রবিবার, ১০ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

ব্রাজিল নাকি আর্জেন্টিনা

তানিয়া তুষ্টি

ব্রাজিল নাকি আর্জেন্টিনা

দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ বিশ্বকাপ ফুটবল ম্যাচ। ১৪ জুন রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে পর্দা উঠতে যাচ্ছে এই ম্যাচের ২১তম আসরের। অপেক্ষা মাত্র কয়েক দিনের। এ মুহূর্তে বিশ্বকাপ জ্বরে কাঁপছে গোটা বিশ্ব। রাশিয়ার মাঠে খেলা হলেও বিশ্বের আনাচে-কানাচে গোলের উৎসবে মেতে উঠবে ভক্ত-সমর্থকরা। আর সেই বিশ্বকাপে একমাস বুঁদ হয়ে থাকার দিন চলে এসেছে। এমন একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় থাকছে আরও অনেক দল তবু ফুটবল প্রেমীদের বিবেচনার প্রধান আকর্ষণের বিষয় মেসি-নেইমারদের পায়ের কারুকাজ। ফুটবল ভক্তদের বেশির ভাগই এই দুই দলে বিভক্ত হয়ে গেছেন আগেভাগে। এবারের বিশ্বকাপ শিরোপা উঠবে কার ঘরে? প্রশ্ন এখন ব্রাজিল নাকি আর্জেন্টিনা? প্রিয় দুই দলের পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে শুরু ভক্তদের মাঝে চলছে আন্তঃপ্রতিদ্বন্দ্বিতা। ভক্তরা দলের সমর্থন প্রকাশ করছে পতাকা প্রদর্শন করে। আড্ডায় চলছে দলের সমর্থনে তর্ক-বিতর্ক। এক কথায় সব জায়গায় এখন বিশ্বকাপ নিয়ে সরগরম অবস্থা। তাহলে দেখে নেওয়া যাক দুই দলের অতীত ও বর্তমান ফিরিস্তি।

 

নেইমার বনাম মেসি

ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা দলের প্রধান দুই আকর্ষণ নেইমার ও মেসি। তাই স্বভাবতই দুই গ্রুপের ভক্তদের কাছে এই দুটি নাম আইকন। দুই সমর্থক গ্রুপের যত যুদ্ধ নেইমার ও মেসির নাম ধরে। অথচ বার্সেলোনায় দারুণভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছেন নেইমার মেসি জুটি। তবে বিশ্বকাপ ফুটবলে কিন্তু তারা প্রতিপক্ষ। মেসি যেহেতু বেশি সময় ধরে খেলছেন তাই পরিসংখ্যানের দিক থেকে মেসি এগিয়ে আছেন।

আর্জেন্টিনার হয়ে ১১৪ ম্যাচ খেলে ৫৬টি গোল করেছেন মেসি। এই বছরের গোড়ার দিকে গাব্রিয়েল বাতিস্তুতাকে ছাড়িয়ে আর্জেন্টিনার সর্বোচ্চ গোলদাতার রেকর্ড নিজের করে নিয়েছেন তিনি। অপরদিকে ব্রাজিলের হয়ে ৭৩ ম্যাচ খেলে ৪৯ গোল নিয়ে দেশটির চতুর্থ সর্বোচ্চ গোলদাতার আসনে আছেন নেইমার। সর্বোচ্চ গোলদাতা পেলের চেয়ে ২৮ গোল পিছিয়ে তিনি। এবারের বিশ্বকাপে যে মেসি নেইমার নিয়ে এত যুদ্ধ তারা কেউই এখন পর্যন্ত দেশের হয়ে সিনিয়র পর্যায়ে কোনো শিরোপা জেতেননি। তবে দুজনেই অলিম্পিক শিরোপা জিতেছেন। ২০০৮ সালে মেসি জিতেছেন আর নেইমার জিতেছেন চলতি বছর ব্রাজিলের অধিনায়ক হিসেবে। মেসি ২০০৫ সালে ফিফা অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ জেতেন।

