শুক্রবার, ৭ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

সৃষ্টির সেবা ও ইসলাম

মুফতি আমজাদ হোসাইন

সৃষ্টির সেবা ও ইসলাম

জাহালাত তথা মূর্খতার অন্ধকার বিদূরিত করার লক্ষ্যে রসুল (সা.) হিরাগুহায় প্রজ্বলিত করলেন ইসলামের মশাল। বিদূরিত হলো ক্রমে ক্রমে সমাজ থেকে জাহালাতের ঘোর অন্ধকার। এরই পাশাপাশি জুলুম-শোষণ উত্খাত করে সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রসুল (সা.) দ্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করলেন : মাকারিমে আখলাক তথা উন্নত চরিত্র মাধুরীর পূর্ণতা বিধানকল্পে আমি এ পৃথিবীতে প্রেরিত হয়েছি। পবিত্র কোরআনে এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে : ‘আপনি অবশ্যই মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত’ (সূরা কালাম : ০৪), আখলাকিয়্যাতের মধ্যে খিদমত তথা সৃষ্টির সেবার বিষয়টি অন্যতম।  কেননা মানুষের হৃদয় রাজ্য প্রভাবিত হয় একমাত্র আখলাক ও খিদমতের দ্বারা। তাই খিদমতের ব্যাপারটিকে ইসলামে বিশেষভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। বস্তুত খিদমত ও সেবা দুইভাবে করা যায়। এক. আত্মিক দুই. বৈষয়িক। বৈষয়িক সেবার তুলনায় আত্মিক সেবার বিষয়টি অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে কোরআনে আত্মিক সেবার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনের যে সূরাটি প্রত্যেক মুসলমান পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে পাঠ করে তা হচ্ছে সূরা ফাতিহা বা উম্মুল কোরআন। এতে মানুষকে আল্লাহর দরবারে সরল পথ কামনা করার তালিম দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘আমাদের সরল পথ প্রদর্শন করুন’, কাউকে হিদায়াতের পথে নিয়ে আসা লাল টকটকে সুন্দর ঘোড়া হাসিল করা হতেও উত্তম। এটি একটি মহান কাজ। যেমন : খায়বার যুদ্ধে রসুল (সা.) হজরত আলী (রা.)-কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, আল্লাহর কসম! তোমার দাওয়াতে আল্লাহ যদি একজন মানুষকেও হিদায়েত দান করেন তবে তা তোমার জন্য লোহিত বর্ণের (মূল্যবান) উটের মালিক হওয়া অপেক্ষাও উত্তম। (বুখারি শরিফ), আত্মিক খিদমতের পাশাপাশি বৈষয়িক খিদমতের প্রতি গুরুত্বারোপ করে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘পূর্ব ও পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফিরানোতে কোনো পুণ্যতা নেই, কিন্তু পুণ্যতা আছে কেউ আল্লাহ, পরকাল, ফিরিশতাগণ, সমস্ত কিতাব এবং নবীগণের ওপর ইমান আনয়ন করলে এবং আল্লাহর প্রেমে আত্মীয়স্বজন, পিতৃহীন অভাবগ্রস্ত, মুসাফির সাহায্য প্রার্থীগণকে এবং দাস মুক্তির জন্য অর্থ দান করলে, সালাত আদায় করলে ও জাকাত প্রদান করলে এবং প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা পূর্ণ করলে, অর্থ সংকটে দুঃখ ক্লেশে যখন দুঃখ আসে ধৈর্য ধারণ করলে। এরাই তারা যারা সত্যপরায়ণ এবং তারাই মুত্তাকি।’ (সূরা বাকারা : ১৭৭), অন্য আয়াতে এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হচ্ছে, ‘সে তো বন্ধুর গিরিপথ অবলম্বন করেনি, তুমি কি জান বন্ধুর গিরিপথ কি? তা হচ্ছে দাস মুক্তি অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে আহার্যদান, এতিম আত্মীয়কে অথবা দরিদ্র নিষ্পেষিত নিঃস্বকে। (সূরা বালাদ’১১-১৬), মানব সেবার গুরুত্ব প্রসঙ্গে রসুল (সা.) বলেন, ‘কওমের নেতা সফরের অবস্থায় তাদের খাদিম থাকবে। যে ব্যক্তি খিদমতের মাধ্যমে তাদের মধ্যে অগ্রগামী হবে কেউ তাকে আমলের  মাধ্যমে পেছনে ফেলতে পারবে না। (মিশকাত : ৩৪০), জনসেবা এবং খিদমতে খালকের মূর্ত প্রতীক ছিলেন মহানবী (সা.)। সেবার এ গুণটি তার মধ্যে নবুওয়াত প্রাপ্তির আগেও ছিল। প্রথম ওহিপ্রাপ্ত হয়ে তিনি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে এ ঘটনা একমাত্র জীবন সঙ্গিনী হজরত খাদিজাতুল কুবরা (রা.)-এর কাছে বর্ণনা করলেন, তখন তিনি নিম্নোক্ত বাণী দ্বারা সান্ত্বনা দিলেন। ‘বললেন আল্লাহর শপথ করে বলছি, আল্লাহ কখনো আপনাকে অপমান করবেন না। কেননা আপনি আত্মীয়ের প্রতি সদাচারণ করেন, অসহায় ব্যক্তির বোঝা উঠিয়ে দেন, নিঃস্ব ব্যক্তির অন্নবস্ত্রের ব্যবস্থা করেন। মেহমানদের আপ্যায়ন করেন এবং বিপদগ্রস্ত মানুষের প্রতি সহায়তা দান করেন। (বুখারি শরিফ), এ ছাড়া আরও অনেক শিক্ষণীয় ঘটনা হাদিসে বর্ণিত রয়েছে। যেমন রসুল (সা.) যে পথে চলাচল করতেন সে পথে এক বুড়ি রোজই কাঁটা বিছিয়ে রাখত। নবীজী তা সরিয়ে নিজের গন্তব্যের পথে চলে যেতেন। কিন্তু তিনি উক্ত বুড়ি মহিলাকে কিছুই বলতেন না। একবার রাস্তায় কাঁটা বিছানো না দেখে মনে মনে ভাবলেন, বুড়ি মহিলার হয়তো কিছু একটা হয়েছে। তাই তিনি বুড়ি মহিলার বাড়িতে গেলেন এবং দেখলেন যে বুড়ি মহিলাটি অসুস্থ। তিনি তার কাছে গেলেন এবং অসুস্থতার খোঁজখবর নিলেন। এমনকি তিনি তার ময়লা ঘরটিকে ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে দিলেন। তার অপরিষ্কার কাপড়গুলো ধুয়ে দিলেন। এমনি আরেকটি ঘটনা মক্কা বিজয়ের সময় ঘটেছিল। রসুল (সা.) যখন মক্কা বিজয়ের দিনে পবিত্র মাতৃভূমি মক্কা নগরীতে বিজয়ের বেশে প্রবেশ করছিলেন তখন এক বুড়ি মহিলা রসুল (সা.)-এর ভয়ে নিজের মালসামানের গাঠুরী মাথায় নিয়ে কোথাও পালিয়ে যাচ্ছিলেন। বোঝার ভারে বুড়ি মহিলাটি নুইয়ে পড়ছিল। পথ তার এগুচ্ছিল না। নবীজী বুড়ির এই করুণ অবস্থা দেখে বললেন, বোঝাটি আমার মাথায় দেন আমি আপনাকে গন্তব্য স্থানে পৌঁছে দেব।

