রবিবার, ২১ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর রহস্যময় জীবন

রণক ইকরাম

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর রহস্যময় জীবন

ভারতবর্ষের ইতিহাসে সবচেয়ে পটপরিবর্তনকারী অধ্যায় হচ্ছে ব্রিটিশ শাসনামল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের থাবা থেকে এ উপমহাদেশকে মুক্ত করতে ঝরাতে হয়েছে অনেক রক্ত, পাড়ি দিতে হয়েছে হাজারো বাধার জঞ্জাল। ব্রিটিশদের কবল থেকে ভারতবর্ষকে বাঁচানোর জন্য যেসব মহান বীর সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম একজন কিংবদন্তি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। অহিংসা-উদারতা- কিংবা ধৈর্যে নয়; বরং বল প্রয়োগেই ব্রিটিশদের তাড়াতে হবে- এই মন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন নেতাজি। স্বাধীনতা নিয়ে তাঁর বিখ্যাত উক্তি, ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।’  বিদ্রোহী মনোভাবের কারণে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে এগারোবার কারারুদ্ধ করেছিল।  নেতাজির হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া, তাঁর মৃত্যু নিয়ে বছরের পর বছর কেবল রহস্যই বেড়েছে।

 

বাঙালি পরিবারের সুবোধ বালক

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্ম ১৮৯৭ সালে ২৩ জানুয়ারি এক বাঙালি পরিবারে। সেই সময় তাঁর পরিবারের বসতি ছিল বর্তমান ভারতের ওড়িশার কটক শহরে। তবে সুভাষচন্দ্র বসুর পৈতৃক নিবাস ছিল পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কোদালিয়া নামক গ্রামে। নেতাজির পিতা জানকীনাথ বসু ছিলেন আইনজীবী। কর্মক্ষেত্র ছিল কটক। তাঁর মায়ের নাম প্রভাবতী দেবী। তিনি ছিলেন পিতামাতার চৌদ্দ সন্তানের মধ্যে নবম। তাঁর ছাত্রজীবন শুরু হয় কটকের র‌্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলে। কলকাতার স্কটিস চার্চ কলেজ থেকে তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ছেলেবেলায় নেহাতই সুবোধ বালকের মতো দেখতে মনে হলেও সুভাষের বিপ্লবী মনের পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল ছাত্রজীবন থেকেই। প্রতিবাদ করতে গিয়ে বহিষ্কৃতও হয়েছিলেন তিনি।

 

ইংল্যান্ডে অবস্থানকালেই ঝড়

এরপর তিনি ইংল্যান্ডে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিটজ উইলিয়াম কলেজে উচ্চশিক্ষার্থে ভর্তি হন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে তিনি এ কলেজের পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান লাভ করেন এবং মরাল সায়েন্স ক্যামব্র্রিজ ট্রাইপস অধিকার করেন।

সুভাষচন্দ্র যখন ইংল্যান্ডে তখন ভারতবর্ষের রাজনীতিতে ঘটে যায় নানা ঘটনা। এর মধ্যেই ১৯১৯ সালে মহাত্মা গান্ধী ‘রাউটাল বিল’ বাতিলের আবেদন জানান। একই বছর এপ্রিলে সর্বভারতীয় সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হয় এবং হরতাল পালিত হয়। পাঞ্জাবে গান্ধীর প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হলে তিনি সেই নিষেধাজ্ঞা ভেঙে পাঞ্জাবে প্রবেশের চেষ্টা করেন। তখন দিল্লি যাওয়ার পথে গান্ধীকে গ্রেফতার করা হয়। সব মিলিয়ে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। গান্ধীজির এই আন্দোলন এবং জালিয়ানওয়ালাবাগে হত্যাকান্ডের ঘটনার পর সুভাষচন্দ্র তীব্র ব্রিটিশবিরোধী হয়ে ওঠেন। ফলে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা প্রত্যাখ্যান করে তিনি ভারতে ফিরে আসতে চাইলেন। তাঁর উদ্দেশ্য তখন একটাই- যে করেই হোক ব্রিটিশদের ভারত থেকে উৎখাত করতে হবে।

 

