বৈশিষ্ট্যের আড়ালে একক সত্তা হিসেবে নিজেকে নিয়ে আগে চিন্তা করে থাকে। আর সেই সূত্র ধরে একজন আদিম মানুষের চাষযোগ্য জমি আরেকজনের থেকে আলাদা করার আবশ্যকতা দেখা দেয়। তখন সীমানা হিসেবে আইলের প্রবর্তন হয়। অনেক গবেষক ও বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই ‘আইল’ হলো মানচিত্রের আদি ভিত্তি। অবশ্য এর স্বপক্ষে কিছুটা তথ্য মিলেছে, তা হলো প্রায় চার হাজার বছর আগে প্রাচীন মিসরের চাষি কর্তৃক কাদামাটি দিয়ে তৈরি জমির আইল। আমরা যাকে মানচিত্র বলি, ইংরেজিতে তাকে ম্যাপ বলে, যা তো তুমি জানো। আর ম্যাপ শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ম্যাপপা থেকে; এর অর্থ হলো রুমাল বা ছোট ধরনের কাপড়। এই রুমাল বা ছোট কাপড়ে ছোট ছোট কিছু নকশা আঁকা হতো বিধায় এ ধরনের নামকরণ করা হয়েছে বলে প্রতীয়মাণ হয়। এদিকে বাংলা ভাষায় মানচিত্রের মানে হলো ভূ-চিত্রাবলি, যাতে জায়গা, অঞ্চল, দেশ, প্রভৃতি অবস্থানের আয়তনজ্ঞাপক নকশা। আগেই বলেছি, ম্যাপ বা মানচিত্রের আদি ভিত্তি হলো জমির আইল। এর পর কালের বিবর্তনের সরণি ধরে বর্তমানের মানচিত্রের পর্যায়ে এসেছে। আর একটা কথা মানচিত্রের ওপর নির্ভরশীল প্রাচীনকাল থেকেই ছিল। তখন অবশ্য এ কাজে সাহায্য নেওয়া হতো আকাশের তারার। যত দূর সন্ধানে জানা গেছে মিসরের মতোই মানচিত্র তৈরি হয়েছে অন্যতম প্রাচীন সভ্যতার জায়গা ব্যাবিলনে। আর ব্যাবিলনের ৩২০ কিলোমিটার উত্তরে গা-সুর শহরে মাটির তৈরি মানচিত্র পাওয়া গেছে, যার বয়স আনুমানিক চার হাজার তিন শ বছর। আর এই মানচিত্রের চারদিকের অবস্থান ছাড়াও দুটি নদী এবং দুটি পর্বতের মাঝে একটি শহর পরিলক্ষিত হয়েছে। এদিকে সরেজমিন তথ্যাদি সংগ্রহ করে মানচিত্র তৈরির আলামত পাওয়া গেছে প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যে। এই রোমান সাম্রাজ্যে সরেজমিন জরিপ করে মানচিত্র তৈরির বিষয় মাইলফলক বললে অত্যুক্তি হবে না। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য, রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের আমলে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। আর এই উদ্যোগের আওতায় রীতিমতো প্রশিক্ষণ দিয়ে একদল লোক নিয়োগ করা হয়, যাদের এগ্রিমেন্সোর বলা হতো। এরা সারা সাম্রাজ্যে ঘুরে ঘুরে মাপজোঁক করে মানচিত্র তৈরির কাজ শুরু করে। এদিকে প্রাচীন গ্রিসেও মানচিত্রের প্রচলন ছিল। গ্রিসের মিলেটাস দ্বীপের দার্শনিক অ্যানাকসিম্যান্ড (খ্রিস্ট পূর্ব ৬১০-৫৪৬) যে মানচিত্র এঁকেছিলেন, তাতে পৃথিবী গোল দেখানো হয়েছে। আর এর চারদিকে সমুদ্রে ঘেরা এবং এর মাঝখানে ইজিয়ান সাগরের তীরে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের অংশ বিশেষ হিসেবে তিনটি মহাদেশ সংযোজিত করা হয়েছে। এতদ্ব্যতীত গ্রিক পণ্ডিত ইরাটোস্থেনিস যে উন্নত মানের মানচিত্র এঁকেছিলেন, তাতে আলেকজান্ডারের অভিযানের আওতায় কিছু দেশসহ এশিয়া সন্বিবেশন করা হয়। অবশ্য, এখানে এশিয়াকে বড় ও চওড়া দেখানো হয়। আর তিনিই সর্বপ্রথম দক্ষিণ ও উত্তরের দূরত্বের সঠিক হিসাব প্রণয়ন করতে সমর্থ হন। এক্ষেত্রে পণ্ডিত হিপারকাসের পরামর্শ প্রণিধানযোগ্য। তিনি উল্লেখ করেন, সমগ্র পৃথিবীর মানচিত্রকে উত্তরে-দক্ষিণে এবং পূর্বে-পশ্চিমে সমান্তরাল করে কতগুলো রেখা অঙ্কন করা আবশ্যক। কেননা এই কাল্পনিক রেখা যথাযথভাবে বসাতে পারলে সময়ের আবর্তে সর্বখানের অবস্থান নির্ণয় করা সহজতর হবে। আর হিপারকাসের সেই যুগান্তরকারী পরামর্শ মোতাবেক যে কাল্পনিক রেখা অঙ্কন করা হয়েছিল সেটাই হলো উত্তর-দক্ষিণে এবং পূর্বে পশ্চিমের টানা লাইন যথাক্রমে অক্ষাংশ এবং দ্রাঘিমাংশ বলে অভিহিত। প্রাচীনকাল থেকেই মানচিত্র নিয়ে ঘষামাজা কম হয়নি। কালের পরিক্রমায় দ্বিতীয় শতাব্দী এসে যায়। প্রখ্যাত জোতির্বিজ্ঞানী টলেমিও উক্ত পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন। আমেরিকা আবিষ্কারের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত টলেমি রচিত মানচিত্রই ছিল সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য। মজার ব্যাপার হলো কলম্বাস কর্তৃক আমেরিকা আবিষ্কারের পর এই মহাদেশে যখন অন্তর্ভুক্ত করা হয়; তখন বিশ্ব মানচিত্র পাল্টাতে হয়। এরপর শতাব্দীর পর শতাব্দী চলে যায়। মানচিত্রের পরিবর্তন অব্যাহত থাকে। এর মধ্যে ১৫৭০ সালে আব্রাহাম ওটেলিয়াস ভূপৃষ্ঠের বিশাল তথ্য সমৃদ্ধ এক মানচিত্র প্রকাশ করেন। তথাপিও আধুনিক মানচিত্রের জনক বলে যিনি খ্যাতি অর্জন করেছেন তিনি হলেন- গেরাডাস মারক্যাটর। তিনিই সর্বপ্রথম একটি ভূ-গোলক তৈরি করেছিলেন, যার মধ্যে সব অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ রেখা অঙ্কিত ছিল। এই ভূ-গোলক থেকেই চতল মানচিত্র তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল এবং যেখানে কম্পাসের সাহায্যে দূরবর্তী দুটো স্থানের সঠিক অবস্থান ও দূরত্ব নির্ণয় করা সহজতর হয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক