আলোচিত সেনা কর্মকর্তা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মহাপরিচালক এবং র্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি) অব্যাহতিপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানকে গ্রেপ্তারের পর আট দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। রাজধানীর খিলক্ষেত থেকে গত বৃহস্পতিবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অব্যাহতি পাওয়া মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান আদালতকে বলেন, ‘আয়নাঘর’ আমার সৃষ্টি নয়। আমাকেও আট দিন আয়নাঘরে রাখা হয়েছিল। গত ১৬ জুলাই রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় দোকান কর্মচারী শাহজাহান আলী হত্যা মামলার তদন্তে পুলিশ জিয়াউল আহসানের সম্পৃক্ততা খুঁজে পায়। হত্যা মামলার বাইরে তার বিরুদ্ধে গুম, খুন, অসংখ্য লোকের ফোনে আড়ি পাতার অভিযোগ রয়েছে। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পরদিন ৬ আগস্ট জিয়াউল আহসানকে সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। মিন্টো রোডের গোয়েন্দা দপ্তরে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিউমার্কেট থানার উপপরিদর্শক মো. সজিব মিয়া বিকাল ৪টা ৫০ মিনিটে তাকে আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। জিয়াউল আহসানের পক্ষে তার বোন অ্যাডভোকেট নাজনীন নাহার রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেন। শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আরফাতুল রাকিবের আদালত আট দিন রিমান্ডের আদেশ দেন। চাকরি থেকে অব্যাহতি পাওয়া মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান ২০২২ সাল থেকে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এর আগে তিনি ওই সংস্থার পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। জিয়ার বিরুদ্ধে যত অভিযোগ : কল রেকর্ড ফাঁস করে তা ভাইরাল করে দেওয়া ও ছাত্র আন্দোলনের সময় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধের নেপথ্যে ছিলেন আলোচিত সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান। অভিযোগ রয়েছে, এনটিএমসির দায়িত্বে থাকাকালে একের পর এক কল রেকর্ড ফাঁস করেন তিনি। রাজনৈতিক ব্যক্তি থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য হুমকি এমন সব ব্যক্তির স্পর্শকাতর কল রেকর্ড জিয়াউল আহসানের নির্দেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন প্লাটফরমে ছড়িয়ে দেওয়া হতো। সূত্রে জানা গেছে, জিয়াউল আহসান এনটিএমসির দায়িত্বে থাকাকালে সংস্থাটির আড়ি পাতার সক্ষমতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা হয়। অনলাইন যোগাযোগমাধ্যমের মধ্যে ওয়েবসাইট ব্লগ, ইমেইলেও শতভাগ আড়ি পাতার সক্ষমতা রয়েছে সংস্থাটির। এ সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে জিয়াউলের নির্দেশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মোবাইল ফোনে আড়ি পাতা হতো। পরে প্রয়োজন অনুসারে তাদের কল রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হতো। এসব কল রেকর্ডের ওপর ভিত্তি করে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে সুশীলসমাজের অনেক লোককে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করা হতো। এনটিএমসি মোবাইল ফোনের ভয়েস ও এসএমএস, ল্যান্ডফোন ভয়েস এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আড়ি পাততে পারে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মধ্যে ফেসবুক, টুইটার (বর্তমানে এক্স), টেলিগ্রাম, ভাইবার, ইমো, স্কাইপি অ্যাপেও আড়ি পাততে পারে এনটিএমসি। এসব সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে দিনের পর দিন অন্যায়ভাবে মানুষের কল রেকর্ড ফাঁস করা হয়েছে। জিয়াউল আহসানের নির্দেশে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করা হয় : অভিযোগ উঠেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় যতবার ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ ছিল তা জিয়াউল আহসানের নির্দেশে করা হয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলার সময় ১৭ জুলাই রাত থেকে মোবাইল ইন্টারনেট ও ১৮ জুলাই রাত ৯টার দিকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায় জিয়াউল আহসানের নির্দেশে। টানা পাঁচ দিন সব ধরনের ইন্টারনেট বন্ধ ছিল। মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ ছিল ১০ দিন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগমাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপের মতো সেবা বন্ধ ছিল ১৩ দিন। সূত্র জানান, ১৭ জুলাই থেকে ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশনাগুলো মূলত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা সংস্থা এনটিএমসি থেকেই আসতে থাকে। গুম খুনের অভিযোগ : অভিযোগ উঠেছে, ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ঢাকা ও ঢাকার বাইরে অসংখ্য গুমের ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন এই সাবেক সেনা কর্মকর্তা। ওই চার বছর তার ইশারায় চলত পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট র্যাব। ওই সময়ে তিনি র্যাবের ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের প্রধান এবং অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অভিযোগ উঠছে, ২০১৪ সালে নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত সেভেন মার্ডারেও তার হাত ছিল। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ থেকে ব্যবসায়ী আবু বক্কর সিদ্দিককে অপহরণের ঘটনায়ও তার হাত ছিল। সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর চৌধুরী আলম এবং বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলী গুমের ঘটনায় জিয়াউল আহসানের হাত ছিল।
আয়নাঘর আমার তৈরি না : জিয়াউল আহসানের আইনজীবী নাজমুন নাহার আদালতকে বলেন, তার মক্কেল কখনো ডিজিএফআইয়ে কর্মরত ছিলেন না। তিনি ‘আয়নাঘর’ (গোপন বন্দিশালা) বানাননি। ফেসবুকে তাকে নিয়ে মিডিয়া ট্রায়াল করা হচ্ছে। গত ৭ আগস্ট বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয়। বাদীপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ উল্লাহ খান আদালতকে বলেন, জিয়াউল আহসান গুম খুনের নায়ক। তিনি ‘জেনোসাইড’-এর সঙ্গে যুক্ত। আয়নাঘরের জনকও তিনি। দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার ক্রীড়নক হিসেবে তিনি কাজ করেছেন। তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত। সদ্যসাবেক এই সেনা কর্মকর্তা ২০১২ সালের পর থেকে এক যুগ ধরে ভিন্ন রাজনৈতিক মতাবলম্বীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে অপহরণ ও গুমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। শুনানির এক পর্যায়ে জিয়াউল আহসান আদালতকে বলেন, ‘আমাকে ৭ আগস্ট বাসা থেকে নিয়ে গেছে। আমি আয়নাঘরে ছিলাম। আমি কোনো আয়নাঘর বানাইনি। আমার হার্টের ৭০ ভাগ ব্লকড। আমাকে স্বেচ্ছায় অবসর দেওয়া হয়েছে। আমি কখনো ধানমন্ডিতে যাইনি। এনটিএমসি কেবল ডিজিটালি গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করেছে। আমার নামে আগে কখনো মামলা হয়নি।’ ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্যে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এরপর গত মঙ্গলবার মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার কথা জানায় আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)।