বুধবার, ৬ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

ডিজিটাল লেনদেনে বদলে গেছে জীবনযাত্রা

মানিক মুনতাসির

ডিজিটাল লেনদেনে বদলে গেছে জীবনযাত্রা

কেস স্টাডি- : ব্যাংক কর্মকর্তা রাশেদ রহমান। বসবাস করেন উত্তরায়। অফিস মতিঝিলে। অফিস শেষ করে বাসায় ফেরার পথে কোনো চেইন শপে ঢুকে বাজার করেন। বাজারের বিল পরিশোধ করেন ডেবিট কিংবা ক্রেডিট কার্ডে। বাবা-মায়ের ওষুধ কেনার পরেও বিল দেন কার্ডে কিংবা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। নিজের বা পরিবারের জন্য অন্যান্য কেনাকাটায়ও ব্যবহার করেন কার্ড। বন্ধু-বান্ধব কিংবা পরিবারের কারও প্রয়োজনে টাকা পাঠানোর প্রয়োজন হলেও নগদ টাকা তুলতে ব্যাংকে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। তাও পাঠিয়ে দেওয়া হয় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। মাস শেষে ক্রেডিট কার্ডের বিলটাও পরিশোধ করেন ডিজিটাল মাধ্যমে। নিজের বেতনের অর্থও আসে অনলাইনে। গত বছর কোরবানির গরু কিনেছিলেন অনলাইন মার্কেট থেকে। সেই গরুর দামের অর্থও পরিশোধ করেন অনলাইনে।

কেস স্টাডি- : মোস্তাফিজুর রহমান। পেশায় চিকিৎসক। রোগী দেখার ভিজিট নেওয়া ছাড়া আর কোনো লেনদেন হাতে হাতে করেন না বললেই চলে। যে কোনো কেনাকাটার বিল মেটান কার্ড দিয়ে। নিজের সহকারীদের বেতন দেন অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। বাড়িতে বৃদ্ধ মা-বাবার জন্য টাকা পাঠান মোবাইল ব্যাংকিংয়ে। এতে জীবনটাকে অনেক সহজই মনে হয় তার। এখন আর কষ্ট করে ওয়ালেটও বহন করার প্রয়োজন হয় না। কার্ডহোল্ডারে কার্ড থাকে। আবার হাতে তো মোবাইল রয়েছেই। তার মতে, ঝটপট কেনাকাটায় এসবই নিত্যসঙ্গী। গ্রাম কিংবা শহর। জেলা কিংবা উপজেলা এমনকি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বিস্তৃত হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং। যার সুবাদে জীবন হয়েছে অনেক সহজ এবং কেনাকাটা বা অর্র্থ লেনদেন হয়েছে আরও সহজ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ডেবিট কার্ডে লেনদেন বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে।  গত এপ্রিলে ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন বেড়ে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে
দেশে ডিজিটাল লেনদেনের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। ডেবিট, ক্রেডিট কার্ড কিংবা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মানুষের দৈনন্দিন অর্থ লেনদেনের কাজ করছে। মানুষ দৈনন্দিন জীবনের কেনাকাটা, বিল পরিশোধ, ধার পরিশোধ, ধার নেওয়া, ক্রেডিট কার্ডের বিল পরিশোধসহ প্রায় সব ধরনের লেনদেন করছে ডিজিটাল মাধ্যমে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাধারণ মাছ বাজারেও চালু হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং। পাইকারির বাজারের মুদি দোকানেও একই ব্যবস্থায় লেনদেন হচ্ছে।  দেশের যে কোনো জায়গায় অবস্থান করেও মুহূর্তের মধ্যে প্রিয়জনকে টাকা পাঠানো সম্ভব হচ্ছে এই ডিজিটাল মাধ্যমের আশীর্বাদে। এমনকি জরুরি কোনো প্রয়োজনে মানুষ এখন আর নগদ টাকার ব্যবহার তেমন একটা করছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকও বলছে, গত পাঁচ বছরের ব্যবধানে মানুষের মধ্যে নগদ টাকার ব্যবহারের মাত্রা কমেছে অনেকাংশে। বিশেষ করে যে  কোনো ধরনের জরুরি লেনদেন, কেনাকাটা, বিল পরিশোধ এসব ক্ষেত্রে রাজধানী ঢাকা, বিভাগীয় কিংবা জেলা শহর এমনকি উপজেলায় শহরেও এক্ষেত্রে ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার হয়ে আসছে।

খিলগাঁও পাইকারি বাজারে গত শনিবার কথা হয় স্কুল শিক্ষক শিরিন আখতারের সঙ্গে। তিনি মাসের প্রয়োজনীয় সদাই পাইকারি দোকান থেকে একবারে ক্রয় করেন। তাতে কিছুটা অর্থ সাশ্রয়ও হয়। চাল, ডাল, তেল, লবণ, চা-পাতা, বাচ্চাদের জন্য বিস্কুট, গুঁড়ো দুধ, সাবান, কাপড় কাচার পাউডার ইত্যাদি ক্রয় করে প্রায় ৩ হাজার টাকার বিল পরিশোধ করলেন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। শিরিন জানান তিনি প্রায় পাঁচ বছর ধরেই এমনটি করে আসছেন। এতে তিনি বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এক সঙ্গে নগদ টাকা বহনের ঝামেলা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। এটা সম্ভব হয়েছে প্রযুক্তির উৎকর্ষ আর উন্নয়নের ফলে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ডেবিট কার্ডে লেনদেন বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। গত এপ্রিলে ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন বেড়ে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে। যেখানে গত বছরের একই সময়ে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১৮ হাজার ৬৩৫ কোটি। ২০২১ সালে ২ কোটি ২৭ লাখ ডেবিট কার্ড হিসাবধারী ছিলেন। সেটি ২০২২ সালের এপ্রিলে ২ কোটি ৫৭ লাখে পৌঁছেছে। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ৩০ লাখ ডেবিট কার্ড ও ৫ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকার লেনদেন বেড়েছে।

