রবিবার, ১২ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা
শিক্ষা ও শিক্ষক

আদর্শ শিক্ষকরাই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ার কারিগর

আদর্শ শিক্ষকরাই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ার কারিগর

দেশে বছর বছর এসএসসি ও এইচএসসিতে পাসের হার বাড়লেও শিক্ষার সামগ্রিক মান বাড়ছে কিনা এ নিয়ে বিতর্ক আছে। শিক্ষার্থীরাও ভালো জিপিএ প্রাপ্তির পাশাপাশি প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে কিনা এ নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। ফলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন আনার দাবি উঠেছে। তাই দেশের শিক্ষার মান কীভাবে বাড়ানো যায়, শিক্ষার্থীদের কীভাবে আরো বেশি করে পড়াশোনামুখী করা যায় এসব নিয়ে কথা বলেছেন রাজধানীর মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ লে. কর্নেল কাজী শরীফ উদ্দিন (পদাতিক)। শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানোর লক্ষ্যে নিজ প্রতিষ্ঠানের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েও কথা বলেছেন তিনি।

 

 

 

প্রশ্ন: প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সব স্তরেই পাসের হার বেড়েছে। তবে শিক্ষার সামগ্রিক গুণগতমান বেড়েছে কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন আছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কি?

উত্তর: আধুনিক সভ্যতার ক্রমবিকাশ, তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তার, বিজ্ঞানের নব নব বিস্ময়কর আবিষ্কার এসব কিছুর মূলে রয়েছে শিক্ষা। সার্বিক পরিস্থিতিতে বর্তমান অবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থা, এগিয়ে চলছে শিক্ষার্থীরা। এর ফলে বেড়েছে পাসের হার। আমাদের শিক্ষার্থীরা শুধু পরীক্ষার আগেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে পড়ালেখা করে। তবে তাদের মান ধরে রাখতে হবে যে, সব সময় পড়তে হবে; পাঠ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

প্রশ্ন: শিক্ষার মান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে শিক্ষকরা কী ভূমিকা রাখতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

উত্তর: একটি জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করার প্রধান অস্ত্র হলো সুশিক্ষা ও মানসম্মত শিক্ষা। আর এই পবিত্র দায়িত্ব পালন করেন শিক্ষকরা। তবে বর্তমানে মেধাবী ও যোগ্য শিক্ষকের অভাব রয়েছে। মেধাহীন ও অযোগ্য শিক্ষক কোনোভাবেই শ্রেণিকক্ষে মানসম্মত শিক্ষা প্রদান করতে পারেন না। আদর্শ শিক্ষকরাই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ার কারিগর।

প্রশ্ন: গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আপনার প্রতিষ্ঠান কী কী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে?

উত্তর: এ লক্ষ্যে আমাদের রয়েছে সার্বক্ষণিক তদারকি, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গুণগত শিক্ষকমণ্ডলী, সকল কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা ও সংশ্লিষ্ট সবার জবাবদিহিতা। জবাবদিহিতা ছাড়া কোনো পদ্ধতি কার্যকর হয় না এবং কোনো কর্মকাণ্ড বেগবান হয় না। গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ হিসেবে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা, স্কুলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ও আদর্শ শিক্ষাদান নিশ্চিত করাই আমার পবিত্র দায়িত্ব। ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবকদের সমন্বয়ে ছাত্রদের জ্ঞান তৃষ্ণা জাগিয়ে তোলাই প্রধান দায়িত্ব বলে মনে করি। আমার প্রতিষ্ঠানে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য দুজন গাইড টিচার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এদের একজন শিক্ষার্থীর পড়ালেখার বিষয়টি তদারকি করেন আর অন্যজন তার সহশিক্ষা ও ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন।

 

প্রশ্ন: বিগত বছরগুলোয় আপনার প্রতিষ্ঠানের সফলতা কেমন?

উত্তর: আমার প্রতিষ্ঠান বিগত তিন বছর ধরে পিইসি, জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসিতে শতভাগ পাসের কৃতিত্ব দেখিয়েছে। সেইসঙ্গে সর্বোচ্চ ৮২% পর্যন্ত জিপিত্র-৫ পাওয়ার গৌরব অর্জন করেছে।

প্রশ্ন: আপনার প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের কোনো আর্থিক সুবিধা দিয়ে থাকে কি?

উত্তর: কর্তৃপক্ষের দিক নির্দেশনায় এবং সমপূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত হয় এই প্রতিষ্ঠান।  আমরা দরিদ্র, মেধাবী ও কৃতী শিক্ষার্থীদেরকে নানারকম আর্থিক সুবিধা দিয়ে থাকি।

প্রশ্ন: জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কি?

উত্তর : প্রাথমিক শিক্ষার স্তর পঞ্চম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সম্প্রসারণ বর্তমান সরকারের একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তবে সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে শিক্ষার গুণগতমান বাড়তে হবে। এ সিদ্ধান্তের সুফল পেতে প্রয়োজন পর্যাপ্ত বিনিয়োগ ও নিবিড় পর্যবেক্ষণ। প্রথম পদক্ষেপে ভালো ফলাফলের জন্য শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সবাইকে হতে হবে আন্তরিক এবং এক্ষেত্রে প্রত্যেকের সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন।

প্রশ্ন: মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিশেষত্ব কি?

