দুনিয়া কাঁপানো কিংবদন্তি বিপ্লবী, মহানায়ক কমরেড চে গুয়েভারা ১৭ বছর বয়সে তাঁর প্রথম প্রেমিকাকে নেরুদার কবিতা শুনিয়েছিলেন। তারপর সারা জীবন এ কবির লেখা সঙ্গে নিয়ে ঘুরেছেন। সিয়েরা মায়েস্ত্রার গেরিলা যুদ্ধের সময় বিকালবেলায় কমরেড চে তাঁর সৈন্যদের নেরুদার ‘ক্যান্ত জেনেরাল’ থেকে কবিতা পড়ে শোনাতেন। ১৯৬৬ সালে তিনি যখন বলিভিয়ার উদ্দেশে রওনা হন, তখন তাঁর স্ত্রীর জন্য নিজের কণ্ঠস্বরে রেকর্ড করে এসেছিলেন নেরুদার প্রেমের কবিতা। আর ১৯৬৭ সালের অক্টোবর মাসে বলিভিয়ায় আহত কমরেড চে যখন ধরা পড়েন এবং পরদিন সিআইএ যখন তাঁকে হত্যা করে, সেই সময় এ বিপ্লবীর ব্যাকপ্যাকে পাওয়া গিয়েছিল সবুজ রঙের নোটবুক। সেখানে চারজন কবির লেখা ঊনসত্তরটা কবিতা ছিল, যার বেশির ভাগই নেরুদার লেখা।
সাহিত্যে নোবেলজয়ী কবি ও বিপ্লবী রাজনীতিক কমরেড পাবলো নেরুদা বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও প্রভাবশালী লেখক। ২৩ সেপ্টেম্বর ছিল পৃথিবী বিখ্যাত কীর্তিমান এ সাহিত্যিকের ৫১তম মৃত্যুবার্ষিকী।
চিলিয়ান কালজয়ী কবি ও সাহিত্যিক পাবলো নেরুদা ১৯০৪ সালের ১২ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল নেফতালি রিকার্দো রেয়েস বাসোয়ালতো। পাবলো নেরুদা তাঁর ছদ্মনাম হলেও পরে নামটি আইনি বৈধতা পায়। কৈশোরে তিনি এ ছদ্মনামটি গ্রহণ করেন। ছদ্মনাম গ্রহণের পেছনে দুটি কারণ ছিল। প্রথমত, ছদ্মনাম গ্রহণ ছিল সে যুগের জনপ্রিয় রীতি; দ্বিতীয়ত, এ নামের আড়ালে তিনি তাঁর কবিতাগুলো নিজের পিতার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতেন। তাঁর পিতা ছিলেন কঠোর মনোভাবাপন্ন ব্যক্তি। তিনি চাইতেন তাঁর পুত্র কোনো ‘ব্যবহারিক’ পেশা গ্রহণ করুক। নেরুদা নামটির উৎস চেক লেখক জান নেরুদা এবং পাবলো নামটির সম্ভাব্য উৎস হলেন পল ভারলেইন। পাবলো নেরুদাকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও প্রভাবশালী লেখক মনে করা হয়। তাঁর রচনা অনূদিত হয়েছে অনেক ভাষায়।
নেরুদার সাহিত্যকর্মে বিভিন্ন প্রকাশশৈলী ও ধারার সমাবেশ ঘটেছে। একদিকে তিনি যেমন লিখেছেন টোয়েন্টি পোয়েমস অব লাভ অ্যান্ড অ্যা সং অব ডেসপায়ার-এর মতো কামোদ্দীপনামূলক কবিতা সংকলন, তেমনি রচনা করেছেন পরাবাস্তববাদী কবিতা, ঐতিহাসিক মহাকাব্য, এমনকি প্রকাশ্য রাজনৈতিক ইস্তেহারও। ১৯৭১ সালে নেরুদাকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য তাঁকে এ পুরস্কার প্রদান নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। কলম্বিয়ান ঔপন্যাসিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস একদা নেরুদাকে ‘বিংশ শতাব্দীর সব ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি’ বলে বর্ণনা করেন।
১৯৪৫ সালের ১৫ জুলাই, ব্রাজিলের সাও পাওলোর পাকিম্বু স্টেডিয়ামে কমিউনিস্ট বিপ্লবী নেতা লুইস কার্লোস প্রেস্টেসের সম্মানে ১ লাখ লোকের সামনে ভাষণ দেন নেরুদা। নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করার পর চিলিতে ফিরলে সালভাদর আলেন্দে এস্ত্যাদিও ন্যাশনালে ৭০ হাজার লোকের সামনে ভাষণ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান।
জীবদ্দশায় নেরুদা একাধিক কূটনৈতিক পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। এক সময় তিনি চিলিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির সিনেটর হিসেবেও কার্যভার সামলেছেন। কনজারভেটিভ চিলিয়ান রাষ্ট্রপতি গঞ্জালেস ভিদেলা চিলি থেকে কমিউনিজম উচ্ছেদ করার পর নেরুদার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে তাঁর বন্ধুরা তাঁকে চিলির বন্দর ভালপারাইসোর একটি বাড়ির বেসমেন্টে কয়েক মাসের জন্য লুকিয়ে রাখেন।
পরে গ্রেপ্তারি এড়িয়ে মাইহু হ্রদের পার্বত্য গিরিপথ ধরে তিনি পালিয়ে যান আর্জেন্টিনায়। কয়েক বছর পরে নেরুদা সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রপতি সালভাদর আলেন্দের ঘনিষ্ঠ সহকারীতে পরিণত হন।
চিলিতে অগাস্তো পিনোচেটের নেতৃত্বাধীন সামরিক অভ্যুত্থানের সময়ে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন নেরুদা। তিন দিন পরেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৭৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মৃত্যু হয় তাঁর।
জীবন্ত কিংবদন্তি নেরুদার মৃত্যুতে স্বাভাবিকভাবেই সারা বিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। পিনোচেট নেরুদার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াকে জনসমক্ষে অনুষ্ঠিত করার অনুমতি দেননি। যদিও হাজার হাজার শোকাহত চিলিয়ান সে দিন কারফিউ ভেঙে পথে ভিড় জমান। পাবলো নেরুদার অন্ত্যেষ্টি পরিণত হয় চিলির সামরিক একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রথম গণপ্রতিবাদে।
সমাজতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনায় সংগ্রামী একজন কবি পাবলো নেরুদা।
তাঁকে নিয়ে বিদগ্ধজনেরা নানাভাবেই আলোচনা করেছেন। এই বিদগ্ধজনদের আলোচনার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাদের থেকে ভিন্নভাবে এ মহান কবিকে নিয়ে কীভাবে আলোচনা করা যাবে, সেটাই মূল কথা। তিনি সেই সংগ্রামী কবি ‘পরিশ্রমী শব্দ’ চয়নে সংগ্রামী কবিতায় নতুনত্ব দিয়ে কবি মনের অভিপ্রায়কে যেমন ব্যক্ত করেছেন, তেমনি উজ্জীবিত করেছেন সংগ্রামী চেতনা।
চিলির একজন রেল শ্রমিকের সন্তান মহান কবি কমরেড পাবলো নেরুদা। তিনি সমাজতান্ত্রিক মন ও মননে সংগ্রামী চেতনার কবি। যিনি বিশ্বময় নিজেকে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন।
‘পাবলো নেরুদার কবিতার শব্দ চয়নের মধ্যে ক্ষোভ, ক্রোধ রয়েছে।’ তাঁর কবি মনের চিন্তার গভীর প্রবহমান স্রোত আমাদের উজ্জীবিত করে।
পাবলো নেরুদার কাব্যগ্রন্থ পাঠ করেছি কিশোর বয়সেই। সাহিত্য দর্পণের একজন কবি তাঁকে নিবেদন করে একটি পোস্ট দেওয়ায় পাবলো নেরুদার কথা মনে পড়ে গেল। তাঁকে নিয়ে যখন লিখতে বসেছি, আমার হাতের কাছে শুধু একটি কাব্যগ্রন্থ ‘পাবলো নেরুদার শ্রেষ্ঠ কবিতা’। এরপর সংগ্রহ করি নেরুদার শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘প্রশ্নপুস্তক’।
‘প্রশ্নপুস্তক’ কাব্যগ্রন্থটি অনুবাদ করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক রায়হান রাইন। তিনি ভবানীপ্রসাদ দত্তের অনুস্মৃতি থেকে অনূদিত কবি পাবলো নেরুদার বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। পাবলো নেরুদা বলেছেন, ‘আমার স্মৃতিজুড়ে আছে শুধু বৃষ্টি, বৃষ্টি আর বৃষ্টি। মেরু অঞ্চল থেকে, হর্ন অন্তরীপের আকাশ থেকে ফ্রন্টিয়ারে ঝেঁপে আসা প্রপাতের মতো সেই দারুণ দখিনা বৃষ্টি। এই ফ্রন্টিয়ারে, আমার দেশের বন্যা পশ্চিমে প্রথম চোখ মেলে তাকিয়ে চিনেছিলাম মাটি, কবিতা আর বৃষ্টি।’
১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর ওই বছরে অন্য নোবেল-বিজয়ীদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণটি তিনি শেষ করেছিলেন এভাবে- ‘আমরা আমাদের শোণিত ও তমসা দিয়েই তার (সাদা কাগজের) বুকভরে তুলি; কবিতা তো লিখতে হয় শোণিত ও তমসা দিয়েই।’
