রাজনীতিতে হতাশা বেড়েই চলেছে। দেশ যেন গণতন্ত্রের পথে কিছুতেই যেতে চাচ্ছে না। না নির্বাচন, না সংস্কার কোনোটাই হচ্ছে না। বিগত তিনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেখানে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করতে পেরেছে- সেখানে তার তিন গুণ সময় পার হলেও এখন পর্যন্ত নির্বাচনের রোডম্যাপই ঘোষণা করতে পারেনি অন্তর্বর্তী সরকার। ফ্যাসিস্টদের বিচারের বিষয়টিও চলছে অত্যন্ত ডিমেতালে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ সবেমাত্র আন্তর্জাতিক আদালতে উত্থাপিত হয়েছে। এসবের ফলে একের পর এক নানা ধরনের রাজনৈতিক জটিলতা তৈরি হচ্ছে দেশে। সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. ইউনূস তাঁর পদে থাকবেন, নাকি থাকবেন না- এনিয়েও গত কয়েকদিন সারা দেশে চলছে রুদ্ধশ্বাস আলোচনা। সব মিলে দেশের রাজনীতিতে নেমে এসেছে চরম এক হতাশা। বিএনপি, জামায়াত, নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, সিপিবি, লেবার পার্টিসহ বিভিন্ন দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এ হতাশার কথা জানা গেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এ প্রসঙ্গে বলেন, দেশ নির্বাচন, রোডম্যাপ, সংস্কার কিংবা গণতন্ত্র কোনো দিকেই এগোচ্ছে না। কোনো কিছু না করেই যদি ক্ষমতায় থাকা যায়- তাহলে নির্বাচন করার কী দরকার! ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসরদের বিচার কার্যক্রমটাও ভালোভাবে করতে পারছে না। ফলে মানুষের মাঝে এসব নিয়ে একটা হতাশা বিরাজ করছে। আসলে বিনা আন্দোলনে কোনো কিছুই অর্জিত হয় না। এসবের মাধ্যমে সরকারই রাজনৈতিক দলগুলোকে আন্দোলনের ক্ষেত্র তৈরি করে দিচ্ছে।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকার চাইলে ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন দিতে পারে। কিন্তু তাদের মধ্যে সেই সদিচ্ছা দেখা যাচ্ছে না। বরং নিজেদের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার একটি চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। বরং তারা কিছু সংস্কারের কথা বলে সময়ক্ষেপণ করতে চাচ্ছে। এটা ঠিক নয়। যেসব সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে তা ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়ন করে জাতীয় নির্বাচন করা সম্ভব। কিন্তু নির্বাচন, রোডম্যাপ ঘোষণা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা কোনো দিকেই এ সরকারের আগ্রহ নেই। উপরন্তু কতিপয় উপদেষ্টার বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের ফলে সরকার তার নিরপেক্ষতা হারাতে বসেছে। ফলে মানুষের মধ্যে দিনদিন হতাশা বাড়ছে। আমরা সরকারপ্রধানের সঙ্গে এসব বিষয়ে কথা বলেছি- দাবি জানিয়েছি। আমরা এখন সরকারের জবাবের অপেক্ষায় আছি।
জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, নির্বাচন নিয়ে যেটুকু সংকট বা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে- অন্তর্বর্তী সরকারের ‘নির্বাচনের তারিখ ও রোডম্যাপ’ ঘোষণার মধ্য দিয়েই এ জটিলতা কেটে যাবে।
গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষনেতা ও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জাতীয় নির্বাচনের তারিখ কিংবা রোডম্যাপ ঘোষণা দূরের কথা, এ পর্যন্ত একটা সংস্কারও সাধন করতে পারেনি অন্তর্বর্তী সরকার। ফলে মানুষ দিনদিন হতাশ হয়ে পড়ছে। প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিরপেক্ষ, অবাধ ও সুষ্ঠু একটি জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের মধ্য দিয়েই এ সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বর্তমান সরকার নির্বাচনের ব্যাপারে গড়িমসি করছে। এরই মধ্যে তিনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ পার করেছে। কিন্তু ১০ মাস পরও রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন নিয়ে আশ্বস্ত হতে পারছে না। নির্বাচন নিয়ে এখনো সন্দেহের দোলাচল চলছে। সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে নানা ধরনের সন্দেহ দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এর সমাধান হচ্ছে- রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা। কিন্তু সরকারের একেক উপদেষ্টা একেক বিষয় নিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন। এখন এমন সব এজেন্ডা নিয়ে তারা হাজির হচ্ছেন- যেগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের এখতিয়ারের একেবারেই বাইরে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স একই বিষয়ে বলেন, আমরা শুধু নির্বাচন চাই না। আমরা চাই প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচন। বর্তমান সরকার ইচ্ছা করলেই প্রয়োজনীয় এ সংস্কার শেষ করে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন দিতে পারে। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনও সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। এখন সরকার শুধু বললেই কমিশন নির্বাচনটা আয়োজন করতে পারে। কিন্তু কী কারণে সেটি হচ্ছে- বুঝতে পারছি না।
বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মুস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিতে না পারায় বর্তমান সরকারের দক্ষতা ও আন্তরিকতার ঘাটতি রয়েছে। নির্বাচন বিলম্ব করার এক ধরনের ইচ্ছা রয়েছে এ সরকারের। বিভিন্ন কারণে তারা যথাসময়ে নির্বাচন দেওয়ায় আগ্রহী নয়। অথচ নির্বাচন দিলে সব সমস্যারই সমাধান সম্ভব। অন্যথায় নির্বাচন বিলম্বিত হলে নানা ধরনের সংকট তৈরি হবে। সে কারণেই দেশবাসীর মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে।