মঙ্গলবার, ২৮ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

আত্মত্যাগের শিক্ষা

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

আল্লাহরাব্বুল আলামিনের আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা হলো মানুষ। আর সেই মানুষের ব্যক্তিগত স্বভাব চরিত্র আচার-আচরণ তার ইহসান সবই আল্লাহ ও তার রসুলের নির্দেশ ও নির্দেশনা অনুযায়ী হওয়ার মাধ্যমে সেই  শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা যায়। বান্দার ব্যক্তিগত চারিত্রিক ঊৎকর্ষতা ছাড়া তার কোনো আমল ও ইবাদত আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। ইহসান এর মূল কথা হলো— ক্রোধ, লোভ, মোহ, হিংসা-বিদ্বেষ, গিবত, অপবাদ, মিথ্যা অহংকার ইত্যাদি মন্দ স্বভাব থেকে পাক পবিত্র হয়ে ইখলাস, আমানতকারী, বিনয় ও নম্রতা, সততা ও ন্যায়পরায়ণতা ইত্যাদি উত্তম চরিত্রের দ্বারা নিজেকে সুশোভিত করা। এর জন্য নিরলস সাধনা ও চেষ্টা প্রয়োজন। আত্মত্যাগের মহান আদর্শ ছাড়া এ সাধনায় সফল হওয়া যায় না।

খোদার নৈকট্য লাভ, তার প্রিয় বান্দা হিসেবে আশরাফুল মখলুকাত হতে হলে মানুষকে আত্মত্যাগের মহিমায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সব সময় আত্মশুদ্ধির চেষ্টায় থাকতে হবে। বস্তুত আত্মাই দেহকে পরিচালিত করে, দেহ আত্মাকে নয়। সহিহ বোখারি শরিফের ইমান অধ্যায়ে রসুলে করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন— ‘নিশ্চয়ই মানুষের শরীরে একটি গোশতের টুকরা আছে। তা বিশুদ্ধ থাকলে গোটা শরীর সুস্থ থাকে। আর তা বিনষ্ট হলে গোটা শরীরই ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে যায়। জেনে রাখ ওই [গোশতের টুকরাটি হলো মানুষের কালব বা আত্মা।’

আলকোরআনের ১৮তম সূরা আল কাহফের ১৯ ও ২০ আয়াতে, ৭৪তম সূরা মুদাসি্সরের ৭ আয়াতে, ৮২তম সূরা আল ইনফিতারের ৬ ও ৭ আয়াতে, ১০৩তম সূরা আসরের ৩ আয়াতে তাকওয়া অর্জনের উপায় হিসেবে আত্মশুদ্ধি, আত্মত্যাগ এবং আত্মোৎসর্গের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে। নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে প্রত্যেক মানুষ তার নিজের কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠাবান হলে এবং দুনিয়ার তথা আরাম আয়েশ সম্পদ বৈভব অর্জনে অন্ধ না হয়ে একে অপরের সাহায্য সহযোগিতার মানসিকতার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হলে তার জন্য রয়েছে অশেষ কল্যাণ। আমরা নিজের জন্য যা ভালো-মন্দ মনে করি অন্যের জন্য তাই মনে করতে হবে, অন্যের কল্যাণ চিন্তায় এনে তার সাহায্য সহযোগিতায় আসতে হলে নিজের স্বার্থ বা আত্মত্যাগের প্রয়োজন পড়বে। একমাত্র মানুষকে দেওয়া হয়েছে এই উপলব্ধির ক্ষমতা এবং সে সূত্রে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য সাব্যস্ত করে দেওয়া হয়েছে বলেই আত্মত্যাগের মাধ্যমে মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত হওয়ার সাধনায় সফল হতে পারে। কোরআন হাদিসে প্রত্যেক মুসলমানের প্রতি সাধ্যমতো সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ ফরজ করা হয়েছে। নিজের আমলকে যথেষ্ট মনে করলে চলবে না, সন্তান-সন্ততি কী করছে সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। দুনিয়ার আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাস, সহায়-সম্পত্তির প্রতি আসক্তি এবং তা অর্জনের জন্য অবৈধ পন্থা অবলম্বন কোনো অবস্থাতেই সমর্থনযোগ্য নয়। আত্মত্যাগের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে এসব অবৈধ পথ ও পন্থা অবলম্বন থেকে বিরত থাকতে হবে।

আত্মত্যাগের মহিমা আল্লাহর দরবারে বিশেষ মর্যাদার। খোদার রাহে পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করেই প্রকৃত মুসলমান হওয়া যায়। আত্মত্যাগের মাধ্যমে মূলত তাকওয়া বা খোদাভীরুতার প্রকাশ পায়। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নিজের প্রাণাধিক পুত্রকে আল্লাহর রাহে উৎসর্গ করতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন হজরত ইবরাহিম (আ.)। তার এই আত্মত্যাগের মহান আদর্শ অনুসরণে প্রতি বছর জিলহজ মাসে ঈদুল আজহার সময় পশু কোরবানির মাধ্যমে একজন মুসলমান তাকওয়া অর্জনের সুযোগ পেয়ে থাকেন। আল কোরআনে বলা হয়েছে— কোরবানির মাংস বা রক্ত কিছুই খোদার দরবারে পৌঁছায় না, যা পৌঁছায় তা হলো তোমাদের তাকওয়া। দুনিয়ার ভোগ বিলাসে মত্ত থাকার কারণে কাফেরদের বিরুদ্ধে শাস্তিবাণী উচ্চারিত হয়েছে কোরআনে। তাই রসুলুল্লাহ (সা.), সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীগণ দুনিয়ার ভোগ-বিলাস বর্জন করার অভ্যাস গড়ে তুলেছিলেন। তাদের জীবন সাধনা এ সাক্ষ্য দেয়। রসুলুল্লাহ (সা.) হযরত মোয়ায (রা.)-কে ইয়ামেন প্রেরণের সময় এ উপদেশ দেন— ‘দুনিয়ার ভোগ-বিলাস থেকে বেঁচে থেক।’ হযরত আলী বর্ণনা করেছেন রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছ থেকে অল্প রিযিক নিতে সম্মত হয়ে যায়, আল্লাহতাআলাও তার অল্প আমলে সন্তুষ্ট হয়ে যান।’ আল্লাহ আমাদেরকে সব কাজে ও ক্ষেত্রে আরও আত্মত্যাগের তৌফিক এনায়েত করুন। আমিন।

লেখক : সরকারের সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান।  

সর্বশেষ খবর