আর্জেন্টিনার পক্ষে ৭ ম্যাচ খেলে ২০১২ সালে করা একটি হ্যাটট্রিকসহ ৪ গোল করেন মেসি। অন্যদিকে ব্রাজিলের পক্ষে ৮ ম্যাচে ২ গোল করেন নেইমার।

 

দুই দেশের দুই কোচের লড়াই

এদগার্দো বাউসা দায়িত্ব নেওয়ার পর আর্জেন্টিনা কেবল চারটি ম্যাচ খেলেছে, চারটিই বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে। ব্রাজিলের পক্ষে কোচ তিতের বেলায়ও ঠিক তাই। এখন পর্যন্ত খেলা চারটি করে ম্যাচে দুই কোচের অভিজ্ঞতা দুই রকমের। তিতে টানা চার ম্যাচে জয় পেয়েছেন। সেজন্য ব্রাজিলও আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ। উরুগুয়ের বিপক্ষে জয় দিয়ে শুরু করা বাউসার আর্জেন্টিনা ভেনেজুয়েলা ও পেরুর সঙ্গে ড্র করে আর প্যারাগুয়ের কাছে হেরে যায়। ক্লাবের অর্জনের দিক থেকে বাউসা একুয়েডরের লিগের দুটি শিরোপার সঙ্গে কোপা লিবের্তাদোরেসের দুটি শিরোপা জিতেছেন। এর সঙ্গে আছে লিগা দে কিতো, সান লরেন্সো আর রেকোপা সুদামেরিকানা। একমাত্র কোচ হিসেবে তিনি চারটি ভিন্ন ক্লাবকে কোপা লিবের্তাদোরেসের সেমি-ফাইনালে তোলার কৃতিত্ব দেখান।

তিতে করিন্থিয়ান্সের হয়ে দুটি ব্রাজিলিয়ান লিগ, একটি করে কোপা লিবের্তাদোরেস ও রেকোপা সুদামেরিকানা আর ক্লাব বিশ্বকাপ জেতেন। গ্রেমিওর হয়ে কোপা ব্রাজিল, ইন্তেরনাসিওনালের হয়ে কোপা সুদামেরিকানা এবং বেশ কয়েকটি ক্লাবের হয়ে ব্রাজিলিয়ান স্টেট চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন।

কোচিং ক্যারিয়ারে এর আগে বাউসা আর তিতে একবারই মুখোমুখি হন। এ বছরের সাও পাওলো স্টেট চ্যাম্পিয়নশিপে তিতের করিন্থিয়ান্স ২-০ গোলে বাউসার সাও পাওলোকে হারিয়েছিল।

পেলে ম্যারাডোনার বিপক্ষ ভূমিকা

আর্জেন্টিনার বিপক্ষে খেলা ১০ ম্যাচে ৮ গোল করেছেন পেলে, এর মধ্যে ১৯৬৩ সাল কোপা রোকায় ৫-২ ব্যবধানে জেতা ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেছিলেন তিনি। পেলে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে খেলা তার ১০ ম্যাচের চারটিতে জেতেন, দুটি ড্র করেন আর চারটিতে হারেন। বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা ব্রাজিলের মুখোমুখি হয়েছেন, তবে পেলে বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে কখনো খেলেননি।

 

আর্জেন্টিনার ১৯৯০ সালের জয়

সুযোগ তৈরির দিক থেকে ম্যাচটি ব্রাজিলই নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু ম্যারাডোনাকে তারা যেভাবে সামলেছিল তার জন্য অনেক সমালোচনাও শুনতে হয়েছে তাদের। ৮০তম মিনিটে গিয়ে ম্যারাডোনা মুক্ত হতে পেরেছিলেন, তিনটি চ্যালেঞ্জ এড়িয়ে ক্লাওদিও কানিজিয়াকে বল দিয়েছিলেন তিনি। আর্জেন্টিনাকে জেতাতে ম্যাচের একমাত্র গোলটি করেছিলেন কানিজিয়া। মুখোমুখি লড়াইয়ে আর্জেন্টিনা সবচেয়ে বড় ব্যবধানে জেতে ১৯৪০ সালে, ৬-১ গোলে।

