সারা দেশে চলাচল করা যানবাহনের মধ্যে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা অন্যতম। সড়ক, মহাসড়ক, অলিগলিতে কী পরিমাণ ব্যাটারিচালিত রিকশা আছে, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে সারা বাংলাদেশে ৪০ লাখ ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা আছে। এর মধ্যে ঢাকা শহরে আছে ৭-৮ লাখ। কম দাম ও বিদ্যুৎ-চালিত হওয়ার কারণে এটি অর্থনৈতিক দিক থেকে বেশ লাভজনক। এই বাহনগুলো শব্দদূষণও করে না। ফলে খুব সহজেই এটি প্রচলিত অনেক যানবাহনের অন্যতম বিকল্প হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। এ ধরনের বাহন সর্বপ্রথম চীন থেকে বাংলাদেশে এসেছিল ২০০৭ সালে। এখন অবশ্য নেপাল, ভারত এমনকি বাংলাদেশেও তৈরি হচ্ছে। অনেকের মতে, কুমিল্লা শহরে ২০০৪ সালে প্রথম ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল শুরু হয়, যা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ডিজেল প্ল্যান্ট তৈরি করে। শুরুতে এই রিকশার যন্ত্রাংশ আমদানিনির্ভর হলেও বর্তমানে দেশেই তৈরি হচ্ছে। ঢাকার কেরানীগঞ্জ, গাজীপুরসহ সারা দেশে ৬০ থেকে ৭০টি কারখানায় তৈরি হচ্ছে এসব রিকশা। ব্যাটারিও তৈরি হয় দেশেই। সাধারণ রিকশার চেয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশার গতি বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাঠামোগত কারণে এসব রিকশা সড়কের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বেপরোয়া গতির কারণে অনেক সময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ঘটে মারাত্মক দুর্ঘটনা। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবরে সড়ক দুর্ঘটনায় পড়া ৬৩১টি যানবাহনের মধ্যে ১৭ দশমিক ৯১ শতাংশ ব্যাটারিচালিত যান। সেই হিসাবে দুর্ঘটনার দিক থেকে চতুর্থ অবস্থায় আছে এই রিকশা, যদিও প্রকৃতপক্ষে এই সংখ্যা আরও বেশি। এসব কারণে প্রায়ই এটাকে নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু প্রায় ৪০ লাখ চালক এবং তাদের পরিবারের দিকে তাকিয়ে পুনরায় চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়। তবে শুরুতে অর্থাৎ ২০ বছর আগে যখন এসব বাহন চালু হয় তখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/সরকার এগুলোর গতির মান, নিরাপত্তা এবং অন্যান্য পলিসির বিষয়গুলো নিশ্চিত করলে এমনটি হয়তো হতো না। এখন এগুলো যানবাহনের বিকল্প হিসেবে এমনভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে যে হুট করে আর বন্ধ করা যাচ্ছে না।
শুরুতে পঙ্গু ও প্রতিবন্ধী লোকদের জন্য এর অনুমতি দেওয়া হলেও বর্তমানে অনেক সুস্থ ব্যক্তিরাও এগুলো চালাচ্ছেন। তবে আতঙ্কের বিষয় হলো, তারা ট্রাফিক নিয়মের কোনো ধার ধারেন না। উল্টো পথে, আড়াআড়ি, কোনাকুনি যেভাবে পারেন তারা চলছেন আর দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছেন। বিগত কয়েক বছরে ঈদের সময় সড়ক দুর্ঘটনার একটি বড় অংশই ঘটছে ব্যাটারিচালিত রিকশা এবং ইজিবাইকের জন্য। প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি এ ধরনের বাহন ঈদ মৌসুমে মালামাল ও যাত্রী নিয়ে বেপরোয়া গতিতে মহাসড়কে উঠে আসে এবং দুর্ঘটনার শিকার হয়। এদের বেপরোয়া এবং নিয়ন্ত্রণহীন চলাচলের কারণে সাধারণ মানুষ খুব বিরক্ত হলেও এর চাহিদার কোনো কমতি নেই। স্বল্পদূরত্বে এবং কম খরচে যাতায়াতের ক্ষেত্রে এর গ্রহণযোগ্যতা দেশব্যাপী। এর নির্মাণ খরচও অনেকটা সাধ্যের মধ্যে থাকলেও এগুলোর মালিক সাধারণত প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই হয়ে থাকেন। আবার এগুলোর বিদ্যুৎ ব্যবহারেও আছে বিশাল অনিয়ম। কেউ বাড়িতে চার্জ দেন, আবার কেউ অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে কাজ চালান। ৪০ লাখ রিকশায় প্রতিদিন সাড়ে ১২ কোটি টাকার বেশি বিদ্যুৎ খরচ হলেও সরকারি কোষাগারে আসলে কত জমা হয়? এগুলো সবই কঠিন হাতে মনিটরিং করা উচিত।
ব্যবহৃত ব্যাটারিগুলো ‘ইউ’ ব্রেকে চলে। এতে দুটো ব্রেক-প্যাড থাকে, যারা চাকার রিম চেপে ধরে, যা রিকশা বা সাইকেলের জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু ব্যাটারি সংযোজন করার পর রিকশাগুলো ৩০-৩৫ কিলোমিটার গতিতে চলায় এই ব্রেক অনেকটাই অনুপযোগী হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে হাইড্রোলিক ব্রেকিংয়ে পরিবর্তন করলে নিয়ন্ত্রণ অনেকটা সহজ হবে। আবার কম ওজন এবং বেশি উঁচু হওয়ায় রিকশাগুলো প্রায়ই উল্টে যায়। দ্রুতগতিতে চালিয়ে যখন মোড় নিতে যায় সে সময় ভারসাম্য রাখতে না পেরে উল্টে যায়। এজন্য চেসিসটা আরেকটু ভারী করা উচিত। রিকশাগুলোতে সোলার প্যানেল সংযোজন করা গেলে কার্বন নিঃসরণ কমবে, বিদ্যুৎ খরচ কমার পাশাপাশি রিকশাচালকের আয় বাড়বে। নানা কারণে যেহেতু বাহনটিকে কোনোভাবেই নিষিদ্ধ করা যাচ্ছে না, তাই নিয়ন্ত্রণ করাই উত্তম। সেজন্য পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, দুর্ঘটনা সহনশীল, টেকসই, দৃষ্টিনন্দন, পরিবেশবান্ধব এবং সাশ্রয়ীমূল্যের ব্যাটারিচালিত রিকশার মডেল তৈরির দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। এমনটি হলে তা শুধু বাংলাদেশেই নয়, পার্শ্ববর্তী কয়েকটি দেশ, এমনকি ইউরোপ-আমেরিকাতেও বাজারজাত করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কারণ ওই অঞ্চলের পর্যটকদের জন্য এ ধরনের রিকশা খুবই আকর্ষণীয় হবে। গাড়িটির লাইসেন্স এবং প্রত্যেক চালকের একটি আইডি সরবরাহ করা যেতে পারে। ভবিষ্য-তহবিল হিসেবে চালকদের আয়ের একটি অংশ ওই আইডির বিপরীতে প্রশাসননিয়ন্ত্রিত একটি অ্যাকাউন্টে জমা রাখার বিধান রাখা যেতে পারে। তবে ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো শুধু প্রতিবন্ধীরাই চালাবে নাকি সুস্থ ব্যক্তিরাও চালাবে, তা-ও বিধিমালায় অন্তর্ভুক্ত থাকা উচিত। ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইককে কেন্দ্র করে সারা দেশে একটি চাঁদাবাজ চক্রও গড়ে উঠেছে। প্রতি বাহনের বিপরীতে মাসে প্রায় দুই হাজার টাকার চাঁদার কারণে মাসে ৮০০ কোটি টাকার চাঁদা যায় অসাধুচক্রের পকেটে।
লেখক : অধ্যাপক এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়