বুধবার, ১৫ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

স্মার্ট বাংলাদেশের প্রয়োজন স্মার্ট নারী

ফরিদা ইয়াসমিন, সভাপতি, জাতীয় প্রেস ক্লাব

স্মার্ট বাংলাদেশের প্রয়োজন স্মার্ট নারী

বঙ্গবন্ধু নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের ওপর জোর দিয়ে বলতেন, নারীর নিজস্ব আয় থাকলে পরিবারেও সম্মান বাড়ে।  যদি তার সামান্য কিছু টাকাও থাকে পরিবারে তার গুরুত্ব বাড়ে এবং পরিবার তাকে সম্মানের চোখে দেখে। নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য তার উপার্জনের লক্ষ্যে স্বাধীনতার পর নারীকে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে চালু করা হয় বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি।

 

আমাদের সংবিধানে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা আছে। বাংলাদেশের সংবিধান নারী-পুরুষের সমান অধিকার দিলেও কার্যত নারী অনেক ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার। এ বৈষম্য নিরসনে বর্তমান সরকার নানাভাবে কাজ করে যাচ্ছে। কারণ নারী-পুরুষ মিলে এই সমাজ।  সমাজের অর্ধেক অংশ পিছিয়ে থাকলে দেশের অগ্রগতি সম্ভব নয়। নারীর ক্ষমতায়নে সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশে নারীকে সম্পৃক্ত করতে সরকারের নানা উদ্যোগ ছিল। বর্তমানে সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে পরিণত করতে কাজ করছে। স্মার্ট বাংলাদেশের নাগরিকদের হতে হবে স¥ার্ট। নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে স্মার্ট।  নারীকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সক্ষমতা অর্জন করতে হবে, হতে হবে প্রযুক্তিতে দক্ষ। নারীর শিক্ষা, দক্ষতা ও মেধা দিয়ে পরিবর্তনশীল বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে স্মার্ট নারীদের ভূমিকা রাখতে হবে। সরকার ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশে রূপান্তরের জন্য কাজ করছে। ১৯৭৪ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘের ২৯তম অধিবেশনে প্রযুক্তি ও মানুষের মর্যাদাপূর্ণ জীবনের ওপর জোর দিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র উদে¦াধন করেন। সেই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ঘোষণা দিয়েছিলেন, একটি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার। ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন বাস্তব। ডিজিটাল বাংলাদেশে অনলাইনে প্রবেশগম্যতার মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য নানা দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে।

১৩ বছর পর ২০২২ সালে সরকার ঘোষণা করে স্মার্ট বাংলাদেশের। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার মধ্য দিয়ে সরকারের লক্ষ্য একটি স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। স্মার্ট বাংলাদেশ হবে একটি জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির দেশ। নীতিনির্ধারকরা স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য ১৪ দফা কর্ম-পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। এর মধ্যে স্মার্ট শিক্ষা, স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা, স্মার্ট কৃষি, স্মার্ট বাণিজ্য, স্মার্ট পরিবহন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার চারটি খুঁটি হচ্ছে স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সরকার ও স্মার্ট সমাজ। এগুলো একটি আরেকটির সঙ্গে সম্পর্কিত। একটি আরেকটিকে প্রভাবিত করে। নারী-পুরুষ সবাইকে নিয়েই স্মার্ট নাগরিক বোঝায়। প্রযুক্তিতে পুরুষের পাশাপাশি নারীকে সমানতালে এগিয়ে আসতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মনেপ্রাণে নারী-পুরুষের সমঅধিকারে বিশ্বাস করতেন। নারী-পুরুষ সমানভাবে এগিয়ে না এলে কোনো দেশের উন্নতি সম্ভব নয়-তিনি তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘নয়াচীনের মেয়েরা আজকাল জমিতে, ফ্যাক্টরিতে, কল-কারখানাতে, সৈন্যবাহিনীতে দলে দলে যোগদান করছে। সত্য কথা বলতে গেলে, একটা জাতির অর্ধেক জনসাধারণ যদি ঘরের কোণে বসে শুধু বংশবৃদ্ধির কাজ ছাড়া আর কোনো কাজ না করে, তা হলে সেই জাতি দুনিয়ায় কোনো দিন বড় হতে পারে না। নয়াচীনে পুরুষ ও নারীর সমান অধিকার কায়েম হওয়াতে আজ আর পুরুষ জাতি অন্যায় ব্যবহার করতে পারে না নারী জাতির ওপর।’ তিনি আরও লিখেন, ‘নয়াচীনের উন্নতির প্রধান কারণ পুরুষ ও মহিলা আজ সমানভাবে এগিয়ে এসেছে দেশের কাজে। সমানভাবে সাড়া দিয়েছে জাতি গঠনমূলক কাজে। তাই জাতি আজ এগিয়ে চলেছে উন্নতির দিকে।’ (আমার দেখা নয়াচীন, শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলা একাডেমি)। ১৯৫২ সালে বঙ্গবন্ধু চীন সফরে গিয়েছিলেন। তিনি তাঁর দুই বছর পরে ১৯৫৪ সালে কারাগারে বসে বইটি লিখেন।

বঙ্গবন্ধু নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের ওপর জোর দিয়ে বলতেন, নারীর নিজস্ব আয় থাকলে পরিবারেও সম্মান বাড়ে। যদি তার সামান্য কিছু টাকাও থাকে পরিবারে তার গুরুত্ব বাড়ে এবং পরিবার তাকে সম্মানের চোখে দেখে। নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য তার উপার্জনের লক্ষ্যে স্বাধীনতার পর নারীকে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে চালু করা হয় বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি। বঙ্গবন্ধু সব সময় উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে মানুষের জীবনমান উন্নয়ন হবে বলে মনে করতেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ বাস্তবায়নে হাল ধরেছেন তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনা। নারী-পুরুষের সমতার একটি উন্নত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ শেষ করে তিনি এখন স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু করেছেন। বঙ্গবন্ধুর পথ ধরেই শেখ হাসিনার সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জনের জন্য কৃষি, স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তির উদ্ভাবনে সমান গুরুত্ব দিয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশের সবকিছু প্রযুক্তিনির্ভর হবে। নাগরিকদের প্রযুক্তিতে দক্ষ হতে হবে এবং সমগ্র অর্থনীতি প্রযুক্তি দ¦ারা পরিচালিত হবে। বর্তমানে পুরুষের পাশাপাশি নারীকে প্রযুক্তিতে দক্ষ হতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশই পরিণত হবে স্মার্ট বাংলাদেশে।

ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে গড়ে উঠবে ভবিষ্যৎ স্মার্ট প্রজন্ম। একজন শিক্ষিত, স্বনির্ভর, পরিশ্রমী মা গড়ে তুলতে পারেন তাঁর সন্তানকে স্মার্ট হিসেবে। টেকসই উন্নয়নের জন্য নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিককে শিক্ষিত হতে হবে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তির মূল ভিত্তি নারীর শিক্ষা। নারী শিক্ষায় গুরুত্ব দিয়ে জাতির পিতা নারীর জন্য চালু করেছিলেন স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে গণশিক্ষা কার্যক্রম। নারীরা ব্যাপকভাবে এতে অংশ নেন। বঙ্গবন্ধু নারীদের শিক্ষার পথ প্রশস্ত করেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মেয়েদের ডিজিটাল শিক্ষার সুযোগ করে দেন। বিদ্যালয়ে তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে তথ্যপ্রযুক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ আশানুরূপ নয়। বর্তমানে মোবাইল সংযোগ আছে ১৮ কোটির বেশি। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছে ১১ কোটির বেশি। যেখানে দেশের ৮৬ শতাংশ পুরুষের কাছে আছে মোবাইল ফোন সেখানে ৬১ শতাংশ নারী মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারে নারী-পুরুষের বৈষম্য এখনো প্রবল। ধরে নেওয়া হয় নারী প্রযুক্তি ব্যবহার পারবে না, এ জন্য তাকে যথেষ্ট শিক্ষিত হতে হবে। এখানে মনস্তাত্ত্বিক বাধা কাজ করে। নারীর প্রতি চিরন্তন সমাজের যে দৃষ্টিভঙ্গিই এর মূল কারণ। বেসিসের (বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস) সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রযুক্তি ব্যবহারে সক্ষম নারীদের মাত্র ৩ শতাংশ কম্পিউটার ব্যবহার করেন, সেখানে পুরুষ ব্যবহার করেন ১১ শতাংশ। এদিকে দেশের আইসিটি শিল্পের মাত্র ১ শতাংশ নারীর নেতৃত্বে আছে। তবে ফেসবুকভিত্তিক খুচরা বিক্রেতাদের ৫০ শতাংশ নারী। দেশে প্রায় পাঁচ হাজার ইউনিয়ন ইনফরমেশন সার্ভিস সেন্টার রয়েছে। গ্রামীণ নারীরা তার সুফল ভোগ করছে। তারা তাদের উৎপাদিত পণ্য ডিজিটাল মাধ্যমে বাজারজাত করছে। মোবাইল ফোনে টাকা পাঠানো, পোস্টাল ক্যাশকার্ড প্রবর্তন ইত্যাদি ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। ফলে নারী যুক্ত হচ্ছে ই-কমার্সে। তাদের অনলাইন ব্যবসা সম্প্রসারিত হচ্ছে। জাতীয় মহিলা সংস্থা নারীদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণের জন্য জেলাভিত্তিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এ ছাড়া জেলা তথ্যসেল, জাতীয় তথ্যসেল এনেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। রয়েছে ‘তথ্য আপা’ নামে ডিজিটাল ডাটাবেস।

