দেশে একসময় পাট উৎপাদনে বড় ভূমিকা রাখত লালমনিরহাটসহ উত্তরের জেলাগুলো। সোনালি আঁশখ্যাত এ ফসলটির আবাদ কমেছে উত্তরের জেলাগুলোতে। মাটির উর্বরতা পাট চাষের অনুকূলে থাকা সত্ত্বেও আবাদ কম হওয়ায় চিন্তিত সংশ্লিষ্টরা। কৃষকরা বলছেন, গত কয়েক বছরে আবহাওয়া পরিবর্তন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বৃষ্টিপাত কমে যাওয়া, পাট পচাতে পর্যাপ্ত পানির অভাব, ন্যায্য দাম না পাওয়া, সার, কীটনাশকের দাম নাগালের বাইরে যাওয়া এবং উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় পাট চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন এখানকার কৃষক। পাট পচাতে কৃষি অফিস যে রিবন রেটিং পদ্ধতির কথা বলছে, তা অনুসরণ করলে পাটের রং নষ্ট হয়ে যায় এবং বাজারে দাম কমে যায়।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আবহাওয়া প্রতিকূল হয়ে ওঠা ও পাট পচানোর জলাশয় ব্যাপক কমে গেছে এ জেলাগুলোয়। কৃষক সাধারণত পাট কেটে সরকারি অথবা ব্যক্তিমালিকানার বিভিন্ন পরিত্যক্ত জলাশয় বা ডোবায় পাট পচানোর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। তবে সারা দেশের মতো উত্তরের জেলাগুলোতে জলাশয় বা ডোবা ভরাট হয়ে গেছে। যেসব জলাশয় রয়েছে, সেগুলোয়ও পানি নেই। কোনো কোনো এলাকায় কেউ কেউ শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি উত্তোলন করে তা জলাশয়ে জমা করে পাট জাগ দিচ্ছেন। এতে খরচ বেশি হওয়ায় লাভের অঙ্ক কমে যাওয়ার শঙ্কায় অনেক কৃষক।
লালমনিরহাট জেলা পাট অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় চলতি বছর পাট চাষ হয়েছে ২১ হাজার হেক্টর জমিতে। তবে চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ২৯ হাজার হেক্টর। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৮ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ কমেছে। লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার চন্দনপাট গ্রামের কৃষক আমিনুর রহমান বলেন, ‘বিঘাপ্রতি গড়ে ১৩ হাজার টাকা করে খরচ হয়েছে। শ্যালো মেশিনে পানি দিয়ে পাট জাগ দিয়েছি। বিঘাপ্রতি গড়ে ৯-১০ মণ পাট পাওয়া যাচ্ছে। পুরো খরচ তুলতে হলে প্রতি মণ পাট আড়াই হাজার টাকার ওপরে বিক্রি করতে হবে। যদি পাটের দাম পড়ে যায় তাহলে লোকসান হবে।’
কালিগঞ্জ উপজেলার শিয়ালখোয়া গ্রামের কৃষক আবদুস সালাম বলেন, ‘তাপপ্রবাহে রোদ ও গরমের কারণে মাঠেই পাট নষ্ট হয়েছে। অনেকের জমিতে পাট বাড়েনি।’ লালমনিরহাটের পাট ব্যবসায়ী বদরউদ্দিন বলেন, ‘গত বছর থেকে পাট কেনা কমিয়ে দিয়েছি। কারণ গুদামে এখনো গত বছরের পাট পড়ে রয়েছে। এ বছরও মিলগুলোয় পাটের চাহিদা কম। দাম আবারও কমতে পারে। সেই আশঙ্কায় আপাতত পাট বিনছি না।’ জেলা মুখ্য পাট পরিদর্শক সোলায়মান আলী বলেন, ‘এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় পাট আবাদ কমেছে। তবে তা বাড়াতে কৃষককে সার ও বীজ বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে।’ আগামীতে আবাদ বাড়বে বলে আশা করেন তিনি।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র বলছে, জেলায় এ বছর ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও আবাদ হয়েছে ২৮ হাজার ৬৩০ হেক্টরে। গত বছর আবাদ হয় ১২ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে। পাট ফসলের জন্য সহনীয় তাপমাত্রা ১৮-৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অথচ প্রতি বছরই পাটা চাষের মৌসুমে রংপুরে তাপমাত্রা বিরাজ করে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর, সঙ্গে রয়েছে অনাবৃষ্টি। এতে পাট খেতে পোকার আক্রমণ দেখা দেয়। পোকা দমনের প্রায় সব ওষুধের দামও বিগত দুই বছরে বেড়েছে। মূলত এসব কারণে এ অঞ্চলে পাট চাষ কমেছে। লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ওমর ফারুক জানান, এ এলাকার মাটি পাট চাষের উপযোগী। একসময় রেকর্ড পরিমাণ পাট চাষ হতো। নদী, খাল-বিল ও জলাশয়ে পর্যাপ্ত পাওয়া যেত। কৃষক সেখানে পাট জাগ দিতেন। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। নদী, খাল-বিল ও জলাশয়ে পানি না থাকায় পাট পচাতে বেগ পেতে হয় কৃষকের। এ কারণে কৃষক পাট চাষ কমিয়ে দিয়েছেন। একই কথা বলেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা শাহা আলম। তিনি বলেন, ‘প্রকৃতির ওপর তো হাত নেই। অন্য উপায়ে যেমন শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি উত্তোলন করে পাট জাগ দেওয়া যায়। কিন্তু এতে কৃষকের খরচ আরও বেড়ে যাবে। প্রত্যাশিত দাম না পেলে তারা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।’