প্রশ্নপুস্তকের কবিতা নিয়ে এ লেখার শেষভাগে আলোকপাত করব। আমি শুরু করছি তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা গ্রন্থে গ্রন্থিত কয়েকটি কবিতা দিয়ে। অসীত সরকার তাঁর এই কবিতা বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন। এ অনুবাদ সাহিত্য আছে বলেই আমরা অন্য ভাষায় রচিত কবিতা পাঠ করতে পারছি। এ নিয়ে আলোচনা করতে সক্ষম হচ্ছি।
অনুবাদ খুব সহজ কাজ নয়। আবার কোনো কোনো সময় ভিন্ন ভাষায় রচিত কোনো লেখকের লেখার মনের ভাবের সঙ্গে পুরোপুরি তাঁর সেই মনোভাবের সংযোগে কিছু দূরত্ব থাকতে পারে। তারপরও যারা পরিশ্রম করে ভিন্ন ভাষার সাহিত্যের অনুবাদ করেন, তাঁরা চেষ্টা করেন মূল লেখকের মন-চিন্তা, দর্শনের কাছাকাছি যাওয়ার। কবি পাবলো নেরুদার ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ গ্রন্থের ভূমিকায় ওয়াল্ট হুইটম্যানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে; ‘তিনি মহান কবি, যিনি প্রতিটি শব্দে রক্ত ঝরাতে পারেন।’ পাবলো নেরুদা ঠিক সেই ধরনেরই সৈনিক-কবি, যিনি আজীবন মুখ চেয়ে মুমূর্ষু সমাজের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন।
নেরুদার সারা জীবনের সাহিত্য কৃতীজুড়ে রয়েছে সেসব অগণন নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষ। যাঁরা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মোৎসর্গ করেছেন, কিংবা শান্তির জন্য বুকে বুক দিয়ে আজও লড়ছেন।
পাবলো নেরুদা শুধু সমাজতান্ত্রিক চিন্তা এবং সময়ের ওপর ভর করে বিপ্লবী কবিতা লিখেছেন তা নয়। তিনি অনেক প্রেমের কবিতাও রচনা করেছেন। একজন বিশুদ্ধ রাজনীতিক শুধু সংগ্রাম-আন্দোলনকে বেশি প্রাধান্য দেন। একজন কবি ও রাজনীতিক সেটি করেন না। কারণ কবি মনের মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি প্রেমে সাড়া দেয়।
কবি পাবলো নেরুদা প্রেমের অনেক সুন্দর কবিতা লিখেছেন। অনেক কবিতার মধ্যে প্রেম এবং জীবনের চাহিদার কথা উচ্চারিত হয়েছে খুব সাবলীলভাবে। এখানে তিনি একজন সার্থক-সফল প্রেমের কবি। পাবলো নেরুদা কবিতার পাশাপাশি স্মৃতিকথা লিখেছেন। তাঁর উপলব্ধির গভীরতা দিয়ে রচিত স্মৃতিকথায় তাঁর রাজনৈতিক দর্শন উঠে এসেছে। তাঁর স্মৃতিকথায় অনেকের কথা উল্লিখিত হয়েছে। যাঁরা সবাই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে সমাজ বিনির্মাণের নেতা। আমাদের নিবন্ধের মূল বিষয় তাঁর স্মৃতিকথা নিয়ে নয়। কবি পাবলো নেরুদার কবিতা নিয়ে। তবুও তাঁর স্মৃতিকথার কথামালার কিয়দংশ উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি।
চিলির সন্তান এ মহান কবি পাবলো নেরুদার স্মৃতিকথা এক বিস্তৃত আঙিনা। এখানে আছেন লরকা, আরাগ, পিকাসো, রিভেরা, মহাত্মা গান্ধী, নেহরু, মাও সে তুং, ক্যাস্ট্রো, চে গুয়েভারা, আলেন্দর এবং বহু প্রতিভাবান সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক নেতা। এ থেকে সুধী-প্রজ্ঞাবান পাঠক বুঝতে পারছেন, কবি পাবলো নেরুদাকে। এরপর আমি আর কথা বাড়াব না। ফিরে যাব কবি পাবলো নেরুদার কবিতার আঙিনায়- পাবলো নেরুদা লিখলেন- ‘নারীর রমণীয় শরীর, সাদা পাহাড়, শুভ্র ঊরু,/আত্মদানের ভঙ্গিতে তুমি শুয়ে আছ, এ উর্বরা পৃথিবী।
আমার এ চাষাড়ে দেহ তোমাকে গভীরভাবে কর্ষণ করছে/যাতে মাটির গহন থেকে লাফিয়ে উঠতে পারে শিশু/...