এদিকে চলতি বছরের এপ্রিলে ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে ৩২ লাখ ৪৯ হাজার লেনদেন হয়েছে। লেনদেনের পরিমাণ ২ হাজার ১০৯ কোটি টাকা। ২০২১ সালের এপ্রিলে লেনদেনের সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৮৪ হাজার। লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে লেনদেন বেড়েছে ২৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ বা প্রায় ৬০০ কোটি টাকা।

একই সময়ে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ১০ হাজার জন। গত বছরের ওই একই সময়ে এ সংখ্যা ছিল ১৭ লাখ ১৩ হাজার। এক বছরের ব্যবধানে ক্রেডিট কার্ড ইস্যুর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ২ লাখ বা ১০ দশমিক ৩১ শতাংশ। এতেই বোঝা যায় ক্রেডিট বা ডেবিট কার্র্ডের সংখ্যা এবং ব্যবহার বাড়ছে সমানতালে। অন্যদিকে এতে নির্ভরতাও বাড়ছে গ্রাহকদের। যা জীবনযাপন করে তুলেছে সাবলীল ও ঝামেলাহীন।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, মোবাইল ব্যাংকিংয়েও রেকর্ড পরিমাণ লেনদেন হয়েছে। চলতি বছরের মার্চে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকরা ৭৭ হাজার ২২ কোটি টাকার লেনদেন করেছেন। যা একক মাস হিসেবে সর্বোচ্চ লেনদেনের রেকর্ড। প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা। এর আগে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন হয় জানুয়ারিতে। লেনদেন হয়েছে ৭৩ হাজার ৩৯৩ টাকা। ২০২১ সালের মে মাসে ৭১ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা লেনদেন করেন গ্রাহকরা। যা এখন পর্যন্ত একক মাস হিসেবে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০২২ সালের মার্চ শেষে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে নিবন্ধিত গ্রাহক সংখ্যা ১০ কোটি ৯১ লাখ ৩০ হাজার ৪০৫ জন। এর মধ্যে গ্রামাঞ্চলে পাঁচ কোটি ৬৬ লাখ ৭০ হাজার এবং শহরাঞ্চলে ৫ কোটি ২৪ লাখ ৬০ হাজার গ্রাহক রয়েছেন। নিবন্ধিতদের মধ্যে পুরুষ ৫ কোটি ৩১ লাখ ৭৫ হাজার এবং মহিলা গ্রাহক ৪ কোটি ৫৬ লাখ ২৬ হাজার। এ সময়ে মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৫১ হাজার ২১৩ জনে।

এদিকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে শুধু কেনাকাটাই নয় অন্যান্য আরও আর্থিক সেবা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। যা জীবনকে নাগরিক জীবনে করে তুলেছে সাবলীল। এর মাধ্যমে দৈনন্দিন কেনাকাটা, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানিসহ বিভিন্ন বিল পরিশোধ এবং মোবাইল রিচার্জসহ নানা ধরনের সেবা মিলছে। এমনকি রাজধানী ও জেলা শহরে গাড়িচালক ও গৃহপরিচারিকাদের বেতনও এখন দেওয়া হচ্ছে এর মাধ্যমে।

চলতি ২০২২ সালে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট থেকে ৫০ লাখ শিক্ষার্থীর মাঝে প্রায় ১২০০ কোটি টাকা উপবৃত্তি হিসেবে বিতরণ করা হচ্ছে। উপবৃত্তির এসব টাকা পাচ্ছেন মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক পাস ও সমমান পর্যায়ের দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীরা। মোবাইল অথবা অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে উপবৃত্তির এই টাকা শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।

এদিকে পিআরআইএর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মোবাইল ব্যাংকিং সেবার প্রসার ঘটলেও এখানে এক বা দুটি মোবাইল অপারেটর ও ব্যাংকের আধিপত্যই চোখে পড়ছে। এক্ষেত্রে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামো ও ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন করতে পারলে গ্রাহক সেবার পরিধি এবং মানকে আরও বিস্তৃত করা সম্ভব বলে মনে করে পিআরআই।

এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমরা সব খাতেই গর্ব করার মতো সফলতা পেয়েছি। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের মাঝে বৈষম্য বেড়েছে। অধিক সংখ্যক মানুষকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে তা কমিয়ে আনা সম্ভব। ডিজিটাল লেনদেন ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আমাদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি খাতে রীতিমতো বিপ্লব ঘটে গেছে বলে তিনি মনে করেন।

সর্বশেষ খবর