জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থী আবু সাঈদের লাশ রাতেই দাফন করতে বলেছিল প্রশাসন। কিন্তু রাতে দাফন না করে পরদিন সকালে দাফন করা হয়। গতকাল বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ দেওয়া জবানবন্দিতে আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন এসব কথা বলেন। আবু সাঈদের লাশের বর্ণনা দিয়ে জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘লাশ বাড়িতে আনার পর গোসল করানোর সময় দেখি মাথার পেছন থেকে রক্ত ঝরছে। বুকে ছিল অসখ্য গুলির চিহ্ন। সারা বুক দিয়ে রক্ত ঝরছিল।’ সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চলার সময় গত বছর ১৬ জুলাই দুপুরে বেরোবির সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান আবু সাঈদ। এ ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রথম সাক্ষ্য দিলেন ৮০ বছর বয়সি মকবুল হোসেন। পরে তাঁকে জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। এদিন আবু সাঈদের গুলি লাগার দৃশ্য সরাসরি সম্প্রচার করা এনটিভির রংপুরের কর্মরত সিনিয়র রিপোর্টার এ কে এম মঈনুল হক এ মামলার দ্বিতীয় সাক্ষী হিসেবে নিজের জবানবন্দি তুলে ধরেন। তাঁকে আসামি পক্ষ্যের জেরা অব্যহত রয়েছে। আগামী ৭ সেপ্টেম্বর এ মামলায় পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দিন ধার্য রয়েছে।
জবানবন্দিতে মকবুল হোসেন বলেন, ‘২০২৪ সালের ১৬ জুলাই দুপুর ১২টার দিকে মাঠ (ফসলি জমি) থেকে বাড়িতে এসে দেখি সবাই কান্নাকাটি করছে। শুনতে পেলাম আবু সাঈদের গুলি লেগেছে। পরে জোহরের আগে শুনলাম আবু সাঈদ মারা গেছে।’ কাঁদতে কাঁদতে এ সময় আবু সাঈদের বাবা বলেন, ‘এই খবর শুনে দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জামাই বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ছেলের লাশ পায় নাই। পোস্টমর্টেমের জন্য লাশ মেডিকেলে নিয়ে গেছে। প্রথমে লাশ দেখতে চাইলে পুলিশ দেখতে দেয়নি। একপর্যায়ে ছেলে-জামাইয়ের চাপে দেখতে দেওয়া হয়।’
পরে কান্না থামিয়ে তিনি বলেন, ‘রাত সাড়ে তিনটার দিকে আবু সাঈদের লাশ বাড়িতে আনা হয়। প্রশাসনের লোকজন রাতেই লাশ দাফন করতে বলেন। কিন্তু আমরা রাজি না হওয়ায় পরদিন সকালে পরপর দুইবার জানাজা হয়। জানাজা শেষে আবু সাঈদের লাশ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।’ দাফনের জন্য আবু সাঈদের লাশ যখন গোসল করানো হচ্ছিল, সে সময় দেখা লাশের বর্ণনা দিয়ে মকবুল হোসেন বলেন, ‘লাশ বাড়িতে আনার পর গোসল করানোর সময় দেখি মাথার পেছন থেকে রক্ত ঝরছে। বুকে ছিল অসংখ্য গুলির চিহ্ন। সারা বুক দিয়ে রক্ত ঝরছিল। পরে শুনতে পাই আমার ছেলেকে গুলি করে হত্যা করেছে এএসআই আমির হোসেন ও কনস্টেবল সুজন চন্দ্র।’ জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের কয়েক দিন আগে আবু সাঈদের গলা টিপে ধরে চড়থাপ্পড় মেরেছিলেন ছাত্রলীগ নেতা পমেল বড়ুয়া।’ তিনি বলেন, ‘আশা ছিল ছেলেটা সরকারি চাকরি করবে। কিন্তু সেই ইচ্ছা আর পূরণ হলো না। যেহেতু আমার ছেলে শহীদ হয়েছে। তাই আমি আশা করব আমার মৃত্যুর আগে যেন ছেলে হত্যার বিচার দেখে যেতে পারি।’ আবু সাঈদকে যারা নির্মমভাবে হত্যা করেছে তাদের সঙ্গে ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাদেরও বিচার চান মকবুল হোসেন।
এনটিভির লাইভে ধরা পড়ে গুলির দৃশ্য : এনটিভির সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে রংপুরে কর্মরত এ কে এম মঈনুল হক আবু সাঈদকে পুলিশের গুলি করার দৃশ্যের বর্ণনা দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া নিজের জবানবন্দিতে। তিনি বলেন, ‘২০২৪ সালের ১৬ জুলাই দুপুর ২টার আগে থেকে আমি এবং আমার সহকর্মী স্টাফ ক্যামেরাম্যান আসাদুজ্জামান আরমান রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১নং গেটের সামনে পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিলাম। কোটাবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছাত্রদের একটি মিছিল রংপুর প্রেস ক্লাব এলাকা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১নং গেটের সামনে আসে। এ সময় আন্দোলনকারী ছাত্ররা ১নং গেটের সামনে একটি পথসভা করার চেষ্টা করলে সেখানে আগে থেকে অবস্থান নেওয়া পুলিশ এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও তাদের সমর্থকরা বাধা দেয়।’
জবানবন্দিতে সাংবাদিক মঈনুল বলেন, ‘আন্দোলনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১নং গেট দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে যেতে চায়। এ সময় পুলিশ এবং তাদের সাথে যারা ছিল তারা বাধা দেয়। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করে। ফলে আন্দোলনকারীরা কিছুটা পিছিয়ে পার্কের মোড় অর্থাৎ বর্তমান আবু সাঈদ চত্বরের দিকে অবস্থান নিয়ে নিজেরা জোটবদ্ধ হয়ে স্লোগান দিতে থাকে। এ সময় পুলিশ টিয়ার শেল নিক্ষেপ, রাবার বুলেট ও শটগানের গুলিবর্ষণ শুরু করে।’