 

ব্রাজিলের স্মরণীয় জয়

ব্রাজিলের সর্বোচ্চ ব্যবধানের জয়টি ১৯৪৫ সালে ৬-২ গোলে। তবে অনেকের মতে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ব্রাজিল তাদের সবচেয়ে স্মরণীয় জয়টি পেয়েছিল ১৯৮২ বিশ্বকাপ। বার্সেলোনায় ব্রাজিলের মুখোমুখি হওয়ার আগে ইতালির কাছে হেরে এসেছিল আর্জেন্টিনা। এ কারণে ম্যাচটি আর্জেন্টিনার জিততেই হতো। এদেরের নেওয়া ফ্রি-কিক ক্রসবারে লেগে ফিরে আসার পর বুটের টোকায় একাদশ মিনিটেই ব্রাজিলকে এগিয়ে দেন জিকো। দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝি ফালকাওয়ের ক্রস থেকে ব্যবধান দ্বিগুণ করেন সের্জিনিয়ো। এর ৯ মিনিট পর জিকোর অসাধারণ এক পাসে জুনিয়র স্কোরলাইন ৩-০ করেন। শেষ দিকে বিস্ময়কর এক শটে রামন দিয়াস আর্জেন্টিনার হারের ব্যবধানই কেবল কমাতে পারেন।

 

মুখোমুখি তারা

১৯১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১০৪ ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা। দুই পরাশক্তির লড়াইয়ে কখনই একে অন্যকে ছেড়ে কথা বলেনি কেউ। ১৯১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর নিজেদের প্রথম ম্যাচে ব্রাজিলকে ৩-১ গোলে হারায় আর্জেন্টিনা। কিন্তু মাত্র সাত দিন পরই নিজেদের পরিচয় দেয় সেলেকাওরা। ১-০ গোলের ব্যবধানে অ্যালবিসেলেস্তেদের বিপক্ষে নিজেদের প্রথম জয় তুলে নেন তারা। এখন পর্যন্ত ১০৪ বারের লড়াইয়ে ৩৮টিতে জয়ের দেখা পায় কেম্পেস-ম্যারাডোনা-মেসির আর্জেন্টিনা। বিপরীতে তাদের থেকে কিছুটা এগিয়ে ৪০ ম্যাচে জয়ের দেখা পেয়েছে পেলে-গারিঞ্চা-রোনাল্ডোর ব্রাজিল। দুই দলের মধ্যকার ২৬টি ম্যাচ ড্র হয়েছে। আর্জেন্টিনার ১৬০ গোলের বিপরীতে মাত্র ২ গোলে এগিয়ে ১৬২ বার জালের দেখা পেয়েছে ব্রাজিল।

প্রীতি ম্যাচে ৫৯ বারের দেখায় এগিয়ে আছে ব্রাজিল। সেলেকাওদের ২৪ জয়ের বিপরীতে ২০ জয় আছে অ্যালবিসেলেস্তেদের ঝুলিতে। এ ছাড়া বাকি ১৫ ম্যাচে কোনো ফল আসেনি। প্রীতি ম্যাচের মতো বিশ্বকাপের বাছাই পর্ব, বিশ্বকাপের মূল পর্ব এমনকি ফিফা কনফেডারেশন কাপেও এগিয়ে আছে ব্রাজিল। বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে এখন পর্যন্ত ৮ বার মুখোমুখি হয়েছে দুই দল। যেখানে ব্রাজিলের ৪ জয়ের বিপরীতে আর্জেন্টিনা জিতেছে ২টিতে, বাকি ২টি ম্যাচ ড্র হয়েছে।

 

