শনিবার, ৫ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

তিন বিপ্লবী মনীষীর কারাবাস

যতীন সরকার

তিন বিপ্লবী মনীষীর কারাবাস

‘মার্কসবাদ হচ্ছে একমাত্র তত্ত্ব যা সামাজিক স্ববিরোধিতা থেকে বেরিয়ে আসার একটা উপায় জানে।’— হাঙ্গেরির প্রখ্যাত মার্কসবাদী সৌন্দর্যতত্ত্ববিদ ও দার্শনিক গিওর্গি লুকাচের এই বক্তব্যের সঙ্গে আমি পরিচিত হয়েছিলাম বাংলাদেশের বিশিষ্ট মার্কসবাদী  চিন্তক প্রয়াত রণেশ দাশগুপ্তের লেখা পড়ে। মার্কসীয় তত্ত্বের যথাযথ অনুধাবনার মাধ্যমে সামাজিক স্ববিরোধিতা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় রণেশ দাশগুপ্তও জেনে গিয়েছিলেন এবং আমাদেরও সেই উপায় জানিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তার সব লেখাতেই এই দায়িত্ব-চেতনার পরিচয় বিধৃত হয়ে আছে। গিওর্গি লুকাচের মতোই রণেশ দাশগুপ্তও ‘মার্কসীয় সৌন্দর্যতত্ত্বের অফুরন্ত খনি’র সন্ধান পেয়েছিলেন।

বাংলাদেশে যারা এই খনির সন্ধান পেয়েছিলেন, এ রকম আর দুজন বিপ্লবী মনীষীর নাম এই মুহূর্তে একান্ত শ্রদ্ধাভরে আমি স্মরণ করছি— সত্যেন সেন ও সরদার ফজলুল করিম। সত্যেন সেন (১৯০৭-১৯৮১), রণেশ দাশগুপ্ত (১৯১২-১৯৯৭) আর সরদার ফজলুল করিম (১৯২৫-২০১৪)— এই তিনজনই মার্কসীয় তত্ত্বের খনি থেকে অনেক অনেক মণি-মাণিক্য আহরণ করে এনেছিলেন। অভিন্ন খনি থেকে আহূত তত্ত্বের ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা উদ্ঘাটনের লক্ষ্যেই এরা কলম হাতে তুলে নিয়েছিলেন। শুধু কলম নয়, এদের সমগ্র জীবনই নিয়োজিত হয়েছিল এই লক্ষ্যে।

এদের লক্ষ্যভ্রষ্ট করার জন্য শত্রুরা কম চেষ্টা করেনি। রাষ্ট্র ও সমাজের কর্তৃত্বশীল গোষ্ঠীর প্রায় সবাই ছিল এদের শত্রু। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানিদের শাসনামলে, এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রেও, এরা নানাভাবে নির্যাতিত হয়েছেন— কারাদণ্ড ভোগ করেছেন, আত্মগোপনে থেকেছেন, দেশান্তরে গমনেও বাধ্য হয়েছেন। তবুও কোনো বিপর্যয়ই এদের লক্ষ্যচ্যুত করতে পারেনি। বিশেষ করে কারাবাস তো বরং এদের সৃষ্টিশীলতার প্রবাহকে অনেক বেশি বেগবানই করে তুলেছে। এদের জীবনকথা পাঠ করে আমরা জেনেছি : সত্যেন সেনের চুয়াত্তর বছরের জীবনের বিশ বছরই কেটেছে কারাগারে; পঁচাশি বছর বয়সে যার জীবনাবসান ঘটে, সেই রণেশ দাশগুপ্ত কারাগারে কাটিয়েছেন তেরো বছর; আর জীবনমঞ্চে যার অধিবাস ছিল ঊননব্বই বছর, এগারো বছর ছিল সেই সরদার ফজলুল করিমের কারাজীবন।

