মঙ্গলবার, ২৪ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

চিকিৎসা নিয়ে ভয়াবহ বাণিজ্য

বিশেষ প্রতিনিধি

চিকিৎসা নিয়ে ভয়াবহ বাণিজ্য

দেশের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে ভয়াবহ নৈরাজ্য চলছে। সরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররা নিয়ম-নীতি মানেন না। বেসরকারি হাসপাতালে চলছে শুধুই বাণিজ্য। চিকিৎসাসেবা বলে কোথাও কিছু নেই। যার যা খুশি তাই করছে। পদে পদে হয়রানির শিকার হচ্ছেন রোগীরা। এমনকি সরকারি হাসপাতালগুলোতে বেসরকারি ওষুধ কোম্পানিগুলোর এজেন্টদের আধিপত্য ও দাপটে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হয়। তারপরও দেখার কেউ নেই। জানা গেছে, শুধু হাসপাতাল নয়, ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতেও একই অবস্থা। চিকিৎসকদের কমিশনের জন্য সমানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো হয়। আদৌ এসব পরীক্ষার দরকার আছে কিনা তা কেউ দেখে না। অনেক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতির মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ধানমন্ডির কোনো ক্লিনিকে পরীক্ষা করার পর একই বিষয়ে উত্তরা কিংবা অন্য কোনো এলাকায় পরীক্ষার পর রিপোর্ট আসে ভিন্ন। ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর গেলে বাংলাদেশের এসব পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে হাসাহাসি করেন ডাক্তাররা। জানা গেছে, সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীদের দেখার পরিবর্তে ডাক্তাররা নিজেরাই দলাদলি নিয়ে বেশি ব্যস্ত। অভ্যন্তরীণ বিরোধে মাঝে মাঝে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বন্ধ হয়ে যায়। এরপর বেশির ভাগ ডাক্তারই ব্যস্ত নিজেদের তৈরি করা হাসপাতাল নিয়ে। প্রায় সবাই প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন বিভিন্ন ক্লিনিকে। এ কারণে সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকরা নিজেরাই রোগীদের বলেন, এখানে ভালো অবস্থা নেই। আপনারা অমুক ক্লিনিকে চলে যান। সেখানে আমি নিজেই দেখে দিতে পারব। অসহায় রোগীরা ডাক্তারদের সে কথাই শোনেন। ঢাকার মহাখালী এলাকার একটি হাসপাতালে রোগীদের সিটে বহিরাগতরা মাসের পর মাস থাকে। তাদের উচ্ছেদ করা সম্ভব হয় না। শুধু ঢাকা নয়, ঢাকার বাইরেও একই চিত্র। হাসপাতালগুলোর চিকিৎসা পরিবেশের অবস্থাও খারাপ। টয়লেটগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার লোকবলের অভাব। অনেক হাসপাতালে রয়েছে ডাক্তার ও নার্সের সংকট। ডাক্তাররা উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে থাকতে চান না। আবার ইউনিয়ন পর্যায়ের কিছু কিছু হাসপাতালে কাগজে-কলমে ডাক্তারের নাম থাকলেও বাস্তবে তারা থাকেন জেলা কিংবা উপজেলা সদরে। মনিটরিংয়ের অভাব সবখানে। ঢাকার বেশির ভাগ হাসপাতাল সিন্ডিকেট এবং দলবাজদের দখলে। এখানে দলীয় পরিচয় না থাকলে থাকা যায় না। বিশেষায়িত কয়েকটি হাসপাতালের অবস্থা ভয়াবহ খারাপ। হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে দীর্ঘদিন থেকে ডাক্তারদের বিরুদ্ধে ঘাটে ঘাটে অনিয়মের অভিযোগ। তদন্ত হয়, বাস্তবমুখী ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এমনকি বিভিন্ন হাসপাতালে কেনাকাটায় অনিয়মে জড়িত দুদকের মামলার আসামি চিকিৎসকের বিরুদ্ধেও বিভাগীয়ভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এর মধ্যে রয়েছে ওষুধ বাণিজ্যের সিন্ডিকেট। কয়েক মাস আগে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের ক্রাইম টিম নিজেদের নামে ভিটামিন ওষুধ বানিয়ে তা বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের এক ডাক্তারকে ঘুষ দিয়ে প্রেসক্রিপশনে রোগীদের কেনার কথা লিখিয়ে নেয়। পরে বিষয়টি তারা হাতেনাতে প্রমাণ করে কিভাবে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি চিকিৎসকদের ম্যানেজ করে নিজেদের ওষুধবাণিজ্য চালায়। এদিকে ঢাকার ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে বিভিন্ন রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষারও নির্দিষ্ট অর্থ নির্ধারণ করা নেই। এ কারণে পাঁচ তারকা হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নেওয়া হয় এক ধরনের রেট। আবার গুলশান-বনানী-ধানমন্ডিতে এক রকম, এলিফেন্ট রোডে আরেক রকম। কোনোটার সঙ্গে কোনোটার মিল নেই। দীর্ঘদিন ধরে এ ব্যাপারে সরকারিভাবে পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি থাকলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ডাক্তারদের ফি নেওয়ার রেট নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে। পাঁচ তারকা হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার যতবার রোগী দেখতে আসবে ততবারই মোটা অঙ্কের ফি দিতে হবে। নার্স কিংবা অন্যান্য ফি তো রয়েছেই। আবার ডাক্তারদের চেম্বারে রোগী দেখার ফিও নির্ধারণ করা নেই। একেক হাসপাতালে রোগী দেখার ফি একেক ধরনের। অনেক সময় দেখা যায় অধ্যাপকের চেয়ে সহকারী কিংবা সহযোগী অধ্যাপকের ফি অনেক বেশি। যে যেভাবে পারছে রোগীদের কাছ থেকে যথেচ্ছ ফি আদায় করছে। জেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালগুলোতে দালাল ফড়িয়াবাজদের নৈরাজ্যে চিকিৎসাসেবা লাটে উঠেছে। দালালরা রোগীদের প্রলুব্ধ করে প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে যায়। এমনকি হাসপাতালের একশ্রেণির কর্মচারী প্রাইভেট ক্লিনিকের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। ফলে, সাধারণ রোগীরা নির্বিঘ্নে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা নিতে পারেন না। এদিকে সরকারের কার্যকর মনিটরিংয়ের অভাবে অপচিকিৎসার ভয়াবহ বিস্তার ঘটছে সারা দেশে। দরিদ্র, অসহায় রোগীদের জিম্মি করে হাতুড়ে ডাক্তাররা চিকিৎসার নামে প্রতারিত করছে সাধারণ মানুষকে। রাজধানীর মিরপুর এক নম্বরে শাহ আলী মাজার সংলগ্ন বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে হাতুড়ে ডেন্টিস্টরা প্রতিদিন ঝুঁকিপূর্ণ উপায়ে অসংখ্য মানুষের দাঁতের চিকিৎসা করেন। এতে দাঁতের রোগীরা দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আক্রান্ত হন। দেখার কেউ নেই। বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রকিবুল ইসলাম লিটু বলেন, রোগীরা বিপদে পড়েই ডাক্তারদের কাছে আসেন। মুষ্টিমেয় কিছু ডাক্তার এই বিপদকে পুঁজি করে বাণিজ্য করছেন। তারা অধিক মুনাফা লাভের আশায় রোগীকে মানুষ মনে করছে না। এদের কারণে চিকিৎসকদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। তিনি বলেন, দেশে অনেক ভালো ডাক্তার আছেন যারা রোগীদের কাছ থেকে অনেক কম ফি নেন। যেমন প্রফেসর এ বি এম আবদুল্লাহ। কিন্তু তার চেয়ে অনেক অপরিণত, অদক্ষ ডাক্তার অনেক বেশি ফি নেন। ডাক্তারদের ফি নির্ধারণ করে না দেওয়ার কারণে এই নৈরাজ্য চলছে। ডাক্তার রকিবুল ইসলাম লিটু আরও বলেন, করপোরেট হাসপাতালগুলোতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফি অনেক বেশি নেওয়া হয়। একই পরীক্ষা সরকারি হাসপাতালের চেয়ে করপোরেট হাসপাতালে কয়েকগুণ বেশি। সরকার বিভিন্ন পরীক্ষার সর্বোচ্চ ফি নির্ধারণ করে দিতে পারে। রোগ তো ধনী-গরিব সবার জন্যই এক। একজন গরিবের যখন হৃদরোগ, ক্যান্সারসহ বড় রোগ হয় তখন তাকে ঘরবাড়ি বিক্রি করে চিকিৎসা করাতে হয়। মুষ্টিমেয় কিছু ডাক্তার সেই সুযোগটা নিতে চান। তারা রোগীকে মানুষ মনে করেন না। তারা একটু মানবিক হলে চিকিৎসাসেবা নিয়ে এত অভিযোগ উঠত না। তিনি বলেন, ভারতে কিডনি প্রতিস্থাপনে খরচ অনেক কম। কিন্তু বাংলাদেশে বেশি। এসব বিষয়ে বিএমডিসি, স্বাস্থ্য অধিদফতর ভূমিকা রাখতে পারে। তারা চিকিৎসা ও রোগ পরীক্ষার প্রতিটি ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ফি নির্ধারণ করে দিতে পারে। তাহলে এ খাতের নৈরাজ্য অনেকটাই কমে যাবে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর