চাকরিরতদের জন্য হঠাৎ পাওয়া এক দিনের ছুটি অনেক বড় কিছু। আর সেই ছুটি যদি সাপ্তাহিক ও নির্ধারিত সরকারি ছুটির সঙ্গে মিলিয়ে চার দিনে পরিণত হয়, তখন তার আবেদন হয় ভিন্ন মাত্রার। তেমনি এক ভিন্ন মাত্রার ছুটি এসেছিল অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে দুর্গাপূজাকে উপলক্ষ করে। আর সুযোগ পেয়েই ভাবলাম ময়মনসিংহের এক গ্রাম্য এলাকায় কাটাব ছুটির এই কটা দিন। ১০ অক্টোবর বৃহস্পতিবার খুব সকালে মহাখালী বাস টার্মিনালের দিকে গিয়ে প্রথমেই অবাক হওয়ার পালা। আগে মহাখালী রেলক্রসিং থেকে বাস টার্মিনাল পর্যন্ত পৌঁছতে রাস্তায় ও ফুটপাতে দাঁড়ানো এনা পরিবহনের কয়েক ডজন বাসের সাক্ষাৎ মিলত। এ সড়কটি এবং বাস টার্মিনালের সামনের অংশ অলিখিতভাবে এনা পরিবহনের নিজস্ব বাস টার্মিনাল ও বাস রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। তবে এদিন সকালে এনা নয়, দেখলাম ইউনাইটেড পরিবহনের বাসের বহর। নিকট অতীতে এনা পরিবহনের বাসগুলোর দীর্ঘ সারির নেপথ্যে ছিলেন ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতিও ছিলেন। তার বাস বহরের মালিক হওয়া নিয়ে বহু ঘটনা ও রটনা রয়েছে। একটি বাস নিয়ে যাত্রা করে আজ তিনি কয়টি বাসের মালিক হয়েছেন- এ নিয়ে তর্কও ছিল। কেউ কেউ বলেন, তিনি শতাধিক বাসের মালিক, আবার কারও মতে তার নিজের নামে এত বাস নেই। অন্যের মালিকানাধীন বাস রহস্যময় কারণে তার নামে চলত।
২০২১ সালেই দুর্নীতি দমন কমিশন এনায়েত উল্লাহ ও তার ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের সম্পদের হিসাব চেয়েছিল। তার পরের গল্পটা পাওয়া যায় ২০২৪ সালের ১৭ আগস্টে প্রকাশিত দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকায়। এই পত্রিকা মতে, ‘ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও এনা পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খন্দকার এনায়েত উল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তার নেতৃত্বে ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী ১৫ হাজার বাস থেকে দৈনিক ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করা হতো। এভাবে বছরের পর বছর ধরে চাঁদা আদায় করে নামে-বেনামে শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন সড়ক পরিবহন খাতের এই নেতা’। অন্যদিকে এ বছর ৬ সেপ্টেম্বর দৈনিক দেশ রূপান্তর লিখেছে, ‘এনায়েতের অনুমতি ছাড়া সড়কে নতুন কোনো বাস নামাতে পারত না কেউ। নতুন বাস নামানোর অনুমোদনের নামে লাখ লাখ টাকা ঘুষ নিতেন খন্দকার এনায়েত উল্লাহ’।
২০২১ সালে দুদক ২১ দিনের মধ্যে তার ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদের হিসাব বা বিবরণ জমা দেওয়ার আদেশ দেন। যথারীতি সেই বিবরণ জমাও হয়। যাচাইবাছাইয়ের আড়াই বছর পর দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তার বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করেন। এরপর দুদকের সব কার্যক্রম এনা পরিবহনে করেই যেন দূরদেশে চলে যায়। পরবর্তীতে দেশের পদ পরিবর্তন ও খোদ খন্দকার এনায়েত উল্লাহ নিজেই দূরদেশে চলে যাওয়ার বাস্তবতায় মহাখালী থেকে উধাও হয়ে যায় এনা পরিবহনের বাস। শুরু হয় ইউনাইটেড পরিবহন পর্ব।
বহু পরিবহন মালিক শ্রমিক ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর আক্রোশ ছিল এই পরিবহন নেতার ওপর। বিরোধী দল হরতাল ডাকলে তার কথায় সবাই বাস চালাতে বাধ্য হতো। এমনকি জীবনের ঝুঁকি নিয়েও অনেক সময় বাস চালিয়েছেন পরিবহন শ্রমিকরা। বিরোধী দল ঢাকা অভিমুখী হলেই তারা সব বাস বন্ধ করতে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের বাধ্য করত।
ময়মনসিংহ একমাত্র বিভাগীয় শহর যেখানে ঢাকা থেকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) বাস চলাচল করে না। কারণ এনায়েত সাহেবের বাস ছিল নন এসি। এনা পরিবহনের স্থলে ইউনাইটেড পরিবহন এসে ঘটা করে এসি গাড়ির ব্যানার লাগালেও কদাচিৎ এসি গাড়ির দেখা মেলে বলে জানান এই রুটের নিয়মিত যাত্রীরা। আরও লক্ষণীয়, অতি সম্প্রতি বিআরটিসি এসি বাস চালু করেছে এ সড়কে। তবে বিআরটিসি বাস মহাখালী টার্মিনালের বদলে কলেরা হাসপাতালের উল্টো দিক থেকে ছাড়ে। আবার ভালুকার পর আর যায় না বিআরটিসির বাস। কিন্তু কেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে একজন যাত্রীর উত্তর ‘রসুনের সব কোয়ার গোড়া এক জায়গায়’। তিনি আরও জানালেন, টার্মিনাল রক্ষণাবেক্ষণ, কমিউনিটি পুলিশ মোতায়েন ও শ্রমিক কল্যাণের নামে এখনো চাঁদা ওঠানো হয়। তবে মহাখালী বাস টার্মিনালের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার মান, পয়ঃব্যবস্থাপনা, হকারদের উৎপাত ও গাড়ির নিয়ন্ত্রণের অরাজকতা প্রমাণ করে, রক্ষণাবেক্ষণ বা কমিউনিটি পুলিশের নামে ওঠানো টাকা হয়তো নতুন গন্তব্য খুঁজে নিয়েছে। পরিবহন সেক্টরের কতজন শ্রমিক বিগত আন্দোলনে আহত বা নিহত হয়েছেন এবং তাদের কল্যাণে ইতিপূর্বে ওঠানো কল্যাণ ফান্ডের টাকা থেকে কোনো খরচ হয়েছে কি না- এ-সংক্রান্ত কোনো তথ্য কোনো সংবাদমাধ্যমে খুঁজে পাইনি।
এ রুটে বাসের জন্য কোনো টিকিটের ব্যবস্থা নেই। নারী, পুরুষ, শিশু, বয়োবৃদ্ধ- সবাইকে নোংরা প্ল্যাটফরমে বিভিন্ন বাস কোম্পানির টিকিট কাউন্টার ও হকারদের অনুগ্রহ করে (?) ফাঁকা রাখার স্থানে দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। একটার পর একটা বাস আসে, বোঝাই হয়, তারপরই বাস ছাড়ে। আমার বাসে চড়ার সুযোগ আসে প্রায় ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর। ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে একমাত্র ইউনাইটেড পরিবহন (পূর্বের এনা পরিবহন) বিরতিহীন বাস চালাতে পারে। বাকিদের পথে পথে বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানামার সুযোগ দিতে হয়। এটাই এ সড়ক পথের নিয়ম।
ঢাকা-ময়মনসিংহ দূরত্ব ১১৬ কিলোমিটার। ইউনাইটেড পরিবহন নির্ধারিত এই রুটের ভাড়া ৩১০ টাকা। বনানী রেলস্টেশন থেকে উড়ালসড়কে বিমানবন্দরে যাবে বলে আরও ১০ টাকা অর্থাৎ ১১৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে নন এসি বাসে গুনতে হলো ৩২০ টাকা। তবে কোনো টিকিট দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। আগে উত্তরা থেকে সাতরাস্তার মোড় পর্যন্ত ডানে বা বামে গাড়ি ঘোরানোর বদলে জনগণের টাকা খরচ করে ইউলুপ করা হয়েছিল, যেখানে গাড়ি ইউটার্ন নিতে বাধ্য হতো। মহাখালী বাস টার্মিনালের সামনে