কারাবাসকালে সৃজনশীলতার সবচেয়ে বেশি উৎসারণ ঘটিয়েছেন সত্যেন সেন। কৃষক নেতা, সংস্কৃতি-আন্দোলনের  সংগঠক ও বিশিষ্ট গণসংগীত-রচয়িতা রূপে যিনি পরিচিত ছিলেন, সেই সত্যেন সেনই লেখক (মূলত উপন্যাসকার) হন ষাটের দশকে কারাবাসকালে, দেশে যখন চলছে পাকিস্তানের জঙ্গি ‘দেশনায়ক’ আইয়ুব খানের জংলি শাসন। পরিহাসের সুরে তিনি বলতেন, ‘আমার সবচেয়ে বেশি উপকার করেছে সেই মানুষটি, যে মানুষটির হাতে দেশের সবচেয়ে বেশি অপকার হয়েছে।’

সত্যেন সেনের এই পরিহাসোক্তিটির তাৎপর্য ব্যাখ্যার আগে আরেকটা কথা বলে নিই। সে কথাটি হলো : গণশত্রুরা সত্যেন সেনের মতো মানুষদের কারান্তরালে অথবা দ্বীপান্তরে পাঠিয়ে দিয়ে তাদের ভিতরকার অনেক অজ্ঞতার অন্তরাল ঘুচিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেও সাহায্য করেছে। বলা যায়, অপকার করতে গিয়েই তাদের অনেক উপকার করে ফেলেছে। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকরা আন্দামান দ্বীপে নির্বাসনে পাঠিয়েছিল যাদের, সেই রাজদ্রোহীদের অনেকে নির্বাসিত জীবনেই সারা পৃথিবী থেকে সাম্রাজ্যবাদ-উৎসাদনের প্রকৃত পথের সন্ধান পেয়েছিলেন এবং সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার মন্ত্র লাভ করেছিলেন।

নির্বাসন থেকে মুক্তি লাভ করে জনগণের ভিতর সেই মন্ত্র ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তারা কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিলেন। মূলত এদের সনিষ্ঠ উদ্যোগেই এই উপমহাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠেছিল।

সত্যেন সেনের দ্বীপান্তর হয়নি। কমিউনিজমে তিনি দীক্ষা নিয়েছিলেন কারাবন্দী হয়ে। ব্রিটিশ আমলে প্রাক-কমিউনিস্ট জীবনে সত্যেন সেন ও তার দুজন সহযোগী পুলিশের হাতে ধরা পড়ার আগে খুলনার কমিউনিস্ট নেতা নারায়ণ ব্যানার্জির কাছে আশ্রয় চাইতে গিয়েছিলেন। কিন্তু কমরেড নারায়ণ ব্যানার্জি আশ্রয় না দিয়ে তাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যে তারা ভুল রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।

কমরেড ব্যানার্জি তাদের বলে দিয়েছিলেন, ‘তোমাদের অবিলম্বে ধরা পড়া দরকার। কিছুকাল জেলে আটকে থাকলে এই জঞ্জালগুলো থেকে মুক্ত হয়ে তোমরা পড়াশোনা করার ও সমস্ত দিক বিবেচনা করে সুস্থভাবে চিন্তা করার সুযোগ পাবে। এই  কারণেই শেল্টার জোগাড় করে দেওয়ার ব্যাপারে আমি তোমাদের সাহায্য করতে পারব না। তোমাদের ভালোর জন্যই এবং তোমাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই আমি তা করব না।’ তার এই কথাগুলো স্মরণ করে অনেক পরে আত্মস্মৃতিমূলক একটি রচনায় সত্যেন সেন লিখেছিলেন, ‘অবশেষে নারায়ণদার মনষ্কামনা পূর্ণ হলো— পরপর আমরা সবাই ধরা পড়ে গেলাম। নারায়ণদার ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল। বাইরের ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে জেলখানার অনুকূল  পরিবেশে পড়াশোনা করার ও সুস্থ মনে চিন্তা করার অবকাশ-সুযোগ পেলাম। তার মধ্য দিয়েই সমাজতন্ত্রবাদের সঙ্গে পরিচয় ঘটল, তাকে আদর্শ বলে গণ্য করলাম।’