গান্ধী-চিত্তরঞ্জনের ছত্রছায়ায়

১৯২১ সালের ১৬ জুলাই ভারতে ফিরেই গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন নেতাজি। গান্ধীজির নির্দেশে দেখা করেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সঙ্গে। চিত্তরঞ্জন দাস সেই সময় সবার রাজনৈতিক গুরু ছিলেন। কলকাতায় ফিরে প্রথমে সংবাদপত্রে লেখালেখি এবং পরে বঙ্গীয় প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির প্রচারের দায়িত্ব পান। এরপর দেশবন্ধু কলকাতা পৌরসংস্থার মেয়র নির্বাচিত হলে তাঁর অধীনে বেশ কিছুুদিন কর্মরত ছিলেন সুভাষচন্দ্র। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে অন্যান্য জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে তাঁকেও বন্দি করা হয়। বন্দি অবস্থাতেই যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। ১৯২৭ সালে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন।

সামরিক কংগ্রেস!

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতা কংগ্রেসকে সামরিক কায়দায় সাজান। এক্ষেত্রে তিনি যে বিশেষ বাহিনী গড়ে তোলেন, তার নাম ছিল ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’। সে সময়ে ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’ বাহিনীতে নারী ও পুরুষ বিপ্লবী ছিল। ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’ বাহিনীকে সামরিক শিক্ষা প্রদান করা হয় এবং এ বাহিনীর প্রতিটি সদস্যকে স্বাধীনতার জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা হয়। ‘হিন্দুস্থান সেবক দল’ নামে আরেকটি বাহিনী তৈরি করা হয়েছিল। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় কংগ্রেস অধিবেশনে সুভাষচন্দ্রের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ছাড়াও গঠিত হয় সশস্ত্র বিপ্লবী দল যেমন- অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর, পূর্ণদাস বাউলের দল, উত্তরবঙ্গের বিপ্লবী সংগঠন। যা সে সময় সবার নজর কাড়ে। ১৯২৯ সালের আগস্ট মাসে ‘নিখিল ভারত লাঞ্ছিত রাজনৈতিক দিবস’ উপলক্ষে একটি শোভাযাত্রার কারণে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। পরের বছর ২৩ সেপ্টেম্বর সুভাষ জেল থেকে ছাড়া পান। এ বছরই তিনি কলকাতা করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। ১৯৩১ সালে আবারও কারারুদ্ধ হন এবং মুক্তিও পান।

 

গ্রেফতার তেজগাঁওয়ে

১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ২৮ অক্টোবর ঢাকা জেলার ম্যাজিস্ট্রেট ডুর্নোকে হত্যা করেন তৎকালীন বাংলার দুই বিপ্লবী সরোজ গুহ এবং রমেন ভৌমিক। এদের পুলিশ ধরতে না পেরে ঢাকার স্থানীয় লোকদের ওপর নির্যাতন শুরু করে। এর প্রতিবাদে তিনি ঢাকায় রওনা হলে ১১ নভেম্বর তেজগাঁও রেলস্টেশন থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ১৪ নভেম্বর ৫০০ টাকা জামিনে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়।

 

ক্রমে ক্রমে বিপ্লবের কেন্দ্রে

১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারিতে কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় ইংরেজদের সব ধরনের রাজনৈতিক অত্যাচার বন্ধ করার দাবি করা হয় এবং সাত দিনের মধ্যে এই দাবি না মানলে আইন অমান্য আন্দোলনের হুমকি দেওয়া হয়। এই সূত্রে সরকার গান্ধীজি, জওহরলাল নেহরু, বল্লভ ভাই প্যাটেলসহ বহু নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে। বোম্বে থেকে ফেরার পথে বোম্বে রেলস্টেশনের ৩০ মাইল দূরে কল্যাণপুরে সুভাষ বসুকে গ্রেফতার করা হয়। বন্দি অবস্থায় তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হলে তাঁকে চিকিৎসার জন্য ইউরোপ যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ২৩ ফেব্র“য়ারি তিনি ভিয়েনার উদ্দেশে বোম্বে থেকে জাহাজযোগে রওনা দেন। ৮ মার্চ তিনি ভিয়েনায় পৌঁছান। একটু সুস্থ হয়ে তিনি ইউরোপের সুইজারল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়া, রুমানিয়া, বুলগেরিয়াসহ আরও দেশ ভ্রমণ করেন। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ এপ্রিল নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ফিরলে তাঁকে আবার গ্রেফতার করা হয়। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। এর মধ্যে তিনি আবার ইউরোপ যান এবং ফেরতও আসেন। আস্তে আস্তে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে যেমন প্রবল বিক্রমে এগোতে থাকেন,  তেমনি ডালপালা মেলতে শুরু করে সুভাষ বসুর বিপ্লবী চেতনাও। ১৯৩২ সালে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সচিব এমিলিকে বিয়ে করেন। ১৯৪২ সালে তাঁদের কন্যাসন্তান অনিতার জন্ম হয়।