তিনি বলেন, ‘তখন দুপুর ২টা পার হয়ে গেছে। এনটিভির দুপুর ২টার খবরও শুরু হয়ে গেছে। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে আমি এবং আমার সহকর্মী আসাদুজ্জামান আরমান লাইভ ভিডিও অফিসে প্রেরণ করতে থাকি। দুপুর ২টা ১৩ মিনিটের দিকে এনটিভির ঢাকা অফিস থেকে দুপুরের খবরে লাইভে যুক্ত হওয়ার জন্য আমাকে নির্দেশ দিলে আমরা লাইভ ভিডিওর মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে ঘটনা তুলে ধরি এবং বর্ণনা দিতে থাকি। এনটিভির লাইভ সম্প্রচার চলাকালীন দুপুর ২টা ১৭ মিনিটের দিকে ১নং গেটের সামনে রোড ডিভাইডারের একটি ছোট কাটা অংশ দিয়ে এগিয়ে এসে কালো টি-শার্ট ও কালো প্যান্ট পরা এক যুবক রাস্তার ডিভাইডারের পাশে এসে দাঁড়িয়ে যায়। এ সময় সে দুদিকে দুহাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকে মাত্র কয়েক গজের দূরত্বে ১নং গেটের সামনে অবস্থানরত পুলিশ এই যুবককে উদ্দেশ করে গুলি করে। এই দৃশ্য তখন এনটিভিতে লাইভ সম্প্রচার চলছিল।’
তিনি বলেন, ‘পুলিশের গুলি এই যুবকের সামনের দিকে অর্থাৎ বুক ও পেটে লাগে। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ওই যুবক কয়েক পা পিছিয়ে যান এবং বসে পড়েন। এ সময় তাঁর অন্য সহযোগী কয়েকজন যুবক তাঁকে তুলে নিয়ে পার্কের মোড়ের দিকে নিয়ে যান। এরপর আমরা অন্য সহকর্মীদের মাধ্যমে ওই গুলিবিদ্ধ যুবককে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে জানতে পারি। এ ছাড়া জানতে পারি গুলিবিদ্ধ যুবক রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং তাঁর নাম আবু সাঈদ। বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে আমরা জানতে পারি গুলিবিদ্ধ আবু সাঈদ মৃত্যুবরণ করেছেন।’
এর চেয়ে লিডিং জবানবন্দি আমি দেখিনি : আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেনের জবানবন্দি যেভাবে নেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিনুল গণী টিটো। তিনি বলেছেন, ‘এর চেয়ে লিডিং জবানবন্দি আমি দেখিনি।’ গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ আইনজীবী আমিনুল গণী টিটো এ কথা বলেন।
‘লিডিং জবানবন্দি’ বলতে কী বুঝিয়েছেন, জানতে চাইলে আমিনুল গণী সাংবাদিকদের বলেন, ‘বলে বলে যে জবানবন্দিটা দেয়াইছে...প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে। এভাবে কোনো জবানবন্দি হয় না অ্যাকচুয়ালি। মানে ওভাবে বললে যে কেউ কোনো অ্যানসার করতে পারে।’
এ মামলার আসামি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলামের আইনজীবী আমিনুল গণী। তিনি মকবুল হোসেনকে জেরা করে বলেন, আবু সাঈদ হত্যার পর আপনার ছেলে রমজান আলী ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে মামলা করেছেন। এ সময় প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম বলেন, মকবুল হোসেন এ কমপ্লেন (মামলা) করেননি। আইন অনুযায়ী আপনি তাঁকে এই জেরা করতে পারেন কি না? জবাবে আমিনুল গণী বলেন, তাঁর ছেলে মামলা করেছেন, এটা উনি জানেন কি না, এটা আমার প্রশ্ন। সে সময় ট্রাইব্যুনাল বলেন, আপিল বিভাগের রায়ে বলা আছে, কোনো কন্ট্রাডিকশন নেওয়া যাবে না। একপর্যায়ে জেরা ডিক্লাইন (জেরা না করা) করেন আমিনুল গণী। চলতি বছর ১৩ জানুয়ারি ২৫ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এসে অভিযোগ দেন আবু সাঈদের পরিবারের সদস্যরা। এই অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু হয়।
গত ২৪ জুন চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (তদন্ত প্রতিবেদন) জমা দেয় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। সেই অভিযোগ ৩০ জুন আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। পরে ৬ জুলাই মামলার ‘আনুষ্ঠানিক অভিযোগ’ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেওয়া হয়। সেই ধারাবাহিকতায় ২৭ আগস্ট এ মামলায় সূচনা বক্তব্য দেন চিফ প্রসিকিউটর। এরপর গতকাল শুরু হয় সাক্ষ্য গ্রহণ। এ মামলার ৩০ জন আসামির মধ্যে ২৪ জনই পলাতক। গ্রেপ্তার ছয়জনকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। তাঁরা হলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলাম, সাবেক সহকারী রেজিস্ট্রার রাফিউল হাসান রাসেল, রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের চুক্তিভিত্তিক সাবেক কর্মচারী মো. আনোয়ার পারভেজ, পুলিশের সাবেক সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আমির হোসেন, সাবেক কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায় এবং নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা ইমরান চৌধুরী ওরফে আকাশ। সাক্ষ্য গ্রহণের আগে তাঁদের ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় তোলা হয়।