অন্ধকার নদীগর্ভে চিরদিনই বহমান শাশ্বত অনন্ত তৃষ্ণা, /তারই পেছনে ত্রস্ত ধেয়ে আসে যত ক্লান্তি আর অন্তহীন ব্যথা’ (নারীর শরীর, পাবলো নেরুদার শ্রেষ্ঠ কবিতাগ্রন্থ)। কবি পাবলো নেরুদার প্রেমাশ্রয়ী এ কবিতায় জৈবিক চাহিদার কথা উচ্চারিত হয়েছে ভিন্নমাত্রায়। তাঁর এই নারী হলো পৃথিবীর উর্বর মাটি। যাকে চাষ করলে উঠে আসে শিশু। এই শিশু বলতে তিনি ফসলের চারাকে বুঝিয়েছেন। এখানেই কবি পাবলো নেরুদা।
পাবলো নেরুদা কবি হিসেবে অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। সাহিত্যের সঙ্গে নিত্যদিন যোগাযোগ আছে, অথচ লরকার নাম শোনেনি এ রকম সাহিত্যিকের সংখ্যা মনে করি নেহাতই কম। বিখ্যাত স্প্যানিশ কবি লরকার পুরো নাম ফেদেরিকো গার্থিয়া লরকা। কবি লরকাকে ফ্যাসিস্টরা ১৯৩৬ সালের আগস্ট মাসে গ্রানাডায় গুলি করে হত্যা করে।
এ সময়কালে অনেক কবি-সাহিত্যিককে হত্যা করা হয়। এ সময়কালটি এমন যে, ফ্যাসিবাদবিরোধী নামকরা কবিদের একেবারে নির্মূল করে পৃথিবীকে মেধাশূন্য করার পরিকল্পনা করা হয়। জীবদ্দশায় লড়াকু কবি লরকা পাবলো নেরুদা সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘রুবেন দারিওর মৃত্যুর পর পাবলো নেরুদা হলেন আমেরিকার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কবি।
বিশ্বনন্দিত শিল্পী পাবলো পিকাসো এবং প্রখ্যাত চেক সাহিত্যিক জাঁ নেরুদা এ দুজনের কাছ থেকেই তিনি নিজের নাম গ্রহণ করেন, ‘পাবলো নেরুদা’।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করেন ১৯২৬ সালে। চিলির সরকারি কর্তৃপক্ষ মাত্র তেইশ বছর বয়সী প্রতিভাবান পাবলো নেরুদাকে রেঙ্গুনে রাষ্ট্রদূত করে প্রেরণ করে। এ পদে অধিষ্ঠিত থাকার ফলে তিনি বহু দেশ ভ্রমণ করেন। এর মধ্যে ভারতবর্ষ, জাপান, চীন, জাভা, কলম্বো, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি।
কবি পাবলো নেরুদার সময়কাল গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত হয়েছে। ভয়ংকর-ভয়াবহ সময়। এ সময় মন জগৎকে শান্ত রেখে সংগ্রামীদের সাহস দিতে কবিতা লেখা খুব সহজ কাজ নয়। যুক্তি দিয়ে নিজেকে বোঝা, পরিবেশকে উপলব্ধি করা আর জীবনের প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর হাতছানি এ পরিবেশের মধ্যে কবিতা রচনা করা, তাও আবার ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে, এটি খুব সহজ কাজ নয়। অত্যন্ত মেধাবী কবি পাবলো নেরুদা কবিতার মধ্যেও নিপীড়িত মানুষ, বুলেটে ক্ষতবিক্ষত লাশ, হাড়গোড় নিয়ে পড়ে থাকা মানুষের জন্য লড়েছেন কলম হাতে একজন কবি এবং রাজনৈতিক নেতা হিসেবে।
বার্লিন পুড়ছে। খনি শ্রমিকদের গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। ১৯৩৬ সালে জুলাই মাসে স্পেনে আক্রমণ করা হলো। গৃহযুদ্ধের এ আগুনের প্রচণ্ড তাপ পাবলো নেরুদাকেও স্পর্শ করল। কবি পাবলো নেরুদা মুক্তিযোদ্ধাদের দলে যোগ দিলেন। ‘ফ্রাংকো আর ফ্যাসিস্ট সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে স্পেনের জনগণের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের সেই অগ্নিময় দিনগুলোতে নেরুদা রচনা করলেন, তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘প্রাণের স্পেন’ (১৯৩৮)।’