তাহলে কে জিতবে এবারের শিরোপা

রাশিয়ায় ষষ্ঠ বিশ্বকাপ জয়ের লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নামছে ব্রাজিল। আর্জেন্টিনার জন্য তৃতীয় বিশ্বকাপ জয়ের মিশন হবে এটি। কিন্তু তাদের বিশ্বকাপ জয়ের সম্ভাবনা কতটুকু? উত্তর খুঁজেছে স্পোর্টস ডাটা কোম্পানি গ্রেসনোট। ১ মিলিয়ন মানুষের ভোটাভুটিতে গ্রেসনোটের কাছে জমা পড়েছে বিশ্বকাপের ফেবারিট দলের তালিকা। এ ফলাফলে সর্বোচ্চ ২১ শতাংশ ভোট পেয়েছে ব্রাজিল।  এ ২১ শতাংশ মানুষ মনে করেন ব্রাজিল রাশিয়া বিশ্বকাপের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট জিতবে।

১০ শতাংশ ভোট পেয়ে তালিকার দুইয়ে আছে ২০১০ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন স্পেন। বর্তমান চ্যাম্পিয়ন জার্মানি ও আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের সম্ভাবনা একই। ভোটাভুটিতে জার্মানি ও আর্জেন্টিনা ৮ শতাংশ ভোট পেয়েছে। এ ছাড়া ফ্রান্স ৬, কলম্বিয়া ৫, পেরু ৫ এবং ইংল্যান্ড, বেলজিয়াম ও পর্তুগাল ৪ শতাংশ করে ভোট পেয়েছে। এখন শুধু অপেক্ষার পালা।.

 

 

ষষ্ঠ শিরোপার দাবিদার হয়ে রাশিয়ায় বিশ্বকাপ শুরু করবে ব্রাজিল। তবে ব্রাজিলের লিজেন্ড পেলের মতে, সাফল্য পাওয়ার মতো দল এখনো হয়ে ওঠেনি সেলেকাওরা। পেলে বলেছেন, ‘তিতের সামর্থ্যে আমার পুরো আস্থা আছে। কিন্তু আমার দুশ্চিন্তা একটা ব্যাপার নিয়ে; বিশ্বকাপ শুরু হতে দেরি নেই এবং এখনো আমাদের সঠিক দলটি নেই। সব খেলোয়াড় খুব ভালো। কিন্তু আমরা একটি দল নই।’ তবে নেইমার ইনজুরি থেকে ফেরায় আশাবাদী হলেও বলেছেন, ‘নেইমার আমার কাছে বিশ্বের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়। এখন সে অনেক বেশি পরিণত। তার অনেক অভিজ্ঞতা। কিন্তু সে একাই জেতাতে পারবে না বিশ্বকাপ।’

 

— পেলে

 

রাশিয়া বিশ্বকাপে লিওনেল মেসির দল আর্জেন্টিনা অনেকের চোখেই এবারের অন্যতম ফেবারিট দল। কিন্তু আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি ডিয়াগো ম্যারাডোনার মতে, বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে আর্জেন্টিনা একটি ম্যাচও জিততে পারবে না। ম্যারাডোনা বলেন, ‘আমার অনেক সন্দেহ, অনেক। আমার মনে হয় প্রথম রাউন্ডেই তারা (আর্জেন্টিনা) বিদায় নেবে। প্রতিপক্ষ হিসেবে নাইজেরিয়া, আইসল্যান্ড এবং ক্রোয়েশিয়া অনেক কঠিন হবে।’ ম্যারাডোনার দাবি, কোচ সাম্পাওলির অধীন আর্জেন্টিনার এ দলটির কোনো কৌশলই নেই। তার ভাষায়, ‘এমন একটা দল, যাদের অভিজ্ঞতা নেই, কোনো নেতা নেই, কোনো পরিকল্পনা নেই। আমার মনে হচ্ছে আমরা সম্মান হারানোর ঝুঁকি নিচ্ছি।’

— ম্যারাডোনা

সর্বশেষ খবর