 

বহিষ্কৃত সেই ছেলেটি...

নেতাজির জীবনের শুরুর দিকের সবচেয়ে বড় বিপ্লবটা সম্ভবত তাঁর ছাত্র জীবনেই। ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত তিনি কটকের একটি ইংরেজি স্কুলে পড়াশোনা করেন। বর্তমানে এই স্কুলটির নাম স্টুয়ার্র্ট স্কুল। এরপর তিনি ভর্তি হন কটকের র‌্যাভেনশ কলেজিয়েটে। এই স্কুল থেকেই ১৯১১ সালে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেন। মেধাবী সুভাষ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিত এই পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। এরপর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজের ইংরেজি অধ্যাপক ওটেন ছিলেন ভারতবিদ্বেষী। তিনি প্রায়ই ভারতবিদ্বেষী কথা বলতেন।

তরুণ সুভাষের মনে দেশপ্রেম জেগে ওঠে। তিনি কিছুতেই এসব কথা মেনে নিতে পারলেন না। অধ্যাপক ওটেনের ভারতবিরোধী কথাবার্তার ঘোর বিরোধিতা করেন নেতাজি। কিন্তু ইংরেজ শাসনামলে ইংরেজ অধ্যাপকের দাপট ছিল বেশি। ফলে অধ্যাপক ওটেনের সমর্থকদের দ্বারা প্রহৃত হন সুভাষ। এরপর কলেজ কর্তৃপক্ষ কয়েকজন ছাত্রসহ সুভাষ বসুকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করে। এরপর তিনি স্যার আশুতোষ চৌধুরীর সহায়তায় স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজে লেখাপড়ার সময় তিনি ইউনিভার্সিটি অফিসার্স ট্রেনিং কোরে যোগ দেন এবং সমরবিদ্যার প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে এই কলেজ থেকে তিনি দর্শনে বিএ (সম্মান) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর অভিভাবকরা তাঁকে ভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য বিলেত পাঠান।

 

 

মাকে লেখা চিঠি

সুভাষচন্দ্র বসু খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ১৯১৩ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে গোটা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। ফলে তিনি কুড়ি টাকা বৃত্তি পেলেন। কিন্তু এই বৃত্তির টাকা তিনি নিজে খরচ না করে দিন-দুঃখীর সেবায় দান করলেন।  প্রবেশিকা পরীক্ষার পর নেতাজি তাঁর মাকে একটি চিঠি লিখেন। সেই চিঠির শেষের অংশটিতে তিনি লিখেন-

... আমি যদি না পড়িয়া এ স্থান পাই তবে যাহারা লেখাপড়াকে উপাস্য দেবতা মনে করিয়া তজ্জন্য প্রাণপাত করে তাহাদের কী অবস্থা হয়? তবে প্রথম হই আর লাস্ট হই আমি স্থিররূপে বুঝিয়াছি লেখাপড়া ছাত্রের উদ্দেশ্য নহে-বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘চাপ্রাস’ (ডিগ্রি) পাইলে ছাত্ররা আপনাকে কৃতার্থ মনে করে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘চাপ্রাস’ (ডিগ্রি) পাইলে যদি কেহ প্রকৃত জ্ঞান না লাভ করিতে পারে- তবে সে শিক্ষাকে আমি ঘৃণা করি। তাহা অপেক্ষা মূর্খ থাকা কি ভালো নয়? চরিত্র গঠনই ছাত্রের প্রধান কর্তব্য- বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা চরিত্র গঠনকে সাহায্য করে-আর কার কিরূপ উন্নত চরিত্র তাহা কার্যেই বুঝিতে পারা যায়। কার্যই জ্ঞানের পরিচায়ক। বইপড়া বিদ্যাকে আমি সর্বান্তকরণে ঘৃণা করি। আমি চাই চরিত্র-জ্ঞান-কার্য। এই চরিত্রের ভিতরে সবই যায়- ভগবদ্ভক্তি, - স্বদেশপ্রেম, - ভগবানের জন্য তীব্র ব্যাকুলতা সবই যায়। বই পড়া বিদ্যা তো তুচ্ছ সামান্য জিনিস- কিন্তু হায় কত লোকে তাহা লইয়া কত অহঙ্কার করে।

 

দুনিয়া কাঁপানো গোপন নথি

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সম্পর্কিত ১০০টি গোপন নথি প্রকাশ করা হয়েছে। দিল্লিতে ন্যাশনাল আর্কাইভস অব ইন্ডিয়ায় (এনএআই) নেতাজির ১১৯তম জন্মবার্ষিকীতে ২০১৬ সালে এসব নথির ডিজিটাল সংস্করণ প্রকাশ পায়। নেতাজিকে নিয়ে ব্রিটিশ ও মার্কিন গোয়েন্দাদের যৌথ প্রতিবেদনের একটি নথি থেকে জানা যায়, ১৯৪৮ সালে স্বাধীন ভারতবর্ষে এসেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। তিনি জীবিত ছিলেন ১৯৪৫ সালে তাইহোকুর তথাকথিত বিমান দুর্ঘটনার পরও। নেতাজিকে নিয়ে প্রকাশিত এসব নথিতে একদিকে যেমন সামরিক হাসপাতালে নেতাজির অন্তিম মুহূর্তগুলোর প্রত্যক্ষদর্শী জুইসি নাকামুরার বক্তব্য উঠে এসেছে, ঠিক তেমনি ১৯৬২ সালে জওহরলাল নেহরু কর্তৃক নেতাজির স্বজনদের কাছে তাঁর মৃত্যু সংবাদ পৌঁছার বিষয়টিও প্রকাশ পেয়েছে। নথি থেকে জানা যায়, ভারত সরকার নেতাজির মেয়েকে ছয় হাজার রুপি মাসোয়ারা হিসেবে দিত। তবে ১৯৬৫ সালে তার বিয়ের পর তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রাথমিকভাবে নেতাজির স্ত্রীকে এ মাসোয়ারা প্রদানের প্রস্তাব দেওয়া হলেও তিনি তা নিতে অস্বীকৃতি জানান। নথি থেকে জানা গেছে, মৃত্যুর আগে নেতাজির শেষ বক্তব্য ছিল, ‘আমি ঘুমাতে চাই।’ এর আগের বছর নেতাজি নিখোঁজ হওয়ার ৭০ বছরপূর্তিতে তাঁর সম্পর্কিত ৬৪টি গোপন নথি প্রকাশ করে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার। দুটি তদন্ত কমিশন তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট তাইওয়ানের তাইপেতে এক বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজি মারা যান। কিন্তু তৃতীয় আরেকটি তদন্ত কমিশন ও নেতাজির বেশ কয়েকজন আত্মীয়সহ অনেকে বিমান দুর্ঘটনার তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করেন। তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে নেতাজির অন্তর্ধান রহস্যই রয়ে গেছে।

 

