মানুষ শখ করে কত ধরনের পাখি পোষে! কবুতর, তোতা, টিয়া, কাকাতুয়া, জোড়ায় জোড়ায় লাভ বার্ড! আর আমি কিনা পুষি সবার অপছন্দের পাখি কালো কাক! তা-ও খাঁচায় বন্দি করে নয়, মুক্ত রেখেই। আমার সেই পোষা কাকগুলো সারা দিন যথেচ্ছ উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়ায়, সন্ধ্যা হলে ভালো ছেলের মতো ঘরে ফিরে আসে। বাসার পেছনের বারান্দায় স্তূপ করে ফেলে রাখা ভাঙা চেয়ার, নষ্ট হয়ে যাওয়া জং ধরা বাইসাইকেল, পা-ভাঙা সোফা আর পুরনো আলমারির খোঁপের ভিতর ঢুকে আরাম করে ঘুমায়।
মাঝে মাঝে তারা কোথাও যায় না, বারান্দার রেলিংয়ে চুপচাপ ধ্যান-মগ্ন ঋষির মতো বসে থাকে। এদিক ওদিক মাথা নাড়ায়, ক্ষিদে পেলে গৃহস্থালি ময়লা ফেলার ঝুড়ি থেকে নিজেদের পছন্দ মতো খাবার খুটে খায়।
ওদের আমি খুব বেশি ঘাঁটাই-টাটাই না, নিজের মতোই থাকতে দিই। দূর থেকে ওদের হাব-ভাব দেখি। মাঝে মাঝে যখন কাকদের মুড খুব ভালো থাকে, তখন ওরাই আমাকে ডাকে গল্প-গুজব করার জন্য, বিশেষ করে যখন প্রখর জোছনার প্লাবনে চরাচর ভেসে যায়, কাক সমাজ চাঁদের আলোকে দিন ভেবে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, তখন কাকদের কথা বলার ইচ্ছা জাগে। এমনিতে কাকের গলার স্বর কর্কশ। কিন্তু যখন কথা বলে তখন ওদের গলা খুব মিষ্টি শোনায়। পাতিকাকের গলা শুনলে মনে হয়, একটা অল্প বয়সের মেয়ে টুক্্ টুক্্ করে কথা বলছে।
দাঁড়কাকের কণ্ঠ আবার বেশ ভরাট, মনে হয় যেন কোনো বিখ্যাত আবৃত্তিকারের গম্্গমে কণ্ঠস্বর শুনছি।
আমাদের আলাপ বিচিত্র বিষয়ে প্রবাহিত হয়। কাকেরা বলে, গাছের আত্মাকে তারা দেখতে পায়। কারণ আত্মা একটা পাতলা ছায়ার মতো গাছের গায়ে লেপ্টে থাকে। ‘মানুষ কিছুই দেখে না, তাদের চোখ বড় সাধারণ’- দাঁড়কাক তার মোটা ঠোঁট নাড়িয়ে গম্ভীর কণ্ঠে মন্তব্য করে।
পাতিকাক বলে, আকাশে ভেসে চলা মেঘের ভাষা ওরা বুঝতে পারে। মেঘগুলো নাকি সারাক্ষণ বালিকা স্কুলের চপলা মেয়েদের মতো নিজেদের মধ্যে পুটুস পুটুস কথা বলতেই থাকে। সেসব কথার শুরুও নেই, শেষও নেই, আগাও নেই, মাথাও নেই।
কখনো আমি প্রসঙ্গের বাইরে গিয়ে নির্বোধের মতো ওদের প্রশ্ন করে বসি,
‘আচ্ছা, বলো তো কাক কেন কাকের মাংস খায় না?’
‘কাক কি মানুষ নাকি হুম? নীতি বিসর্জন দিয়ে স্বজাতির ক্ষতি করবে?’
তাচ্ছিল্য ভরে আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তারা নিজেদের মতো কথা বলে যায়।
বলে, ‘এই যে আমাদের দেখছো, এটা আমাদের দ্বিতীয় রূপ। আদিতে কাকের গায়ের রং ছিল ধবধবে সাদা, বুঝলা? সাদা পালক, গোলাপি ঠোঁট, গোলাপি পা। আমাদের পাখায় ছিল প্রচণ্ড শক্তি। তীব্রগতিতে উড়তে পারতাম, কখনো কখনো ছুঁয়ে ফেলতাম সূর্যের শরীর, চাঁদের হাত-পা। এতে খুব হিংসা হলো সূর্যের। সে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে আমাদের পূর্বপুরুষদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এলো। তারপর নিজের উত্তাপের অহংকার দিয়ে আমাদের পুড়িয়ে কয়লার মতো কালো বানিয়ে দিল, আমাদের গায়ের রং গেল পাল্টে...’
‘ঠিক নয়।’ আমি সঙ্গে সঙ্গে বাধা দিয়ে বলি, ‘টেড হিউজের কবিতায় আছে, আসলে নিজের চাইতে সাদা আর উজ্জ্বল সূর্যকে দেখে কাকের হিংসা হয়েছিল, কাকই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আক্রমণের, নখর শাণিয়ে সেই ছুটে গিয়েছিল সূর্যের দিকে আর পরাজিত হয়ে কয়লার কালো নিয়ে ফিরে এসেছিল।’
‘ইতিহাস বিকৃতি’ দাঁড়কাক ভারী কণ্ঠে বলে।
‘না জেনে কি সব লিখেছে।’ পাতিকাক হাসতে থাকে।
কাকের হাসি, মানব শিশুর কান্নার শব্দের মতো, ওয়া ওয়া ওয়া, কিন্তু খুবই মধুর ও ছন্দময়। সেই ছন্দের মাধুর্যে আমি আচ্ছন্ন ও আকৃষ্ট হই। সব মিলিয়ে কাক আমার প্রিয় পাখি হয়ে যায়। কাক আমি ভালোবাসি। কাকের সত্যি তুলনা নেই। ‘কলসের মধ্যে পাথর ফেলে তৃষ্ণার্ত কাকের পানি উপরে তুলে এনে খাওয়ার’ সেই গল্পটি পড়ার সময় থেকেই আমি এদের ব্যাপক ভক্ত। বুদ্ধিমান বলেই না কাক এভাবে পানি খেতে পেরেছিলো, বলো!
আমার এই কাকপ্রীতি দুচক্ষে দেখতে পারে না অনিতা। অনিতা সূর্যের মতো সুন্দরী। সে কাককে মনে করে অশুভ আর অর্থহীন। অনিতা কাক ঘৃণা করে। আমার মনে হয়, অনিতা আমাকেও ঘৃণা করে। কিন্তু আমি অনিতাকে ভালোবাসি, যেমন ভালোবাসি কাক’কেও। অনিতার পছন্দ সাহসী ঈগল, অনেক উঁচুতে যারা স্থির হয়ে ভেসে বেড়ায়।
কাক তার পুরনো কথার জের ধরে বলে, ‘জেনে রাখো, নিজের অহংকারে সূর্য নিজেই একদিন কালো হয়ে যাবে, তার গায়ে অজস্র ফুটকির মতো উড়তে থাকবে কাক। তার পোশাক হলুদ হবে, তার আলো ম্লান হবে, তখন একটি কালো সূর্য জন্ম নেবে।’
কাকের কথার মর্ম না বুঝে আমি চুপ করে থাকি। কাক আবারও বলে,
‘তোমরা তো শুধু আমার কালো শরীর দেখো। এই কালোর মধ্যে কত রং লুকিয়ে থাকে, জানো? জানো, ঘন ঘাসের আসল রহস্য কী? জানো, পেঁচা কীভাবে কাকের শত্রু হলো? বুনো ফুলে কেন এতো সুগন্ধ ঝরে পড়ে, মেঠো ইঁদুর কোথায় লুকিয়ে রাখে কৃষকের ধান? ধুলোয় গড়িয়ে চলা একহারা সাপ মাটির সঙ্গে রসিকতা করে কী কথা বলে, জানো সেটা? জোনাকী পোকা খেতে কেমন লাগে, বলতে পারো তোমরা?’
ওদের ধারাবাহিক প্রশ্নের সামনে আমি বোকা হয়ে, বোবা হয়ে যাই, আর ভাবি এরা অবশ্যই চতুর, এরা নিশ্চয়ই বিভ্রান্তিমূলক, এরা যুগপৎ পরিশীলিত আবার জটিল।
অনিতা আমার উপলব্ধি শুনে মুখ ফিরিয়ে থাকে। তীব্র গলায় বলে, ‘তুমি উন্মাদ। তুমি নোংরা। তুমি নিজেই একটি মানুষরূপী কাক।’
অনিতাকে মনে হয় চুলার উপরে জ্বলতে থাকা ফুটন্ত পানি, নৃত্যরত আগুন, আমি অনিতাকে ছুঁতে গিয়ে পুড়ে যাই, ডুবে যাই, গলে যাই, মরে যাই। মুমূর্ষু কণ্ঠে বলি, ‘অনিতা আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি।’ অনিতা একথা শুনে আরও রেগে যায়। বলে, ‘আগে, কুৎসিত কাকদের তাড়াও, তারপর ভালোবাসার কথা বলতে এসো।’
অমি মাথা নিচু করে বসে থাকি। অনিতা অবশেষে আমাকে পরিত্যাগ করে।
আমি ভাঙা মন নিয়ে আমার ভাঙা বারান্দায় ফিরে যাই। কাকেরা আমাকে দেখে নিঃশব্দে এগিয়ে আসে।
‘কাক কি তবে দুঃখ বোঝে? প্রেম বোঝে? বিরহ? বেদনা? কবিতা? প্রথম দর্শনে তীব্র ভালোবাসা, ওরে কাক, তুই কী বুঝিস এসব? মহামান্য কাক, বলুন, অশ্রু হাহাকার তৃষ্ণা আর মুগ্ধতার মোহ আলোড়িত করে কি আপনাকে? ’
নবজাতকের কান্নার মতো মধুর শব্দ করে হাসে কাক। তার মৃদু হাসি ধীরে ধীরে অট্টহাসিতে পরিণত হয়। আমি দেখি, পোষা বায়স-কুল একসঙ্গে ডানা ঝাপটায়। যেন এক্ষুনি তারা আমার প্রশ্নের উত্তর দেবে, নরম কোন কথায় আমার ক্ষতে প্রলেপ লাগিয়ে দেবে, আমি ভাবি, কিন্তু বাস্তবে তারা দল বেঁধে উড়ে যায়। বলে ‘কা, কা, কা...’
‘উত্তর নিয়ে ফিরে আসিস-’ আমি পেছন থেকে চিৎকার করে বলি।
পরদিন দেখি কাক নয়, অপ্রত্যাশিতভাবে এক কোকিল এসে বসে আছে বারান্দার নোংরা রেলিংয়ে। অদ্ভুত! কোকিল বড় অসামাজিক হয় জানি, পাতার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখে, সে কেন আজ এলো এখানে? কাকের বাসায় চুপি চুপি ডিম পাড়তে এসেছে?
কোকিল তার সুমিষ্ট কণ্ঠে বলে, ‘না গো না... তুমি নাকি কীসব দুঃখ, প্রেম আর বেদনার কথা জানতে চাইছো, তাই কাকেরা পাঠালো আমাকে, পক্ষীকুলে এসব নিয়ে আমিই চর্চা করি কি-না। আমিই তো ঘর না বাঁধা উদাস পাখি, গান গাই, গান বাঁধি।’
কোকিলকে আমার কিছুটা চপল আর চঞ্চল মনে হয়। যেন সে অস্থির, নিরাশ্রয় আর পথভ্রষ্ট। তবু তার কাছে জানতে চাই, ‘বলো হে সুরের পাখি, বসন্তের দূত, প্রাণীজগৎ কেন পা রাখে প্রেমের পথে...’
কোকিল বলে, ‘এর উত্তর জানি না। শুধু জানি এটাই নিয়তি। প্রেমে তোমার অন্তর রক্তাক্ত হবে আর সেই রক্ত থেকে গোলাপ ফুটবে। তার সুগন্ধে আমোদিত হবে চারপাশ।’
‘প্রেম কেন বেদনা হয়ে জেগে ওঠে?’