‘পাবলো নেরুদা ১৯৪০-১৯৪৩ সাল পর্যন্ত মেক্সিকোতে চিলির রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেন। ১৯৪৫ সালে চিলির কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়ে সিনেটর নির্বাচিত হন।’ খনি শ্রমিকদের সংগঠন গড়ে তোলেন। নেরুদার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলো, তাঁর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হলো। পাবলো নেরুদা দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হলেন। তারপরও থেমে থাকেনি তাঁর কলম। তিনি পলাতক সময়ে তাঁর স্মৃতিকথায় লিখলেন- ‘পলাতক’ নামে দীর্ঘ কবিতা।
পাবলো নেরুদাকে বহু গুণগত বিশেষণে বিশেষায়িত করলেও, মনে হয় তাঁকে অনেক বিশেষণে ভূষিত করা হলো না। তিনি প্রেমের কবি, মানবতার কবি, বিপ্লবের কবি, সমাজতান্ত্রিক চেতনার কবি। সুন্দর পৃথিবীর জন্য এক লড়াকু সৈনিক রাজনৈতিক নেতা এবং কবি। সবগুণেই তাঁকে গুণান্বিত করা যায়।
দক্ষিণ চিলির এক প্রত্যন্ত গ্রামের নাম ‘পাররাঙ্গল’। এখানেই তাঁর জন্ম। জন্মের মাত্র এক মাস পর তাঁর মা দোনা রোসা বাসোআলতো মারা যান। মাতৃহারা এ শিশুসন্তানকে নিয়ে পিতা রেলের ইঞ্জিনচালক দোন হোসে দেল কার্মেন রেইয়েসে মোরালেসা আরেক জীর্ণ গ্রাম তেমুকোতে চলে আসেন। এ গ্রামে থাকাকালে দরিদ্র পরিবারের সন্তান পাবলো নেরুদা শৈশবকালে তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা কবিতায় বর্ণনা করলেন : ‘আমি বাস করছি তেমুকো,
আর আমার থাকার ঘরের বাতায়ন পথে / দুচোখ মেলে দেখি আমি কাদা আর কাদা আর এই কর্দমাক্ত পথে... চলে যেত কাঠের আচ্ছাদনে আবৃত ঠেলাগাড়িগুলো/কী তাদের আর্তনাদ! এক ভয়াবহ যন্ত্রণা যেন তাদের।’
শৈশব মনেই জেগে ওঠে মানুষের কষ্টের আওয়াজ এ কবিতায়। কাদা পথে ঠেলাগাড়িওয়ালারা কত কষ্ট করে ঠেলে নিয়ে যায় গাড়ি। কবি পাবলো নেরুদার শৈশব মনে এ ছবি ধরা পড়ে। সাহিত্যে নোবেলবিজয়ী কবি পাবলো নেরুদা এক অসাধারণ, প্রজ্ঞাবান কবি, রাজনৈতিক নেতা এবং কূটনীতিক ছিলেন। তাঁর কবিতায় (যেগুলো বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়েছে) খুব সাবলীলভাবে উঠে এসেছে সমাজজীবন-চিত্র, প্রেম-ভালোবাসা, নিপীড়িত মানুষের কথা।
নোবেলজয়ী কবি পাবলো নেরুদা শেষ কাব্যগ্রন্থ প্রশ্নপুস্তকের কয়েকটি কবিতা নিয়ে আলোচনা করব আমরা শুরুতেই বলেছিলাম। তাঁর প্রশ্নপুস্তক এবং অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ, স্মৃতিচারণ লেখা নিয়ে অনেক প্রজ্ঞাবান কবি-সাহিত্যিক অনুবাদ করেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন- সুভাষ মুখোপাধ্যায়, কবি শামসুর রাহমান, মাসুদুজ্জামান, বিকাশ গন চৌধুরী প্রমুখ।
আমি প্রশ্নপুস্তক কাব্যগ্রন্থটির ওপর আলোকপাত করছি। এ কাব্যগ্রন্থের অনুবাদক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক ও সাহিত্যিক রায়হান রাইন কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন, ‘প্রশ্নপুস্তক, আগাগোড়া প্রশ্ন দিয়ে গড়া। একটা গোটা কাব্যগ্রন্থ কেবলই প্রশ্নের সিরিজ! কেবল প্রশ্নবাক্যে সাজিয়ে কীভাবে রচিত হতে পারে একটা কাব্যগ্রন্থ? লক্ষ্য করলে আমরা দেখব, প্রশ্নবোধক বাক্যের শরীরে এমন একটা পরিসর আছে যাতে এঁটে যেতে পারে বার্তাবহ বর্ণনা, অনুজ্ঞা এবং বিস্ময়ও।’ বলে রাখা ভালো কবি পাবলো নেরুদার ‘প্রশ্নপুস্তক’ কাব্যগ্রন্থটি তাঁর পড়ন্ত বয়সে লেখা।
এমন কিছু কি আছে দুনিয়ায়
দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা ট্রেনের চেয়ে যা বিষণ্নতর?