সত্যেন সেনের নিজের উক্তি থেকেই আমরা জানলাম যে কারাবন্দী হয়েই সমাজতন্ত্রবাদ তথা মার্কসবাদের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে, একেই তিনি ‘আদর্শ’ বলে গণ্য করেন। যে আদর্শ তার জীবনভাবনা ও জীবনাচরণে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলে, জীবনমঞ্চ থেকে বিদায় নেওয়ার পূর্বক্ষণেও তিনি সেই আদর্শেরই অনুশীলন করে গেছেন। সত্যেন সেনের চেয়ে বয়সে পাঁচ বছরের ছোট রণেশ দাশগুপ্ত। কারাগারে গিয়ে তিনি মার্কসবাদী হননি, মার্কসবাদী রূপেই তিনি কারাবন্দী হন। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে বাংলা ভাষার পক্ষে প্রচার করতে গিয়ে রণেশ দাশগুপ্ত অন্য কয়েকজনের সঙ্গে গ্রেফতার হয়ে জেলে যান এবং অল্প কয়েক দিন পরই মুক্ত হয়ে কমিউনিস্ট পার্টির পুনর্গঠনে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন। এ সময়েই ৩০ জুন ঢাকার করোনেশন পার্কে পার্টি-সভায় বক্তৃতাদানের অপরাধে (!) ৭ জুলাই  গ্রেফতার হয়ে কারাগারে কাটান ৭ বছর ৮ মাস, মুক্তি পান ১৯৫৫ সালের অক্টোবরে। আবার ’৬২ সালে সামরিক আদেশবলে কারাবন্দী হয়ে মুক্তি পান ’৬৩ সালে। এরপর তাকে কারাগারে আটকে থাকতে হয় ’৬৫ থেকে ’৬৮ পর্যন্ত।

কয়েক পর্যায়ে দীর্ঘ কারাবাসকালে চিন্তায়-চেতনায় তিনি নিজেকে যেমন সমৃদ্ধ করেছেন ও সৃষ্টিশীলতার উৎসারণ ঘটিয়েছেন, তেমনই সহবন্দীদেরও সমৃদ্ধ করে তুলেছেন এবং অনেকের ভিতর সৃষ্টিশীলতার উৎসারণ ঘটানোয় অনুঘটকের দায়িত্বও পালন করেছেন।

১৯৪৮-৪৯ সালের দিকে উপমহাদেশের কমিউনিস্ট তথা বামপন্থিরা উগ্র বামপন্থার অনুসারী হয়ে পড়েছিল। একান্ত ‘খণ্ডিত’ হলেও উনিশ  শতকের বাংলায় যে রেনেসাঁসের মতো একটা ব্যাপার সংঘটিত হয়েছিল, সেই ঐতিহাসিক সত্যকে কোনোমতেই অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু তেমন অস্বীকৃতিই জানিয়ে বসেছিল বিশ শতকের চল্লিশ দশকের বাংলার বামপন্থিদের প্রধান অংশটি। রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ— এ রকম সব মনীষীর মনীষা ও সদর্থক অবদানের অবমূল্যায়নে তারা উঠেপড়ে লেগেছিল। অথচ রণেশ দাশগুপ্ত সে সময়েই তার বামপন্থি সহবন্দীদের চিন্তার জ্যাড্যমুক্তি ঘটাতে ও তাদের প্রায় সবাইকেই রবীন্দ্র-অনুরাগী করে তুলতে সক্ষম হন এবং সবাইকেই নিয়ে কারাগারেই রবীন্দ্রজয়ন্তী উদ্যাপন করেন। সে সময়কার কারাবাসের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে মৃদু পরিহাসের সঙ্গে তিনি লিখেছিলেন, ‘১৯৪৮ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত আমি জেলে। কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীকে বাইরে রাখা হবে না বলে জেলে রাখা হলো। শুধু কমিউনিস্ট নয়, যারা যুব-ছাত্র আন্দোলন করছে, আওয়ামী লীগ করছে, তাদেরও রাতারাতি জেলে ভরা হলো।’

তাদের যারা জেলে ভরেছিল, কাজটা তারা খুব একটা খারাপ করেনি বলেই আমি মনে করি! কারণ বাইরে যারা এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, তাদেরই একত্র সম্মিলিত হওয়ার সুযোগটা করে দিয়েছিল তারা— অর্থাৎ যারা ছিল তখনকার ‘পাকিস্তান’ নামক জঘন্য রাষ্ট্রটির মাথামোটা শাসকগোষ্ঠী ও তাদের সহযোগী! ওদের জানা ছিল না যে, একত্র সম্মিলিত করা হয়েছিল যে মানুষগুলোকে, সেই মানুষগুলো কারাগারে অবস্থান করেই মানবমুক্তির পাঠ গ্রহণ করবে এবং সেই পাঠদানের জন্য কারাগারেই আছেন রণেশ দাশগুপ্তের মতো শিক্ষক। শুধু শিক্ষক নন, একাধারে তিনি তাদের ‘ফ্রেন্ড, ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড’।

এ সম্পর্কে সৌমিত্র শেখর লিখেছেন,

‘বিনাবিচারে নানা জেলে দীর্ঘসময় আটক থাকাকালে রণেশ দাশগুপ্ত রাজবন্দীদের শিরোমণিতে পরিণত হন। এ সময়ে কখনো তিনি বন্দীদের নিয়ে আন্দোলন করেছেন, কখনো তাদের শিক্ষা দিয়েছেন বিশ্বসাহিত্য, রাজনীতি বা সংস্কৃতির রূপান্তর প্রসঙ্গ। এ সময়ে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে আন্দোলন দানা বাঁধে, যার সফল পরিণতি পায় ১৯৫২ সালে। এ আন্দোলন-সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে যশোর ও রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন জেল থেকে বদলি হয়ে রণেশ দাশগুপ্তের ঠাঁই হয় ঢাকা জেলে।

১৯৫৩ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা-আন্দোলনের প্রথম বার্ষিকীতে জেলখানাতেই অভিনয় করার উপযোগী একটি নাটক লেখার জন্য রণেশ দাশগুপ্ত অনুরোধ করেন আরেক বন্দী মুনীর চৌধুরীকে। রণেশ দাশগুপ্তের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতেই রচিত এবং জেলখানাতে অভিনীত হয় মুনীর চৌধুরীর বিখ্যাত নাটক ‘কবর’। জেলখানাতে অবস্থানকালেই রণেশ দাশগুপ্ত উর্দুভাষা ভালোভাবে শিখে ফেলেন। এর ফলে উর্দু কবিদের কবিতা অনুবাদের ক্ষেত্রে তিনি দক্ষতার পরিচয় দেন।’

[রণেশ দাশগুপ্ত রচনাবলি প্রথম খণ্ড (ঢাকা-২০১২) ভূমিকা অংশ দ্রষ্টব্য]

আর সরদার ফজলুল করিম? রণেশ দাশগুপ্ত ও সত্যেন সেনের তুলনায় তার কারাজীবনের পরিধি  যদিও অনেক কম, তবু গুরুত্বের বিচারে কম নয় মোটেই। বর্ণাঢ্যতার দিক দিয়ে কিছুটা বেশি বরং।

বিগত শতকের চল্লিশের দশকেই সরদার ফজলুল করিম মার্কসবাদের সঙ্গে পরিচিত হন এবং জীবনভর এই মার্কসবাদকেই তার জীবনদর্শন রূপে দৃঢ়তার সঙ্গে ধরে রাখেন। কারাবাস তথা কারাযন্ত্রণা ভোগের ভিতর দিয়ে সেই জীবনদর্শনে তার আস্থা যে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়ে উঠেছে, বিভিন্ন জনের সঙ্গে তার আলাপচারিতায় ও কিছু কিছু লেখায় তারই পরিচয় পাই। বিশেষ করে ২০১০ সালে ঢাকার ‘জাতীয় প্রকাশনী’ থেকে কাফি রতনের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘অনশনে আত্মদান’ বইটির চারটি প্রবন্ধে সরদার ফজলুল করিম তার ‘কারাজীবনের বিভিন্ন অধ্যায় বর্ণনা করেছেন’ এবং ‘কারা অভ্যন্তরে কমিউনিস্ট রাজবন্দীদের ওপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নৃশংসতা তুলে ধরেছেন।’ তার ‘অনশনে আত্মদান’ শীর্ষক প্রবন্ধের সর্বশেষ বাক্যটি হলো— ‘৪৭-এর পরে পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলার সব জেলের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক বন্দীরা যে অসহনীয় অত্যাচার ভোগের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করেছে এবং প্রাণান্তকর যে প্রয়াস দ্বারা নিজেদের রাজনৈতিক চেতনা এবং মনোবলকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছে, সে কাহিনী পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসের এক মহৎ অনুপ্রেরণার কাহিনী।’