রাস্তার মাঝখানের বিভাজন কেটে আবার ডানে-বামে গাড়ি ঘোরানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফলে আবারও হাতের ইশারায় দুই পাশে গাড়ি থামিয়ে বাস ঘুরল উত্তর দিকে। মহাখালী রেলক্রসিং থেকে পরবর্তী বিভিন্ন মোড়ে সড়কে গাড়ি নিয়ন্ত্রণের লাইট বা ট্রাফিক সিগন্যাল আছে। জনগণের টাকায় এই লাইট কেনা হয়েছে ও স্থাপন করা হয়েছে। কোনো কোনো স্থানে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থাও করা হয়েছে জনগণের টাকায়। তবে এখন সেগুলো কোনো কাজে আসে না। একটি সভ্য দেশে ডিজিটাল যুগে ট্রাফিক সংকেতের বাতির বদলে হাতে লাঠি আর মুখে খিস্তিখেউর করে গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে হয়- তার জবাব নেই কারও কাছে।
একবার এক বিদেশি বন্ধুসহ চারজন বাংলাদেশি ঢাকার রাস্তায় ঘুরতে বেরিয়েছিল। বিদেশি বন্ধু বসেছিল চালকের পাশে থাকা সামনের আসনে। এক রাস্তার মোড়ে চলন্ত গাড়ি থামাতে লাঠি হাতে এক পুলিশ এগিয়ে এলো এবং গাড়ি থামাল। হঠাৎ লাঠি হাতে পুলিশ দেখে আঁতকে উঠল বিদেশি বন্ধু। আতঙ্ক নিয়ে জিজ্ঞেস করল ‘হোয়াট ইজ দিস?’ (এটা কী?) পেছনে থাকা এক রসিক বন্ধু উত্তর দিল ‘দিস ইজ ঢাকা’ (এটা ঢাকা)। সামনের ট্রাফিক লাইট পোস্টে তখন সবুজ বাতি জ্বলছিল। বিদেশি বন্ধু বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল সেই সবুজ বাতির দিকে। এরপর লাল বাতি জ্বলল। লাঠি হাতে পুলিশ সরে গেল। গাড়ি চলতে শুরু করল। আরও কয়েকটি মোড়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ বাতি বা লাল-হলুদ-সবুজ বাতির তোয়াক্কা না করে গাড়ি চলা দেখে বিদেশি বন্ধু বলেই ফেলল, ‘তোমাদের দেশের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে কোন রঙের বাতি কী সংকেত দেয়?’ পেছনে থাকা রসিক বন্ধু উত্তর দিল, ‘সবুজ মানে যাও, হলুদ মানে গেলেও যেতে পার, না গেলেও ক্ষতি নেই, আর লাল মানে সুযোগ পেলেই গাড়ির মাথা ঢুকাও, একসময় না একসময় ঠিকই বের হয়ে যাবে।’ অবাক বিস্ময়ে বিদেশি বন্ধু জিজ্ঞেস করল ‘কীভাবে চলছে তাহলে এ দেশ?’ রসিক বন্ধুর উত্তর, ‘আল্লাহ চালায়, আল্লাহর অস্তিত্বের বড় প্রমাণ বাংলাদেশ চলছে, কেবল চলছেই না, এগিয়ে চলেছে।’
বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশকে এগিয়ে রাখার একটি ক্ষেত্র ছিল ক্রিকেট। এ ক্রিকেটকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে অবদান রাখা বেশ কজন খেলোয়াড়ের ভাস্কর্য জনগণের টাকায় নির্মিত হয়েছিল কাকলী মোড়ে অর্থাৎ বনানী রেলস্টেশনের দক্ষিণে ডিওএইচএস আবাসিক এলাকার প্রবেশ মুখের সড়কদ্বীপে। যত দূর মনে পড়ে সেখানে আওয়ামী লীগের দুই এমপি মাশরাফি বিন মর্তুজা ও সাকিবেরও অবয়ব বা ভাস্কর্য ছিল। জনপ্রিয় খেলোয়াড়দের ক্রিকেট খেলার বিভিন্ন ঢং ভাস্কর্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল এই সড়কদ্বীপটিতে। এখন এই সড়কদ্বীপে জঙ্গল ও আবর্জনা। ভাস্কর্যগুলো ক্ষতিগ্রস্ত এবং দুই এমপিসহ সবার মুখ বাজারের ব্যাগ ও সিমেন্টের বস্তা দিয়ে ঢাকা। চেয়ে চেয়ে দেখলাম আর ভাবছিলাম সেই বিদেশি বন্ধুর কথা, যে এমনটা দেখে নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করত এটা আবার কী? এরা কারা?