এ কবিতায় কবি প্রশ্ন করেছেন, আমায় বলো, গোলাপ কি নগ্ন?
নাকি ওইটাই তার একমাত্র পোশাক?
কী অসাধারণ প্রশ্ন। সৌন্দর্যে বিকশিত সবার কাছে প্রিয় ফুল গোলাপ। এ গোলাপ প্রস্ফুটিত হওয়ার পর নগ্নই তো। এই নগ্নতা অপবিত্র এ কথা বলা যায় কি? কেউ এ কথা কখনো বলেছেন বলে আমাদের জানা নেই। গোলাপের সৌরভ আর সৌন্দর্য আমাদের মোহিত করে, মুগ্ধ করে। তাঁর নগ্নতা নয়। কবি পাবলো নেরুদা এ প্রশ্নকে সামনে এনে নিজেই প্রশ্নের মাধ্যমে জানতে চেয়েছেন; ‘নাকি ওইটাই তার একমাত্র পোশাক? এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, প্রস্ফুটিত গোলাপ নগ্ন নয়; এটি তাঁর সৌন্দর্য।
পাবলো নেরুদা প্রশ্নপুস্তক কাব্যগ্রন্থে অনেক কবিতা লিখেছেন, তাঁর আরও একটি কবিতা উদ্ধৃত করছি- ‘অরণ্যের হলুদ রং কি গত বছরেরটাই?
আর অদম্য সমুদ্র-পাখিগুলোর একই কালো ঝাঁক
কি ওড়ে বারবার?
আর যেখানে স্থানের শেষ
সেটাই কি মৃত্যু নাকি অনন্ত?
বেষ্টনীর ওপর কিসের ভার বেশি
বিষণ্ন্নতা নাকি স্মৃতি-সম্ভারের?
প্রশ্নবাক্যে রচনা করা এ কাব্যগ্রন্থের এ কবিতাটি কবিমনের এক গভীর দার্শনিক চিন্তা সামনে নিয়ে আসে। এ কবিতায় কবি পাবলো নেরুদার প্রশ্ন- ‘আর যেখানে স্থানের শেষ সেটাই কি মৃত্যু নাকি অনন্ত?
প্রশ্নের মধ্যে সেই চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন, মৃত্যু আর অনন্তকে সামনে এনে। কবির প্রশ্ন চিন্তায় মৃত্যুই কি শেষ নাকি এরপর আরও কোনো জগৎ আছে, সেই জগৎ অনন্তকালের। এ চিন্তাকেই তিনি প্রশ্নবাক্যে কবিতায় নিয়ে এসেছেন। এখানেই কবি পাবলো নেরুদা। এ মহান কবি শুচি-শুভ্র-পবিত্র শব্দ দিয়ে লিখেছেন- কবিতা, স্মৃতিকথা, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে বক্তৃতা। যার সবই এক সৃষ্টির সম্ভার। মহান কবি পাবলো নেরুদা ১৯৭৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর সব মায়া ত্যাগ করে চলে যান। তাঁর এ যাত্রা কি? তাঁর প্রশ্নের মতো অনন্ত কোনো জগতে?
কবি পাবলো নেরুদার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও অভিবাদন!