স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য প্রযুক্তিতে দক্ষ মানুষ হতে হবে। আইসিটি (ন্যাশনাল ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি) সেক্টরে নারীর পড়াশোনার আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। বর্তমানে আইসিটি সেক্টরে ২৫ শতাংশ নারী লেখাপড়া করছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে বর্তমান সরকার। আইসিটি পলিসিতে (২০১৫) লিঙ্গসমতার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

১৯৭৯ সালে জাতিসংঘে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও) গৃহীত হয়। সিডও সনদের বহু আগেই ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বাংলাদেশের সংবিধানে নারী-পুরুষের সমঅধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাঁরই সুযোগ্য কন্যা তা সর্বস্তরে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ ও প্রজ্ঞায় উজ্জীবিত হয়ে তিনি বাবার অসমাপ্ত কাজ শেষ করার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালে সন্তানের পরিচয়ে মায়ের নাম যুক্ত করে নারীর মর্যাদায় যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছেন। আজ জীবনের সর্বস্তরে নারীর পদচারণা অত্যন্ত দাপটের সঙ্গে বাড়ছে। বাংলাদেশ সরকার সব ধরনের বৈষম্য বিলোপের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।  আজ জাতীয় ও সামাজিক স্তরের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী নেতৃত্ব দিচ্ছেন। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ সমগ্র বিশ্বে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সূচকের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর সমতা বজায় রাখার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।

সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের নারীদের স্মার্ট হতে হবে। পুরুষের সঙ্গে সমানভাবে প্রযুক্তির শিক্ষা ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতে লিঙ্গ বৈষম্যহীন অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ জন্য নারীর জন্য সুযোগ সৃষ্টি এবং অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। নারী অনেক ক্ষেত্রে ডিজিটাল হয়রানির শিকার হচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩৫ শতাংশ মামলা করছে নারী।  তবে সামাজিক কারণে অনেকেই মামলা করতে চান না। প্রকৃত অপরাধ এর চেয়ে বেশি হবে। নারী যাতে হয়রানির শিকার না হয়, সে ব্যবস্থা নিতে হবে। নারীদের প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণের সুযোগ আরও বাড়াতে হবে।  প্রযুক্তির ব্যবহারে যখন নারী আর পিছিয়ে থাকবে না তখন নারী-পুরুষের সমতায় এগিয়ে যাবে স্মার্ট বাংলাদেশ। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য প্রয়োজন স্মার্ট নেতৃত্ব। সে নেতৃত্ব আমাদের আছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের মতোই বাস্তবায়ন হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশ হবে নারী-পুরুষের সমতার বাংলাদেশ।

সর্বশেষ খবর