উড়ালসড়ক দিয়ে বনানী থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত একটানে যাওয়া গেল। কিন্তু উড়ালসড়ক থেকে নামার মুখে যানজটের কারণে উড়ালসড়কেই গাড়ির সারি লাইন ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। একই অবস্থা দেখা গেল উত্তরা থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের অধীনে নির্মিত প্রায় সব উড়ালসড়কের ক্ষেত্রে। পাশের সার্ভিস লেনের লোকাল বাস, টেম্পু, অটোরিকশাসহ নানা ধরনের যানবাহন উড়ালসড়কে ওঠা ও নামার মুখে দাঁড়িয়ে থাকে যাত্রী ওঠা-নামা করানোর জন্য। আর উড়ালসড়কে উঠলেই এসব যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় সরাসরি বা বিরতিহীন চলতে ইচ্ছুক সব যানবাহন ও যাত্রীকে। চোখের সামনে দেখলাম সার্ভিস লেনের গাড়ি এগিয়ে গেল, উড়ালসড়কের গাড়ি আর আগায় না। জয়দেবপুর থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত রাস্তা বেশ প্রশস্ত। অথচ কেবল স্থানীয় স্থির ধীরগতির গাড়ি ও অটোর দাপটে গোটা রাস্তায় যানজট লেগে থাকে। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এই রাস্তা বেশ যত্ন নিয়েই নির্মিত হয়েছিল। সড়ক বিভাজনে রোপিত গাছের ফুল মন ভরায়। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তায় গাড়ির ক্রমাগত ঝাঁকুনিতে শরীর কষ্ট পায়। টেকসই হবে না জেনেও পিচঢালা রাস্তার মাঝখানের গর্ত কেন ইট দিয়ে ভরাট করা হয়, তার গভীরে যায় না কেউ। সবাই যেন বসে আছে রাস্তার আরও ক্ষতি, টেন্ডার, ফান্ডপ্রাপ্তি ও বিল বানানোর অপেক্ষায়।
এই ১১৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে বাস টার্মিনালে ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট ও রাস্তায় ৪ ঘণ্টা অর্থাৎ মোট ৫ ঘণ্টা সময় লাগল। একটি হাইওয়ে বা আন্তজেলা সড়কে একজন কর্মজীবীর চলাচলের সক্ষমতা যদি ঘণ্টায় মাত্র ২৪ কিলোমিটার হয়, তবে এই জনিত জাতীয় ক্ষতি সহজেই অনুমেয়। রাজধানীতে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে যানজট। একটু স্বস্তি এখন সময়ের দাবি। বর্তমান সরকারের ‘হানিমুন পিরিয়ড’ বা ১০০ দিন মেয়াদ প্রায় শেষের পথে। এখন নাগরিক স্বস্তি যৌক্তিক দাবি- এটা মানতেই হবে।
উত্তরা গাজীপুর বাস র্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটি প্রকল্প নিয়ে বেশ কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ প্রতিদিন-এ ‘একটি নিরানন্দ সড়কের কথা’ শিরোনামে দীর্ঘ কলাম লিখেছিলাম। এরপর কেটে গেছে প্রায় চার বছর। তবে অবস্থার খুব বেশি উন্নতি হয়নি। বরং বিগত আন্দোলনের সময় এ প্রকল্পের জন্য আমদানি করা চলন্ত সিঁড়িসহ বেশ কিছু সরঞ্জাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখন কোন প্রক্রিয়ায় বিষয়টি সমাধান হবে- বলা কঠিন।