সুভাষচন্দ্রের নেতাজি হয়ে ওঠা

সুভাষচন্দ্র পরপর দুবার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে আদর্শগত সংঘাত এবং কংগ্রেসের বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ নীতির প্রকাশ্য সমালোচনা করার জন্য তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়। এর মধ্যেই তিনি ফরওয়ার্ড ব্লক নামক একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি জানাতে থাকেন। কলকাতায় প্রবল জনমত সৃষ্টি করলে ইংরেজ সরকার ভীত হয়ে ১৯৪০ সালের ২ জুলাই নেতাজিকে গ্রেফতার করে এবং কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে তাঁকে আটকে রাখে। ১৯৪১ সালের জানুয়ারি মাসে গৃহবন্দি অবস্থায় পালিয়ে আফগানিস্তান হয়ে রাশিয়ার পথে যাত্রা করেন। সেখানে ভারতের স্বাধীনতার জন্য সোভিয়েত শক্তির সমর্থন চেয়ে ব্যর্থ হয়ে দেশে ফিরেন। এরপর গোয়েন্দা নজরদারি এড়ানোর জন্য মৌনব্রত ও নির্জনবাসের ঘোষণা দেন। ওই সুযোগে তিনি মৌলভি জিয়াউদ্দীনের মতো দাড়ি রাখেন ও তার মতোই পোশাক পরে গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ১৯৪১ সালের ২৮ মার্চ পালিয়ে আফগানিস্তান ও মস্কো হয়ে জার্মানির বার্লিন পৌঁছেন। তিনি জার্মানি থেকে সাবমেরিনযোগে জাপান পৌঁছেন। জাপান-অধিকৃত সিঙ্গাপুরে রাসবিহারী বসুর তত্ত্বাবধানে ভারতীয় উপমহাদেশের যুদ্ধবন্দিদের নিয়ে ‘আজাদ-হিন্দু ফৌজ’ গঠন করেন এবং এর সর্বাধিনায়ক হন।

১৯৪২ সালে ব্রিটিশ সরকার ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ দলকে বেআইনি ঘোষণা করে। সমগ্র ভারতজুড়ে ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ দলের সব পার্টি অফিস বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৪৩ সালে নেতাজি জাপানে যান। এরমধ্যে আরেক ভারতীয় বিপ্লবী রাসবিহারী বসু, প্রবাসে একটি সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। এই বাহিনীর নাম ছিল ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী। ১৯৪৩ সালের ৪-৭ জুলাই সিঙ্গাপুরস্থ মহাএশিয়া মিলনায়তনে ভারতীয় স্বাধীনতা লীগের প্রধান নেতৃবৃন্দের মহাসভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রেসিডেন্ট বিপ্লবী রাসবিহারী বসু দাঁড়িয়ে সভায় নতুন অতিথি হিসেবে সুভাষচন্দ্র বসুকে পরিচয় করিয়ে দেন। সেই সঙ্গে লীগের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে সুভাষ বসুকে স্থলাভিষিক্ত করার জন্য নিজের ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করেন। এরপর সভার নেতৃবৃন্দ এবং সদস্যরা করতালি দিয়ে সুভাষ বসুকে স্বাগত জানান। রাসবিহারী বসু প্রবাসে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিচালক নির্বাচিত হওয়ার কারণে সুভাষ বসুকে ‘নেতাজি’ উপাধি ঘোষণা করেন। রাসবিহারী বসুর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এই মহাসভায় সুভাষচন্দ্র বসু দুই ঘণ্টাব্যাপী এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন।

 

বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়নি!

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যুরহস্য এ উপমহাদেশের অমীমাংসিত রহস্যগুলোর অন্যতম। যদিও সবাই জানে, বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে- কিন্তু আসলে মূল ঘটনা তেমন নয়। তিনি বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হননি বলে জানিয়েছেন এক ব্যক্তি। নেতাজির গাড়িচালক দাবিদার ওই ব্যক্তি জানিয়েছেন, যে বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজি নিহত হয়েছেন বলে ব্যাপকভাবে প্রচলিত, সে ঘটনার চার মাস পর তিনি নেতাজিকে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড সীমান্তের কাছে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। ১০৭ বছর বয়সী এই ব্যক্তির নাম নিজামুদ্দিন। পেশায় গাড়িচালক নিজামের বাড়ি আজমগড় জেলার বিলাড়িগঞ্জ এলাকার ইসলামপুরে। তিনি নিজেকে নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজের একজন সদস্য হিসেবে দাবি করেছেন। ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে নেতাজি ১৯৪২ সালে এ বাহিনী গঠন করেন। একটি পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নিজামুদ্দিন বলেন, তিনি নিশ্চিত নেতাজি কোনোভাবেই ১৯৪৫ সালের বিমান দুর্ঘটনায় মারা যাননি। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ওই বিমান দুর্ঘটনার তিন থেকে চার মাস পর তিনি নেতাজিকে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড সীমান্তের কাছ দিয়ে প্রবাহিত সিতাংপুর নদীর তীরে নামিয়ে দিয়ে গেছেন। নেতাজি যে গাড়ি থেকে সেখানে নেমেছেন সেটার চালক ছিলেন তিনি নিজে। তাহলে তিনি বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেলেন কীভাবে? নদীর তীরে নেমে যাওয়ার পর নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ভাগ্যে কী ঘটেছিল সে ব্যাপারে তিনি আর কিছুই জানেন না বলে জানান। নিজামুদ্দিন বলেন, তিনি নেতাজির সান্নিধ্য পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছেন। অজানা গন্তব্যের উদ্দেশে যাওয়ার আগে তিনি আবার স্বাধীন ভারতে ফেরার অঙ্গীকার করেছিলেন।

