মায়ের বাড়ি ভারতের তামিলনাড়ুতে
কমলা হ্যারিসের মা ছিলেন ভারতীয়। দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুতে তার বাড়ি। তার মায়ের নাম শ্যামলা গোপালন। অ্যান্ডোক্রিনোলজি নিয়ে গবেষণার জন্য তিনি পাড়ি দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে বার্কলির ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতে গবেষণা করতেন। প্রখ্যাত স্তন ক্যান্সার গবেষক ও বায়োমেডিকেল বিজ্ঞানী ছিলেন তিনি। বিখ্যাত ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলিতে পড়াশোনা করার জন্য ১৯ বছর বয়সে শ্যামলা ভারত ছেড়ে আসেন। পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হন। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সঙ্গে অর্থনীতির অধ্যাপক জ্যামাইকান-আমেরিকান ডোনাল্ড জে হ্যারিসের পরিচয়। সে সময় মানবাধিকার, ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী ও ভোটের অধিকার নিয়ে চলা আন্দোলনে তারা যুক্ত হন এবং এক সময় প্রেমে জড়িয়ে পড়েন। সেই বন্ধুত্ব প্রেম ও বিয়েতে গড়ায়। তাদের ঘরে আসে দুই মেয়ে। এক মেয়ের নাম কমলা। আরেক মেয়ের নাম মায়া। কমলার বয়স যখন সাত বছর তখন এ দম্পতির বিচ্ছেদ ঘটে। দুই মেয়েকে নিয়ে আলাদা হয়ে যান শ্যামলা। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের পর কমলা তার মায়ের সঙ্গে থাকতে শুরু করেন। এ সময়ও বাবার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তাদের। বাবা স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক। ছুটি কাটাতেও দুই মেয়ে বাবার কাছে ছুটে যেতেন। শৈশবে, কৈশোরে ভারতের চেন্নাইতে নানার বাড়িতে আসতেন কমলা। তার নানা পি ভি গোপালন ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী। উচ্চপদস্থ আমলার পদে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। কমলা নিয়মিত তামিলনাড়ুতে তার নানার বাড়িতে আসতেন। যে কারণে তার শৈশব গড়ে উঠেছিল মিশ্র সংস্কৃতিতে। কমলার মা শ্যামলা স্তন ক্যান্সার নিয়ে গবেষণার জন্য পৃথিবীর নানা দেশে ছুটতেন। তখন সঙ্গে নিয়ে যেতেন মেয়েদেরও। মায়ের কাজের জন্য কমলার ছাত্রী জীবনের একটা বড় অংশ কেটেছে কানাডার কুইবেক শহরে। কুইবেকে একটি হাসপাতালে গবেষণা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন কমলার মা। একবার কমলার বন্ধু মিমি সিলবার্ট বার্তা সংস্থা এপিকে বলেন, ‘কমলার ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ রোল মডেল এবং সেটা ছিল তার মা।’ কমলার ওপর তার মায়ের প্রভাব সবকিছু ছাপিয়ে যায়। কমলা তার স্মৃতিকথা ‘দ্য ট্রুথ উই হোল্ড : অ্যান আমেরিকান জার্নি’ বইয়ে লিখেছেন, ‘আমি শ্যামলা গোপালন হ্যারিসের মেয়ে, এ কথা বলার চেয়ে দুনিয়ায় আমার কাছে আর কোনো অধিক উপাধি বা সম্মানের কিছু নেই।’
ঘরে ভারতীয় খাবার হাতে মেহেদি
কমলা হ্যারিসের জন্ম ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ডে। এখন তার বয়স ৫৯। তার ছোট বোনের নাম মায়া লক্ষ্মী। মায়ের সঙ্গে কমলা ও মায়া থাকতেন ক্যালিফোর্নিয়ার অশ্বেতাঙ্গপ্রধান একটি এলাকায়। তাদের বন্ধুরা অনেকেই ছিলেন আফ্রিকান বংশোদ্ভূত। ভারতীয় খাবার খাওয়া থেকে হাতে মেহেদি লাগানো, সবই করতেন বন্ধুদের সঙ্গে মিলেমিশে। তার মায়ের ধর্মীয় আগ্রহ তাকে সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করেছে। কমলার জীবনীতে দেখা যায়, তারা দুই বোন গির্জায় উপাসনাসংগীতে অংশ নিতেন। আবার পাশাপাশি তারা নিয়মিত যেতেন মন্দিরেও।
রাজনীতিতে এসে বাজিমাত
কমলা হ্যারিস কুইবেকের ছাত্রী জীবনের পরে হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯৯০ সালে তিনি বার পাস করেন। আইনজীবী হিসেবেই তিনি ক্যারিয়ার গড়তে চেয়েছিলেন। এরপর তিনি আলমেডা কাউন্টি ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নির অফিসে ক্যারিয়ার শুরু করেন সানফ্রান্সিসকো ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নির অফিসে। ওকল্যান্ডে সহকারী ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে কমলা হ্যারিস দৃষ্টি দেন যৌন অপরাধের দিকে। ২০০৩ সালে তিনি সানফ্রান্সিসকোর ২৭তম ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি হিসেবে নির্বাচিত হন এবং ২০১১ সাল পর্যন্ত সেখানে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১০ সালে অল্প ভোটের ব্যবধানে তিনি ক্যালিফোর্নিয়াতে অ্যাটর্নি জেনারেল নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে আবার নির্বাচিত হন। ২০১৬ সালে প্রথম অশ্বেতাঙ্গ মহিলা সিনেটর হিসেবে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে নির্বাচিত হন কমলা। পরাজিত করেন লরেটা সানচেজকে। এর মধ্য দিয়ে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার তৃতীয় নারী সিনেটর হন। একই সঙ্গে তিনি আফ্রিকান-আমেরিকান নারী এবং প্রথম সাউথ এশিয়ান-আমেরিকান হিসেবে সিনেটে দায়িত্ব পালন করেন। সিনেটর হিসেবে তিনি স্বাস্থ্যসেবা খাতে সংস্কারকে সমর্থন করেন। অবৈধ অভিবাসীদের নাগরিকত্বের জন্য ড্রিম অ্যাক্টের পক্ষে অবস্থান নেন। অ্যাসল্ট রাইফেল নিষিদ্ধ করার পক্ষে ছিল তার অবস্থান। একই সঙ্গে প্রগতির পক্ষে ট্যাক্স সংস্কারের সমর্থক ছিলেন। এরপর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার জন্য ডেমোক্র্যাট দল থেকে প্রচারণা চালান। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি ফ্রন্টরানার হয়ে ওঠেন। যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে তাকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। অবশ্য পরে তিনি সরে দাঁড়ান। ডেমোক্র্যাটদের বিজয় ছিনিয়ে আনেন। জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হন এবং ইতিহাস গড়া কমলা হ্যারিস প্রথম নারী ও কৃষ্ণাঙ্গ যিনি মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। ২০২৪ সাল, এবার সে চিত্র উল্টে গেল। বয়স ও শারীরিক সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্নের মুখে জো বাইডেন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। নাম চলে আসে কমলা হ্যারিসের। বাইডেন নিজেই তার ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলাকে সমর্থন জানিয়েছেন। আর কমলার ওপর বাজি ধরে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ দিয়েছেন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির অর্থদাতারাও। এসব মিলিয়ে দলের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে কমলা হ্যারিস শক্ত অবস্থানে চলে আসেন। আর ডেলিগেটরাও একে একে তাকে সমর্থন জানানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া শুরু করেন। ডেলিগেটদের সমর্থন নিশ্চিত হওয়ার পর জোরালোভাবে নির্বাচনি প্রচার শুরু করেন কমলা হ্যারিস। তাকে নিয়ে বড় আশা দেখছেন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির চাঁদাদাতারাও যে কমলাকে নিয়ে আশাবাদী, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে নির্বাচনি প্রচার তহবিলে তাদের দেওয়া অর্থের পরিমাণ থেকে। বাইডেন সরে দাঁড়ানোর পর কমলার প্রচারশিবিরের জন্য ২৪ ঘণ্টায় ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার দিয়েছেন তারা। ৫৯ বছর বয়সি কমলা হ্যারিস নির্বাচনি লড়াইয়ে উতরে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হবেন তিনি।
ইউরোপেও বাড়ছে তার জনপ্রিয়তা
ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কমলা হ্যারিসের সম্ভাব্য প্রার্থিতা নিয়ে রীতিমতো সাড়া পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ভোটার এবং অ-মার্কিন স্থানীয়দের মধ্যে। ডেমোক্র্যাটস অ্যাব্রোড বা ডিএ’র মুখপাত্র অ্যামি পোর্টার একে ‘আশ্চর্যজনক ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। জনগণের বিপুল সাড়া মিলেছে কমলার পক্ষে। অ্যামি জানান, যে সংস্থা বিশ্বব্যাপী মার্কিন ‘ডেমোক্র্যাট পার্টির প্রতিনিধিত্ব করে, তারা পর্যবেক্ষণ করেছে, অসংখ্য নতুন ভোটার নিজের নাম নিবন্ধন করেছেন। অনেকেই প্রচারণায় সহায়তা করতে স্বেচ্ছাসেবী হতে চেয়েছেন।
ইতিহাসের পাতায় পাতায় হয়েছেন প্রথম
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ‘প্রথম’ অনেক ইতিহাসে নাম লিখিয়েছেন কমলা হ্যারিস। দেশটির প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে শপথ নিয়েছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, প্রথম অশ্বেতাঙ্গ ব্যক্তি যিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট হন। সে সময় থেকেই আলোচনা ছিল হয়তো একদিন নারী প্রেসিডেন্ট হবেন তিনি। এবার সে ইতিহাস লেখার পালা। কমলা হ্যারিসের বাবা-মা নাগরিক অধিকার আন্দোলনে বেশ সক্রিয় ছিলেন। সে সূত্রে রাজনীতির সঙ্গে শক্ত যোগাযোগ তৈরি হয় তার। রাজনীতিতে জড়ানোর আগে বর্ণাঢ্য শিক্ষাজীবন ও ক্যারিয়ার গড়েন তিনি। আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক শেষ করে সান ফ্রান্সিসকোতে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হেস্টিংস কলেজ অব ল-তে পড়তে যান। চার বছর পর ১৯৯০ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার আলামেডা কাউন্টিতে ডেপুটি ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ২০০৪ সালে সান ফ্রান্সিসকোর প্রথম নারী ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি হিসেবে শপথ নেন। এই পদে প্রথম নারী অশ্বেতাঙ্গ ব্যক্তি হিসেবে ইতিহাস গড়েন। তারপর আরেক ইতিহাস গড়ার পথে পা রাখেন ২০১১ সালে। সে বছর জানুয়ারিতে ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল পদে তাকে আসীন করা হয়। অ্যাটর্নি জেনারেল পদেও প্রথম নারী ও অশ্বেতাঙ্গ ব্যক্তি হিসেবে দেশটির ইতিহাসে কমলা হ্যারিসের নাম লেখা হয়। ২০২০ সালে ডেমোক্র্যাটদের বিজয়ের পর প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট হন তিনি। এবার তার সামনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হওয়ার সুযোগ। বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনি লড়াইয়ে জিতে সেই ইতিহাস গড়ার খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন তিনি।