আরেক কঠিন বাস্তবতা হলো, এ দেশের আইন। চলতে চলতে দেখলাম বেশ কিছু থানা ও পুলিশ ফাঁড়ির সামনে বহু যানবাহনের স্তূপ বা সমাবেশ। এর মধ্যে ভালো, পুরনো, অতি পুরনো, দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত, মামলার আলামত হিসেবে জব্দ করা গাড়ি রয়েছে। সড়ক ও জনপদ বিভাগের অফিস, গোডাউন ও রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্র, বিআরটিসি ডিপো (জোয়ারসাহারা ও সালনা), সব পৌরসভার অফিস কমপ্লেক্সসহ আরও কিছু সরকারি অফিসের সামনে পুরনো ও অকেজো গাড়ি, নির্মাণসামগ্রী ও নির্মাণকাজে ব্যবহৃত ভারী গাড়ি এবং যন্ত্রপাতির সমাবেশ চোখে পড়ে। দেশের আইন ও সরকারি নীতি এসব গাড়িতে মরিচা পড়তে দেবে, হারিয়ে যেতে দেবে এবং একসময় মাটিতে মিশে যেতে দেবে। কিন্তু পুনরায় ব্যবহার, মেরামত বা বিক্রি করে সরকারি কোষাগারে টাকা জমা হতে দেবে না। সবারই একই উত্তর আইন ও নীতিতে এমনটা করা যায় না। কেউ আইন ও নীতির বাইরে ঝুঁকি নিয়ে এমনটা করার সাহসও রাখেন না। কারণ এমনটা করলেই হয়তো পেনশনের টাকা আটকে যাবে। রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে এমন আইন ও নীতির সময়োপযোগী সংস্কার এখন অতি জরুরি।
গ্রামে ছিলাম ছয় দিন। এর মধ্যে চার দিন ছুটি ও দুই দিন কর্মদিবস ছিল। কর্মদিবসে উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়েছিলাম একটি জমির মূল দলিল সংগ্রহ করতে। ২০১৮ সালে কেনা জমির মূল দলিল ২০২৪ সালের প্রায় শেষে এসেও তুলতে পারিনি। কারণ তা এখনো প্রস্তুত হয়নি। অথচ ডিজিটাল বাংলাদেশ বিশেষত ভূমি এবং আইনের ক্ষেত্রে সবকিছু ডিজিটাল করার নামে কত কোটি টাকা খরচ হয়েছে তার হিসাব রীতিমতো বিস্ময়কর। আমার অবস্থানকালে দুই দিনই সার্ভার নষ্ট থাকায় জমির খাজনা দিতে পারিনি। একজন জমি বিক্রেতার বাবার মৃত্যু সনদ প্রয়োজন ছিল। সেই ভদ্রলোক মারা গেছেন প্রায় ৩০ বছর আগে। তখন জাতীয় পরিচয়পত্র ছিল না। কিন্তু বর্তমান আইন অনুসারে প্রথমে তার জন্মনিবন্ধন বা জন্মসনদ লাগবে। তারপর হবে মৃত্যুসনদ। এমন সনদ বানানো যায় ইউনিয়ন ডেটা সেন্টার বা ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে। কিন্তু তা স্বাক্ষর করবেন কে? জনপ্রতিনিধিরা কে কোথায়- কেউ জানে না! বিধবা-ভাতা, বয়স্ক-ভাতাসহ সামাজিক নিরাপত্তার বিভিন্ন ভাতা বন্ধ। দুই দিনেও খুলতে দেখিনি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিক। গ্রামে