরি

মাতা    : অ্যান বোলিন

সর্বশেষ খবর