দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল খুলে দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে হলে উঠতে শুরু করেছেন শিক্ষার্থীরা। তবে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি তুলনামূলক কম। শিক্ষার্থীরা বলছেন, ক্লাস-পরীক্ষা শুরু করা হলে আবারও চিরচেনা রূপে ফিরবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক জানান, কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে সরকার পতনের আন্দোলন পর্যন্ত পুরো সময়জুড়েই উত্তাল ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আন্দোলন সমাপ্ত হওয়ায় ক্যাম্পাস শান্ত হলেও ফেরেনি স্বাভাবিক অবস্থায়। ৪ আগস্টের সমাবেশেই শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু হল খুলে অবস্থান নেন। এর পর ৫ আগস্টের সমাবেশের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হল খুলে ফেলেন শিক্ষার্থীরা। এদিন সরকার পদত্যাগের পর দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হলে ৬ আগস্ট থেকে শিক্ষার্থীরা হলে ফিরতে শুরু করেন। তবে অনেকেই একাডেমিক কার্যক্রম শুরু না হওয়া এবং হলের ক্যান্টিন বন্ধ থাকায় খাওয়াদাওয়ার সুযোগ না থাকায় ফিরছেন না ক্যাম্পাসে। এর ফলে এক প্রকার অচলাবস্থা বিরাজমান বিশ্ববিদ্যালয়ে। সরেজমিন দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা তুলনামূলক কম। তবে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী দু-একদিনে ফিরবেন বলে জানা যায়। ১৭ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে ছাত্রলীগের নেতাদের যেসব রুম ভাঙচুর করা হয়েছিল সেগুলো এখনো আগের মতোই রয়েছে। সেসব রুম পরিষ্কার করে শিক্ষার্থীরা নতুন করে ওঠার চেষ্টা করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের হল প্রশাসন থেকে দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী প্রথম বর্ষে ৪০ শতাংশ, দ্বিতীয় বর্ষে ২০ শতাংশ, তৃতীয় বর্ষে ১৫ শতাংশ, চতুর্থ বর্ষে ১০ শতাংশ, মাস্টার্সের জন্য ৫ শতাংশ শূন্য আসনে মেধার ভিত্তিতে এবং বিভিন্ন ক্লাবের জন্য ১০ শতাংশ সিট বণ্টনের কথা থাকলেও প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা আগের মতোই অবস্থান করছেন হলে। থাকছেন মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরাও। শিক্ষার্থীরা বলেন, আশা করি কিছুদিনের মধ্যেই সবাই হলে ফিরে আসবে। ক্যাম্পাসের অবস্থাও স্বাভাবিক হবে। আমরা হল প্রশাসনের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে হলগুলোতে সিট বণ্টন, হল সংসদ গঠন এসব বিষয় নিশ্চিত করব। হলে কোনোভাবেই আমরা অনিয়ম, রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালিত হতে দেব না। মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদেরও আমরা হলে রাখব না।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে নিয়মিত ছাত্রদলের নেতারা অবস্থান করছেন বলে জানান শিক্ষার্থীরা। এতে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। শিক্ষার্থীরা বলেন, আমাদের ক্যাম্পাসকে আমরা স্বৈরাচার মুক্ত করার জন্য এবং রাজনীতিমুক্ত করার জন্য আন্দোলন করেছি এবং করে যাব। ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের দেখছি ক্যাম্পাসে শো ডাউন দিচ্ছে। তারা যতই চেষ্টা করুক না কেন ক্যাম্পাসে কোনো রাজনৈতিক দলকে সুযোগ দেওয়া হবে না।
সূত্র থেকে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং হলগুলোর প্রাধ্যক্ষদের পদত্যাগের কথা রয়েছে। নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয় ও হল প্রশাসন গঠন করে ক্যাম্পাসের সুষ্ঠু অবস্থা ফিরিয়ে আনা হবে। রাবি প্রতিনিধি জানান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) আবাসিক হলে কোনো অছাত্র কিংবা অনাবাসিক শিক্ষার্থী থাকবে না। মেধা ও জ্যেষ্ঠতা বিবেচনায় সিট বরাদ্দ দেওয়া হবে। এ ছাড়া দ্রুতই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হবে। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্ত/নির্দেশনার আলোকে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। হলগুলোতে শিক্ষার্থী ওঠার ব্যাপারে কার্যক্রম চলছে। তবে আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত কক্ষগুলো মেরামতে এক সপ্তাহ নেওয়া হয়েছে। হলে অবস্থানকালে শিক্ষার্থীদের বৈধতা সংক্রান্ত বিধিবিধান অনুসরণ করতে হবে। আসন বরাদ্দবিহীন, মেয়াদোত্তীর্ণ, অথবা কোনো কারণে ছাত্রত্ব নেই, স্নাতকোত্তর চূড়ান্ত পরীক্ষা শেষ করেছে, অথবা স্নাতক/স্নাতক (সম্মান) পাস করেছে, কিন্তু নিয়মিত ব্যাচের সঙ্গে স্নাতকোত্তরে ভর্তি হননি এমন শিক্ষার্থী হলে অবস্থান করতে পারবে না। এ ছাড়া আন্দোলনে শহীদ সব শিক্ষার্থীর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।
শেকৃবি প্রতিনিধি জানান, বৈষম্যবিরোধী আন্দোনের পর রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো থমথমে পরিবেশ বজায় রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হল খোলা থাকলেও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি তুলনামূলক কম।
গতকাল সরেজমিন দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত শেখ হাসিনা পরিবার সংবলিত বিভিন্ন হল ও ভবনের নাম ফলক ভাঙছেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেদের শেখ লুৎফর রহমান হল এবং মেয়েদের কৃষকরত্ন শেখ হাসিনা হল ও শেখ সায়েরা খাতুন হলের নাম ফলক ভেঙে ফেলেন শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম প্রশাসনিক ভবন এবং শেখ কামাল ভবনের নাম ফলক ভেঙে ফেলেন তারা। এসব ভবন এবং হলের নাম কী হবে তা পরবর্তীতে ঠিক করা হবে বলে জানান শিক্ষার্থীরা।
এদিকে হল খুললেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস ও হলের ডাইনিং-ক্যান্টিন বন্ধ রয়েছে। হলগুলোতে ছাত্রদলের মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না দেওয়ার জন্য সচেষ্ট রয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
প্রভোস্ট কাউন্সিলের সভাপতি অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমি হল থেকে পদত্যাগ করেছি। এর আগ মুহূর্তে হলের ক্যান্টিন চালু রাখতে বলে এসেছি। ক্লাস শুরুর ব্যাপারে কৃষি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলি বলেন, শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরলেই ক্লাস শুরু হবে।
জবি প্রতিনিধি জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ছাত্রী হল খুলে ভিতরে প্রবেশ করেছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তবে কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের ছাত্রীদের হলে প্রবেশ করার খবর পাওয়া যায়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতির বিষয়ে রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক আইনুল ইসলাম বলেন, কয়েকজন শিক্ষার্থী এসেছিল হল খোলার বিষয়ে। আমরা তাদের বলেছি, নিরাপত্তাজনিত কারণে হলের প্রভোস্ট এবং আবাসিক শিক্ষকরা কেউ আসতে চাচ্ছেন না। তবে কিছু শিক্ষার্থী হলে প্রবেশ করেছে শুনেছি। তিনি আরও বলেন, আমরা আজ সকালে সিন্ডিকেট করে ক্লাস-পরীক্ষা ও হল খোলার বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেব। পাশাপাশি শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ক্যাম্পাসের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়ে আলোচনা করা হবে। সরকারপ্রধানের দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর দেশের চলমান উ™ভূত পরিস্থিতিতে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদত্যাগ করবেন এবং আমিও করব। তবে কবে নাগাদ পদত্যাগপত্র জমা দেবেন- এ বিষয় এড়িয়ে যান তিনি। ইবি প্রতিনিধি জানান, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখনো হল খোলার নোটিশ না দিলেও তিন দিন ধরে হলে অবস্থান করছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। পড়াশোনার স্বাভাবিক পরিবেশ তৈরি করতে সব শিক্ষার্থীদের হলে আসার অনুরোধ করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক এস এম সুইট। উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালাম বলেছেন, শিক্ষার্থীদের হলে শিক্ষার্থীরা থাকবে। এতে কোনো বাধা নেই।