কিন্তু প্রশ্ন : সেই মহৎ অনুপ্রেরণায় কি আমরা প্রাণিত হয়েছি? ইতিহাসের উত্তরাধিকার বহনের দায় কি আমরা বহন করেছি? সরদার ফজলুল করিমের মতো মহৎ বিপ্লবীদের স্মৃতি কি বিস্মৃত হয়ে যাইনি আমরা?

প্রশ্নগুলোর উত্তরে ‘না’ কথাটি উচ্চারণ না করে পারা যাবে না যেমন, তেমনই ‘হ্যাঁ’ বলতে পারার মতো অবস্থা সৃষ্টি করার দায়িত্বও আমরা অস্বীকার করতে পারব না। সেই দায়িত্ব পালনের জন্য প্রথমেই জেনে বুঝে নিতে হবে সেই তত্ত্বটিকে, যে তত্ত্বের প্রকৃষ্ট অনুশীলনের মাধ্যমে সরদারের মতো বিপ্লবী মনীষীরা কারাভ্যন্তরে ‘অসহনীয় অত্যাচারের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করে’ ও ‘নিজেদের রাজনৈতিক চেতনা ও মনোবলকে’ অক্ষুণ্ন রাখতে পেরেছেন। সেই তত্ত্বটিই ‘দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ’, সাধারণ পরিচয় যার ‘মার্কসবাদ’ নামে। মার্কসবাদের জীবনসুধা আকণ্ঠ পান করেছিলেন বলেই বরিশালের ‘কৃষকের পোলা’ সরদার ফজলুল করিমকে ‘মানবজমিন রইলো পতিত’ বলে হাহাকার করতে হয়নি; মেরুদণ্ড সোজা ও মাথা উঁচু করে রেখে জীবনের সব ক্ষেত্রেই চাষবাস করে সোনা ফলিয়ে যেতে পেরেছেন তিনি; পেরেছেন কারাজীবনকেও ফলপ্রসূ কর্মজীবনে পরিণত করে তুলতে।

কারাবন্দী থাকাকালেই তিনি যে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, সে বিষয়টি সম্পর্কে তার আত্মকথন : ‘পাকিস্তানের গণপরিষদে আমার নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারটা আমার নিজের নিকট যতটা অপরিচিত এবং তাৎপর্যহীন বলে বোধ হোক না কেন, বাইরের জগতে বিভিন্ন মহলে এটি বেশ তাৎপর্যময় বলে চিহ্নিত হতে লাগল। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন বিজয়টাকেই সেদিন মার্কিন মহল আতঙ্কের চোখে দেখেছিল। পাকিস্তানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত সমগ্র পূর্ববঙ্গ কমিউনিস্টকবলিত বলে শোরগোল তুলেছিল এবং এ কে ফজলুল হক সাহেবকে তার কলকাতায় প্রদত্ত কিছু আবেগমিশ্রিত উক্তির ভিত্তিতে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ বলে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করেছিল এবং সে অজুহাতেই ইসকান্দার মির্জা হক সাহেবকে গৃহবন্দী পর্যন্ত করেছিলেন। তারা একে কমিউনিস্ট বিজয় বলে চিহ্নিত করে পাকিস্তান সরকারকে জবাবদিহি করেছিল। কিন্তু উচ্চতর রাজনীতির এসব কথা আমার মতো গোবেচারীর পক্ষে অনুধাবন করা সহজ ছিল না। আমার সঙ্গে এসব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার যোগাযোগটি পরবর্তীকালে বোঝা গিয়েছিল।’

‘অনশনে আত্মদান’ পৃষ্ঠা-৬০

’৫৮ সালে পাকিস্তানে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারি হলে সরদার আবার গ্রেফতার হন এবং জেলে থাকেন ’৫৮-এর শেষ দিক থেকে ’৬২-এর ডিসেম্বর মাসের শেষ পর্যন্ত। এর আগের বছর, ’৫৭ সালে তিনি বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করেন। শান্তনু মজুমদারের সঙ্গে কথোপকথনে তিনি জানান, ‘বাষট্টির ডিসেম্বরে আমি পারিবারিক ব্যবস্থাপনায় জেল থেকে বেরিয়ে আসি।... জেলে আসার সময় ছয় মাস বয়সের একটা বাচ্চা রেখে এসেছি। আমার ওয়াইফ একজন শিক্ষক। তার কান্নাকাটি আমাকে স্পর্শ করে। এমন একটা অবস্থায়, আমার মধ্যে যে বোধটা বেড়ে ওঠে তা হলো আমার পরিবারের পাশে দাঁড়ানো উচিত। এই বোধ থেকেই আমি বন্ড দিয়ে বেরিয়ে আসতে রাজি হই। তা না হলে কারও পক্ষে আমাকে বন্ড দিয়ে বেরিয়ে আসায় রাজি করানো সম্ভব ছিল না।...

জেল থেকে বেরিয়ে আমি আর রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত থাকলাম না। আবার একেবারে যে নিষ্ক্রিয় থাকলাম তাও নয়। আমি পর্যবেক্ষকের ভূমিকা নিলাম। কিন্তু তাই বলে আমাকে যারা ভালোবাসতেন যারা আমার আদর্শ ছিলেন তারা আমার উপর থেকে ভালোবাসা প্রত্যাহার করে নিলেন না। আমাকে ঘৃণা করতে শুরু করলেন না। শত্রু মনে করলেন না। আমি তখন পরিবারটিকে টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে এমনকি ল কলেজেও ভর্তি হলাম। পরে তেষট্টির ডিসেম্বর মাসে বাংলা একাডেমিতে যোগদান করলাম।’

‘জীবন জয়ী হবে’ (ঢাকা-২০০৪) পৃষ্ঠা-৫৮

কিন্তু বাংলা একাডেমিতে কর্মরত হয়েও তিনি যে মুক্ত জীবনযাপন করতে পেরেছিলেন, তেমন কথা বলা যাবে না। পাকিস্তানের গণবিরোধী শাসকরা তাকে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখেন এবং তার গতিবিধি ঢাকা শহরের বিশেষ এলাকায় সীমিত করে দেন। অর্থাৎ জেলের বাইরে এসেও এক ধরনের বন্দীদশাতেই তাকে কাটাতে হয়েছে।

তবু এ রকম বন্দীদশায়ও অনেক কৌশলে (অথচ নীতি থেকে একচুলও বিচ্যুত না হয়ে) তিনি তার আদর্শিক কর্মপ্রবাহকে অব্যাহত রেখেছেন। এ অবস্থাতেই এ দেশে যখন রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা-সংগ্রাম শুরু হলো, তখন সেই একাত্তর সালে, আবার তাকে কারাগারে যেতে হলো।

এরপর স্বাধীন বাংলাদেশে তার তেতাল্লিশ বছরের জীবন। ১৯১৪ সালের ১৫ জুন ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি জীবনমঞ্চ থেকে বিদায় গ্রহণ করেন। তার বর্ণাঢ্য জীবন সম্পর্কে  অনেক কথাই বলার আছে, অনেক কথা বলার আছে সত্যেন সেন ও রণেশ দাশগুপ্ত সম্পর্কেও, অনেকেই বলেছেনও। আমি এই লেখায় এই তিন বিপ্লবী মনীষীর কারাজীবন সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের মানুষদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলাম মাত্র।

     লেখক : শিক্ষাবিদ।

সর্বশেষ খবর