উত্তর: এখানে মানসম্মত ও আদর্শ শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সার্বক্ষণিক তদারকি করা হয়। অধ্যক্ষসহ সব প্রভাষক, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঠিক সময়ে আগমন ও প্রস্থান নিশ্চিত করা হয় Biometric ফিঙ্গার প্রিন্ট এটেন্ডেন্টস এর মাধ্যমে। সকল ক্লাসের সুস্থ পাঠদান নিশ্চিত করা হয় সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে। সহশিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে প্রতি বৃহষ্পতিবারে স্কাউট, বিএনসিসি, রেড ক্রিসেন্ট, কালচারাল, ল্যাংগুয়েজ ও বিজ্ঞান ক্লাবের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। তাছাড়া রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে চমৎকার পরিবেশে প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে ৭তলা বিশিষ্ট ৪টি নিজস্ব ভবন, ছেলে ও মেয়েদের জন্য আলাদা ২টি খেলার মাঠ, লাইব্রেরি, আধুনিক কম্পিউটার ল্যাব, বিজ্ঞানাগার, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম। আমার প্রতিষ্ঠানে রয়েছে অবকাঠামোগত সব সুযোগ সুবিধা। এক কথায় পড়াশোনার মানসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়েছে।

প্রশ্ন: শিক্ষার্থীদের মাঝে মানবিক মূল্যবোধসহ অন্যান্য যাবতীয় গুণাবলির বিকাশ ঘটাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অভিভাবক ও সংশ্লিষ্টদের করণীয় কি?

উত্তর: একজন আদর্শ শিক্ষক পোশাক-পরিচ্ছদে, পেশা বা কর্মে, নিজ দায়িত্বের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করবেন। প্রতিটি শিক্ষার্থীর প্রতি সম্মান ও আন্তরিকতা প্রদর্শন করতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের আহত করে এমন আচরণ থেকে বিরত থাকতে হবে। তাহলেই কেবল কোনো শিক্ষক শিক্ষার্থীদের আস্থাশীল অভিভাবক হতে পারবেন। শিক্ষকই পারেন শিক্ষার্থীদের মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটাতে। এখানে অভিভাবকদের হতে হবে প্রকৃত বন্ধু ও যোগ্য পরামর্শদাতা এবং তাদের থাকতে হবে শিক্ষার্থীদের ব্যাপারগুলো সহজেই মেনে নেওয়ার মানসিকতা। এক্ষেত্রে অধ্যক্ষ বা প্রতিষ্ঠানকে মডারেটর বা সমন্বয়কারীর ভূমিকা পালন করতে হবে। 

প্রশ্ন: পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রম আপনার প্রতিষ্ঠান কীভাবে পালন করছে?

উত্তর: বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের আদর্শ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হলে সহশিক্ষা কার্যক্রমের কোনো বিকল্প নেই। আমার কলেজে বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, উপস্থিত বক্তৃতা, ডিবেটিং, স্কাউটিং, রোভারিং, বিএনসিসি, রেডক্রিসেন্টসহ বিভিন্ন ধরনের সহশিক্ষা কার্যক্রম রয়েছে। আমাদের শিক্ষার্থীরা প্রায়শই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পুরস্কার পাচ্ছে।

প্রশ্ন: স্কুল-কলেজে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে আপনার পরামর্শ কী?

উত্তর: বিশ্বায়নের যুগে যন্ত্র সভ্যতার প্রেক্ষিতে প্রাপ্ত নতুন নতুন জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন তথা যাবতীয় জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়কে প্রস্তুত হতে হবে নতুন আঙ্গিকে। তা না হলে আদর্শ শিক্ষা ব্যাহত হবে। শিক্ষার্থীকে নিয়মিত পড়ালেখা করতে হবে।

প্রশ্ন: আপনার শিক্ষাজীবন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো স্মৃতি থাকলে বলুন।

উত্তর: আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের ছাত্র ছিলাম। প্রথম বর্ষ অতিক্রমের পর ২৮তম দীর্ঘমেয়াদি কোর্সের অফিসার হিসেবে সেনাবাহিনীতে যোগদান করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদায়ী সাক্ষাৎকারে সাবেক শিক্ষক (বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি হিসেবে কর্মরত) প্রফেসর ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান সজল অনেক আদর করে বলেছিলেন, বাবা জীবনে অনেক বড় হও। ভালো ছাত্র গড়ার বিষয়টি শিক্ষকের জন্য আনন্দের এবং গর্বের। আজ অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে স্যারের প্রতিটা কথা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে মনে পড়ে। ব্যক্তিগত জীবনে আমার দুটি সন্তান রয়েছে। আর এ পবিত্র দায়িত্বের কারণে আজ আমার তিন সহস্রাধিক সন্তান। আমার শিক্ষার্থীদের অনেকেই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রশিক্ষণরত সেনা ও বিমান বাহিনী কর্মকর্তা কিংবা নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তাদের এই প্রতিষ্ঠায় আমার চোখে আনন্দাশ্রু চলে আসে।

সর্বশেষ খবর