কোকিল বলে, ‘তুমি কি জানো না প্রেম এক আগুনের নাম, পোড়ানোই তার ধর্ম, সমস্ত উড়ন্ত পতঙ্গই তা জানে...’
‘তবে পরিত্রাণের উপায় কী, হে সুকণ্ঠ পাখি...’
কোকিল শূন্যে তার ডানা মেলে দেয়, বলে, ‘পরিত্রাণ আমার জানা নেই হে সম্মানিত প্রশ্নকারী, বিদায়।’
আমি আকুল হয়ে জানতে চাই, ‘আমার প্রিয় কাকেরা কোথায় গেল?’
কোকিল বলে ‘তারা আরও গভীর আরও মহৎ আরও গোপন বিষয় নিয়ে ব্যস্ত আছে। .. বিদায়।’
কোকিলের এ কথা শুনে আমার রাগ হয়, মনে মনে বলি, ‘প্রেমের চাইতে গভীর, প্রেমের চাইতে মহৎ, প্রেমের চাইতে গোপন আর কী থাকতে পারে? কুৎসিত কাকেরা কি নিয়ে এত ব্যস্ত? কোথায়, কোন আবর্জনা ঘাঁটতে গেছে তারা?’
আমার অন্যমনস্কতার সুযোগে উড়ে যায় পরভৃৎ কোকিল।
উড়ার আগে কাঁপা কণ্ঠে জানিয়ে যায়, ‘জগৎ পরিদর্শন শেষে ফিরে আসবে কাকেরা। তাদের ডানায় বিস্তৃত হয়ে আছে বাতাসের গতি। বিদায়, ওহে প্রশ্নকারী প্রাণী, বিদায়।’
আমি বারান্দার একটা ভাঙা চেয়ারে বসে এক মনে আমার পোষা কাকদের জন্য, জগতের জ্ঞানবান পাখিদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি।
আমার চেহারা আগে থেকেই বেশ কালো ছিল, রোদে বসে থাকতে থাকতে সেই চেহারা আরো কালো হয়ে যায়। আমি শোকমগ্ন কালো পোশাক পরে এক ঠাঁয় বসে থাকি। কাকেরা ফিরে আসে না। আমি তখন ভাবি, কাকরা না ফিরলে অনিতা হয়তো ফিরে আসবে। কিন্তু অন্তহীন শব্দহীনতায় ডুবে থাকে চারপাশ। নৈঃশব্দ ভেঙে দিয়ে কেউ ফেরে না।
আমার গায়ে ধীরে ধীরে কালো মসৃণ পালক গজায়। আমার ঠোঁট লম্বা, সরু ও শক্ত হতে থাকে। কণ্ঠ হয় কর্কশ। আমার দৃষ্টি তীক্ষè হয়। তবু অনিতা বা কাক, কারোর দেখা মেলে না।
তারপর এক রাতে চরাচর ভাসিয়ে তরল রুপার মতো উজ্জ্বল সাদা জোসনা নামে।
মনে হয়, রাত শেষে আলোময় ভোর এসে গেছে। আমি নিজের মধ্যে এক ধরনের বন্য অস্থিরতা অনুভব করি। আর তখনই শুনতে পাই পাখা ঝাপটানোর পরিচিত শব্দ। দেখি কাকের দল ফিরে আসছে।
তারা এসে পুরনো বন্ধুর মতো, শোকগ্রস্ত স্বজনের মতো আমাকে ঘিরে বসে। বলে,
‘কতদিন আর এমন চিন্তিত ও ব্যথিত থাকবে, হে সহমর্মী মানুষ? এবার, আমাদের সঙ্গে চলো, তোমাকে জ্ঞানবৃক্ষের কাছে নিয়ে যাই।’
আমি তাদের সঙ্গে ডানা মেলে দিই। একটা বিশাল দাঁড়কাক হয়ে অসংখ্য কাকের সঙ্গে আকাশ ছুঁয়ে নির্ভার উড়তে থাকি।