শুধু তাই নয়, নিজামুদ্দিন দাবি করেন- নেতাজির ঘনিষ্ঠ সহচর এস ভি স্বামীর সঙ্গেও তার বৈঠক হয়েছিল। স্বামী ছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। নিজামুদ্দিন তার দাবির স্বপক্ষে সে সময় তাকে দেওয়া প্রত্যাবাসন সনদ দেখান। আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকার এটিই একমাত্র প্রমাণ। কেবল নিজামুদ্দিনই নন, নেতাজিকে নিয়ে প্রকাশিত ভারতের নথিগুলোর মধ্যেও বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু না হওয়ার প্রমাণ মিলেছে বলে জানা গেছে। তবে এরপর তিনি কোন বেশে কী পরিচয়ে কোথায় তাঁর জীবন কাটিয়েছেন, সেটা আজও রহস্য।  এখনো নেতাজি সংক্রান্ত বেশ কিছু নথি প্রকাশের বাকি আছে। কে জানে হয়তো তখন এ সংক্রান্ত রহস্যের সমাধান মিললেও মিলতে পারে। অথবা এটি চিরকালের মতো ভারতবর্ষের সেরা অমীমাংসিত রহস্যগুলোর একটি হয়েই রয়ে যাবে।

 

কত্ত রকম ধারণা!

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই কিংবদন্তি নেতার মৃত্যুটা ঠিক কীভাবে হয়েছিল, তা আজও বিশ্ববাসীর কাছে অজানা। কেউই এ বিষয়ে স্পষ্টভাবে বলতে পারেননি। তাঁর এই রহস্যজনক মৃত্যু নিয়ে অনেকেই অনেক মত প্রকাশ করেছেন। ধারণা করা হয়, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৪৫ সালের ১৯ আগস্ট টোকিও যাওয়ার পথে, তাইওয়ানে এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন। তবে তাঁর মৃত্যুর সঠিক তারিখ ও স্থান সম্পর্কে এখনো বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। তাঁর দেহাবশেষ কোনো দিনও উদ্ধার করা যায়নি। একটি মতে, নেতাজি সোভিয়েত রাশিয়ার কাছে বন্দি অবস্থায় সাইবেরিয়াতে মৃত্যুবরণ করেন। এখানেও যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আর একটি মতে, বর্তমানে রেনকোজি মন্দিরে রাখা নেতাজির চিতাভস্ম পরীক্ষা করে জানা গেছে- ওই চিতাভস্ম নেতাজির নয়। আসলে ভারতবর্ষে নেতাজির তুমুল জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে একদল উঁচুতলার ভারতীয় নেতা এবং ইংরেজ সরকার মিলিতভাবে ষড়যন্ত্র করে নেতাজিকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়। তাই ভারতীয় সরকার কখনো নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর প্রকৃত মৃত্যুর কারণ জনসমক্ষে আনেনি। অনেকের মতে, ফোইজাবাদের ভগবানজি ওরফে গুনমানি বাবা হলেন নেতাজি। কিন্তু এ ব্যাপারটি আজও স্পষ্ট নয়।

সর্বশেষ খবর