পায়ে চালিত কোনো রিকশা চোখে পড়েনি। সবই অটোরিকশা বা ব্যাটারিচালিত বাহন, যা অবৈধ। বিশাল গাছের গুঁড়ি, জ্বালানি কাঠ, বাঁশ, বস্তা প্রভৃতি বোঝাই করে স্থানীয়ভাবে নির্মিত ছোট ছোট যানবাহন প্রতিযোগিতা করে রাস্তায় ছুটে চলে। আবার হুট করে মহাসড়কেও উঠে যায়। দেখলেই ভয় লাগে, অথচ সবই যেন মেনে নিয়েছে গ্রামের মানুষ। তবে তারা মানতে পারে না দুটো বিষয়।
প্রথমত, দ্রব্যমূল্য এত বেশি কেন? সকালে স্থানীয় রেস্তোরাঁয় নাশতা খাওয়ার সময় ডিম ভাজি পাওয়া গেল না। দোকানির মন্তব্য- ডিম, কাঁচামরিচ ও পিঁয়াজের দাম এত বেড়েছে যে, ক্রেতারা ডিম ভাজির দাম শুনলেই রেগে যান এবং অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। তাই ডিম বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন গ্রাম্য রেস্তোরাঁর মালিকরা। শুধু ডিমই নয় সবজিও পাওয়া যায় না সব রেস্তোরাঁয়। তাই বাধ্য হয়ে পাতলা ডাল দিয়েই চলে সকালের নাশতার পর্ব। অথচ ময়মনসিংহ জেলার এই অঞ্চলে মুরগির খামার করে নিঃস্ব হয়েছেন শত শত কৃষক ও বেকার তরুণ। কারওয়ান বাজারে ভোক্তা অধিকার পরিদপ্তরের অভিযান টেলিভিশনের পর্দায় দেখে তারা কষ্ট পান। তাদের দাবি, মুরগির বাচ্চা, মাছ ও পশুপাখির খাবার এবং ওষুধের মূল্য উৎপাদন বা আমদানি খরচ, বিশ্ববাজারে এসব পণ্যের মূল্য এবং বাংলাদেশের বাজারে দেশীয় ও বহুজাতিক কোম্পানির মাধ্যমে আসা এসব পণ্যের বিক্রয়মূল্য নিয়ে সরকার কিছু করুক। না হয় সরকার ন্যায্যমূল্যে মুরগি ও গবাদিপশুর বাচ্চা, খাবার ও ওষুধের ব্যবস্থা করুক।
উভয় কর্মদিবসের সকাল ১০টা-১১টার দিকে অর্থাৎ কাজ করার মোক্ষম সময়ে চা দোকানের সামনে কর্মক্ষম বহু পুরুষ গ্রামবাসীকে দেখলাম চা খাচ্ছে, পান-সিগারেট চলছে, টিভিতে বাংলা সিনেমা দেখছে। কাজ করছে না কেন এ মানুষগুলো- এমন প্রশ্নের উত্তরে জানলাম এদের প্রায় সবার এক বা একাধিক স্ত্রী, মা ও বোন বিভিন্ন গার্মেন্ট, ফিশ ও পোলট্রি ফিড কারখানাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। আর ছেলেরা সেই আয়েই চলে আর বিদেশে যাওয়ার চেষ্টায় থাকে ও স্বপ্ন দেখতে থাকে। দেশে কোনো কাজ করতে চায় না তাদের কেউ। খুব বেশি বিপদে পড়লে অটোগাড়ি চালায়। কিন্তু মাঠে বা জমিতে কাজ করতে অনিচ্ছুক অধিকাংশ গ্রামবাসী। বেশ কয়েকজনের সঙ্গে মিশে এমন কথার সত্যতাও মিলল। দ্বিতীয়ত, গ্রামবাসীর প্রশ্ন, এত প্রচার ও এত খরচের পরও নিয়মিত বিদ্যুৎ পাওয়া যায় না কেন? আসলে এ দেশটাই যেন এক অন্তহীন প্রশ্নের দেশ।
লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল : [email protected]