বুড়ি বোঝাটি নবীজীর মাথায় তুলে দিলেন। নবীজী বোঝাটি গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে বললেন, আচ্ছা আমি এবার আসি। বুড়ি মহিলাটি বললেন, বাহ! পারিশ্রমিক নিবে না? দয়াল নবী বললেন, আমার পারিশ্রমিকের কোনোই প্রয়োজন নেই। তখন বুড়ি মহিলাটি বললেন, বাবা! দুনিয়াতে কি এমন মানুষ আছে? যে কাজ করার পর পারিশ্রমিক না নেয়? আচ্ছা বাবা বল তো তোমার পরিচয় কি? তখন রসুল (সা.) নিজের পরিচয় খুলে বললেন। বুড়ি মহিলাটি নবীজীর কথা শুনে মুগ্ধ হলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে কলেমা পড়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন। প্রিয় পাঠক! এ ধরনের হাজারও ঘটনা ইতিহাস ও হাদিসের কিতাবে লেখা রয়েছে। ইসলাম শুধু মানব জাতির প্রতি সেবাদানের বিষয়েই উদ্বুদ্ধ করে না। বরং তামাম জীবের প্রতি সেবা ও সহানুভূতি প্রদর্শনের ব্যাপারেও ইসলাম সব মানুষকে উদ্বুদ্ধ এবং অনুপ্রাণিত করে। বোঝা গেল ইসলাম শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম। ইসলাম নিজেকে ভালোবাসতে শিখায় এবং অন্যের ভালোবাসার তরে নিজেকে উদ্বুদ্ধ হতে শিখায়। এক কথায় ইসলাম সৃষ্টির সেবার প্রতি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে সৃষ্টির সেবা করার তৌফিক দান করুন।  আমিন।

লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও খতিব, বারিধারা, ঢাকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর