বুধবার, ১৫ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

কূটনৈতিক সাংবাদিকতা

ওয়ালিউর রহমান, গবেষক, মুক্তিযোদ্ধা, রাষ্ট্রদূত

কূটনৈতিক সাংবাদিকতা

সব দেশের গণমাধ্যম যে স্বাধীন তা বলা যাবে না। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, ‘কোনো দেশে স্বাধীন গণমাধ্যম থাকলে সে দেশে দুর্ভিক্ষ হানা দিতে পারে না।’ এ ইতিহাস থেকে আমরা কী শিখি। তারা যে পথ দেখিয়ে গেছেন সারা পৃথিবী সেই পথে চলেছে।  আঠারো শতকে ইউরোপে আধুনিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে সাংবাদিকতার সূচনা হয়। বাংলা সাংবাদিকতার যাত্রা শুরু হয় ১৮১৮ সালে বাঙ্গাল গেজেট, দিকদর্শন ও সমাচার দর্পণ পত্রিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে।

 

স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। রাষ্ট্রের তিনটি অপরিহার্য অঙ্গ আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের মতো সংবাদপত্রও যেন আরেকটি অপরিহার্য অঙ্গ। সমাজের উপরিকাঠামো, অবকাঠামো কিংবা মানবীয় আচরণের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গণমাধ্যম জনগণকে প্রভাবিত ও বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন করে।  সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিকাশে গণমাধ্যম নতুন যুগের সূচনা ঘটায়। গণমাধ্যমের ভূমিকা শুধু সংবাদ পরিবেশন ও বিশ্লেষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সংবাদকর্মীরা বা সাংবাদিকরা দেশের সাধারণ মানুষ ও রাষ্ট্রের মধ্যে মেডিয়েটর বা মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। মার্কিন সাংবাদিক ওয়ালটার লিপম্যানের মতে, সাংবাদিকরা জনগণ ও নীতিনির্ধারণী এলিটদের (রাজনীতিক, নীতিনির্ধারক, আমলা, বিজ্ঞানী) মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে। সংবাদকর্মীরা এলিট শ্রেণি থেকে শুরু করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সবার কথা শোনে, দেখে এবং জনগণকে শোনার, দেখার ও পড়ার ব্যবস্থা করে দেয়। এ দেখা, শোনা এবং লেখা ছুঁয়ে যায় অর্থনীতি, সংস্কৃতি, রাজনীতি সর্বত্র। তার ভাষায়, ‘Views are personal but news is sacred’ লিপম্যান তাই রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি স্তম্ভ হিসেবে দেখেন গণমাধ্যমকে।  তার মতে, সাংবাদিকতায় সত্য প্রকাশের চেয়ে উচ্চতর কোনো আইন নেই।

বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে যোগাযোগবিদ ড্যানিয়েল লার্নার গণমাধ্যমকে সমাজ পরিবর্তনের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিত করেন। থমাস জেফারসন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। জেফারসন ছিলেন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে একজন প্রবাদপুরুষ। তিনি একবার বলেছিলেন, আমাকে যদি এ বিকল্পটি দেওয়া হয় যে তুমি কি সংবাদপত্রবিহীন সরকার চাও, না সরকারবিহীন সংবাদপত্র চাও? তখন আমি পরেরটা বেছে নেব। এখানে তিনি সংবাদপত্রকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

১৯৭১ সালে ড্যানিয়েল এলসবার্গ ভিয়েতনাম যুদ্ধের ওপর ডকুমেন্ট ‘পেন্টাগন পেপার্স’ প্রকাশ করেছিলেন। যা ছিল ওই সময় বিশ্বের এক নম্বর টপ নিউজ। কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারগুলো ভিয়েতনাম যুদ্ধ প্রসঙ্গে জনগণের কাছে তথ্য লুকিয়েছে বা মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করেছে। শুধু নিক্সন সরকার নয়, তার আগের হ্যারি এস ট্রুমান থেকে লিন্ডসে বি. জনসন- সব সরকারই ভিয়েতনাম যুদ্ধের আসল রূপ থেকে জনগণকে অন্ধকারে রেখেছিল। আর এ সবকিছুই ফাঁস হয়েছিল পেন্টাগন পেপার্সে।

১৯৬৭ সালে মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব রবার্ট ম্যাকনামারার অনুরোধে একদল বিশ্লেষক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে একেবারে ১৯৬৮ সালের আগ পর্যন্ত বিভিন্ন মার্কিন প্রশাসন যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ভিয়েতনাম সম্পর্কে তার ওপর একটি সমীক্ষা প্রস্তুত করতে শুরু করেন। প্রায় ৩৬ জন সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তির ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, যাদের মধ্যে সামরিক বিশ্লেষক ড্যানিয়েল এলসবার্গও ছিলেন। সমীক্ষা তৈরির কাজ করার সময় ড্যানিয়েল এলসবার্গ বুঝতে পারেন, মার্কিন প্রশাসন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ভিয়েতনাম ইস্যুতে প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছে।

এলসবার্গ ভাবলেন, ভিয়েতনাম যুদ্ধ সম্পর্কে মার্কিন প্রশাসনের কুকীর্তিগুলো সামনে আনা দরকার। আর এটা করতে হলে পেন্টাগন পেপার্স জনগণের সামনে আনতে হবে। ড্যানিয়েল এলসবার্গও ভাবলেন, গণমাধ্যমের দ্বারা পেন্টাগন পেপার্স প্রকাশ করা উচিত। বিশ্ববিখ্যাত ও প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমগুলো এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য হতে পারে। এরপর তিনি যোগাযোগ করলেন বিখ্যাত পত্রিকা ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর সাংবাদিক নিল শিহানের সঙ্গে। পেন্টাগন পেপার্সের ওপর দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ১৩ জুন, ১৯৭১ সালে প্রথম আর্টিক্যাল প্রকাশিত হয়। মার্কিন সমাজে রীতিমতো আলোড়ন শুরু হয়ে যায় আর্টিক্যাল প্রকাশিত হওয়ার পর। মার্কিন প্রশাসন এতদিন ধরে জনগণের সঙ্গে যেভাবে মিথ্যাচার করে আসছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে, তা জনগণকে ক্ষিপ্ত করে তোলে।

এরপর পেন্টাগন পেপার্সের ওপর কোনো কিছু প্রকাশ করতে এ পত্রিকার ওপর কিছু সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ওয়াশিংটন পোস্টও দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের বরাত দিয়ে আর্টিক্যাল প্রকাশ করত। এ পত্রিকার ওপরও সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো। কিন্তু দুই পত্রিকাই সাফ জানিয়ে দেয়- তারা প্রকাশনা চালিয়ে যাবেন এবং দরকার হলে আইনি লড়াইয়েও তারা রাজি।

শেষ পর্যন্ত মামলা হয়। ১৯৭১ সালের মার্চের ২৫ তারিখে মামলার শুনানি উপস্থাপিত হয়। এরপর ৩০ জুন মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট নিক্সন প্রশাসনের বিপক্ষে গিয়ে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস ও ওয়াশিংটন পোস্টের পক্ষে একটি ঐতিহাসিক রায় দেয়, যেটি সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। পেন্টাগন পেপার্স এমন এক ডকুমেন্ট যা তৎকালীন মার্কিন প্রশাসনকে কাঁপিয়ে দিয়ে জনসম্মুখে উন্মোচন করেছিল তাদের কালো মুখোশ। আবার এ পেন্টাগন পেপার্সই থামিয়ে দিয়েছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধের মতো একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধকে। আর এর পেছনেও বড় ভূমিকা পালন করেছিল গণমাধ্যম বা সংবাদমাধ্যম।

জন মিল্টনের একটি শ্রেষ্ঠ গদ্য রচনা হিসেবে তার অ্যারিওপ্যাজিটিকার পরিচয়। ১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে নভেম্বর মাসে গৃহযুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে অ্যারিওপ্যাজিটিকা প্রকাশিত হয়। সাধারণের মত প্রকাশের ওপর সরকারি হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে এ মত প্রকাশের স্বাধীনতার সপক্ষে গ্রন্থটি রচিত।

মিল্টনের প্রধান বক্তব্য হলো- মানবোচিত গুণাবলি বিকাশের জন্য সবার আগে প্রয়োজন স্বাধীনতা। কিন্তু কখনই, কোনো অবস্থাতেই স্বাধীনতা খর্ব করা যাবে না। যতক্ষণ না একজন লেখক অপরাধী সাব্যস্ত হচ্ছেন ততক্ষণ যেন তার ওপর কোনো প্রকার খবরদারি না হয়। যদি সত্যি তিনি ঘোর অধর্মমূলক কিছু লিখে ফেলেন তাহলে তার শাস্তি পরেও হতে পারবে। পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই গ্রন্থ প্রকাশের ওপর বিধিনিষেধ আরোপিত হয়েছিল। মুদ্রণ নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য আইন হলো ১৬৩৭ সালের স্টার চেম্বারের মাধ্যমে। লং পার্লামেন্ট ১৬৪১ সালে স্টার চেম্বার ভেঙে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে পুরো দেশে বিনা মঞ্জুরিতে ছাপা অজস্র পুস্তক-পুস্তিকার প্লাবন দেখা যায়।  পুরো কমনওয়েলথ আমলেই অর্থাৎ ১৬৬০ সালে রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা হওয়া পর্যন্ত মুদ্রণের ওপর কোনো না কোনো প্রকার বিধিনিষেধ বলবৎ ছিল।

দ্য গার্ডিয়ানের প্রাক্তন সম্পাদক অ্যালান রসব্রিডার ১৬৯৫ সালে গ্রেট ব্রিটেনে প্রেসের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন : “মানুষ যখন সাংবাদিক বা সংবাদপত্রের লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়ে কথা বলে তখন তাদের প্রবৃত্তিটি ইতিহাসের দিকে উল্লেখ করা উচিত।”

সব দেশের গণমাধ্যম যে স্বাধীন সেটা বলা যাবে না। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, ‘কোনো দেশে স্বাধীন গণমাধ্যম থাকলে সে দেশে দুর্ভিক্ষ হানা দিতে পারে না।’ এ ইতিহাস থেকে আমরা কী শিখি। তারা যে পথ দেখিয়ে গেছেন সারা পৃথিবী সেই পথে চলেছে। আঠার শতকে ইউরোপে আধুনিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে সাংবাদিকতার সূচনা হয়। বাংলা সাংবাদিকতার যাত্রা শুরু হয় ১৮১৮ সালে বাঙ্গাল গেজেট, দিকদর্শন ও সমাচার দর্পণ পত্রিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে। বিশ শতকের শুরুতে সাংবাদিকতা পেশার বিস্তৃতি ঘটে। বাংলাদেশে বর্তমানে আমরা এ ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়ে গেছি। সাধারণত বাংলাদেশে যুদ্ধের সময় থেকে যে সত্য বেরিয়েছে পৃথিবীর যত গ্লোবাল মিডিয়া আছে তখন থেকে তারা বাংলাদেশকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখেছে এবং আমাদের খবর তারা বিশ্ববাসীকে জানিয়েছে। ২৫ মার্চ রাতে যে গণহত্যা হলো, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে বাঙালি শিক্ষক, শিক্ষার্থী, সামরিক ও বেসামরিক বাহিনীর সদস্য এবং সাধারণ মানুষসহ লাখ লাখ বাঙালিকে হত্যা করা হয় এবং মিডিয়া হাউসগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ নামে পাকিস্তানি বাহিনীর অতর্কিত সেই হামলায় মৃত্যুপুরী হয়ে ওঠে সমগ্র ঢাকা শহর। অত্যাচারী পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী গণহত্যার আগেই ঢাকার সঙ্গে বহির্বিশ্বের সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল।

ঢাকায় অবস্থানরত কূটনীতিবিদ এবং বিদেশি সাংবাদিকগণকে তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে বিশেষ কড়াকড়ি জারি করা হলো। মানবতার প্রদীপ যখন নিভু নিভু অবস্থায় প্রজ্বলিত হচ্ছিল, ঠিক তখন বহির্বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের কান্নার ধ্বনি পৌঁছে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন কতক সাহসী সৈনিক। এদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র নাগরিক আর্চার কেন্ট ব্লাড অন্যতম। অসম সাহসিকতার সঙ্গে ঢাকার করুণ অবস্থা বিবরণের মাধ্যমে তিনি বহির্বিশ্বের দরবারে ঢাকার আকুতি তুলে ধরতে একটি টেলিগ্রাফ পাঠান যা ঐতিহাসিকভাবে ‘দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম’ নামে পরিচিত। দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম : নিক্সন, কিসিঞ্জার অ্যান্ড এ ফরগোটেন জেনোসাইড আমেরিকান সাংবাদিক গ্যারি জে ব্যাস-এর লেখা একটি বই। একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের স্পষ্ট অবস্থান থাকলেও তখন ঢাকায় দেশটির কনসাল জেনারেল আর্চার কেন্ট ব্লাড এক ধরনের বিদ্রোহী ভূমিকাতেই নেমেছিলেন। তিনি এমন হামলার ভয়াবহতা দেখে হোয়াইট হাউসে চিঠি পাঠান যাতে তারা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন না করে মীমাংসা করে। কিন্তু নিক্সন ও কিসিঞ্জার বিশেষ কিছুই করেননি। কিন্তু আর্চার কেন্ট ব্লাডের পাঠানো টেলিগ্রাফ আমাদের যুদ্ধের মোড়টাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল অনেকখানি এবং আমেরিকান প্রশাসনের ওপর যে একটা ধাক্কা গেল শেষ পর্যন্ত তারা সেটা কাটিয়ে উঠতে পারেনি বিশেষ করে নিক্সন।

আরেকজনের নাম না বললেই নয়, ব্রিটিশ সাংবাদিক সায়মন ড্রিং বাংলাদেশের গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী, যিনি নিজের জীবন বিপন্ন করে সরেজমিন প্রতিবেদন তৈরি করে বহির্বিশ্বে পৌঁছে দিয়েছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর রোমহর্ষক নির্যাতন ও গণহত্যার কথা। ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফে প্রকাশিত হয়েছিল সেই খবর।

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে নিয়ে ১৯৭২ সালে সাংবাদিক রবার্ট পেইন তার ‘ম্যাসাকার’ বইয়ে লেখেন- এন্থনি মাসকারেনহাসের বই- ‘দ্য রেইপ অব বাংলাদেশ : পৈশাচিক গণহত্যার এক আখ্যান।’ তার আরেকটি বই- ‘বাংলাদেশ অ্যা লিগ্যাসি অব ব্লাড।’ জেনোসাইডের সময় যে রেপ হয়েছে তার ওপর একটি বই লিখেছেন লেখক SUSAN BROWNMILLER, বইটির নাম- AGAINST OURWILL : MEN, WOMEN AND RAPE। তিনি এখানে এসেছিলেন এবং স্বচক্ষে দেখেছেন কীভাবে হায়েনারা নারীদের ধর্ষণ করেছে।

My Lai massacre বলতে আমরা জানি ভিয়েতনাম এবং আমেরিকা। আর বাংলাদেশের genocide বলতে জানি পাকিস্তান। তাদের লেখনীর মাধ্যমে তারা বিশ্ববাসীর চোখকে খুলে দিয়েছিল। তাদের লেখনী, প্রকাশ এবং সাংবাদিকতার মাধ্যমেই কিন্তু বাংলাদেশে কী হচ্ছে তা পৃথিবী জানতে পেরেছে।

গণহত্যা নিয়ে এত লেখালেখি হয়েছে কিন্তু সেখানে আমরা জাতিসংঘে এ গণহত্যাকে এখন পর্যন্ত স্বীকৃতি দিতে পারিনি। তারপরও আমাদের চেষ্টা ও লেখনীর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে পাকিস্তানি গণহত্যার বিষয়টি মার্কিন কংগ্রেসে বিল হিসেবে পেশ হয়েছে। শুক্রবার ১৪ অক্টোবর-২০২২ এ ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে। বিলটি তুলেছেন দুজন কংগ্রেসম্যান স্টিভ শ্যাবট ও রোহিত খান্না। বিলের নাম, ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশ গণহত্যার স্বীকৃতি’ এবং প্রস্তাবনার নম্বর হচ্ছে- ‘কংগ্রেসীয় প্রস্তাব এইচআর ১৪৩০’। রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান স্টিভ শ্যাবট এবং ডেমোক্র্যাট কংগ্রেসম্যান রোহিত খান্না যৌথ উদ্যোগে হাউস, অর্থাৎ প্রতিনিধি পরিষদে এ বিল উত্থাপন করেছেন। এর মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার ৫১ বছর পর দীর্ঘ প্রতীক্ষিত একটি মহৎ কর্ম সম্পন্ন হলো।

আমাদের বাংলাদেশের ইতিহাসে সাধারণ সাংবাদিকতা এবং কূটনৈতিক সাংবাদিকতা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। অধিকাংশ দেশেও তাই। আমরা যারা কূটনীতিক ছিলাম বা এখন যারা আছেন এদের কাজ শুধু দেশের গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ না। এদের কাজের পরিধি ব্যাপক। কূটনীতিকদের বিশ্বের অনেক দেশে গিয়ে কাজ করতে হয় এবং দেশের ভাবমূর্তি অক্ষুণœ রাখায় নিরলস পরিশ্রম করে যায়। আমি যখন জেনেভায় হেড অব মিশনে ছিলাম তখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে থেকে অনেক সংস্থার সদস্য পদ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলাম।

১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকারের নির্দেশে ফরেন সার্ভিসের চাকরি ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হয়ে ইউরোপসহ অনেক দেশে ঘুরেছি, কাজ করেছি, বাংলাদেশের জন্য সাহায্য চেয়েছি। যুদ্ধ চলাকালীন ৯ মাস জেনেভায় পলিটিক্যাল রিফিউজি ছিলাম। আমরা বহির্বিশ্বের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে স্বাধীনতার সপক্ষে বিশ্ব জনমত তৈরির প্রচেষ্টায় ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময়টায় সুইস রেডক্রস, ইন্টারন্যাশনাল রেডক্রসসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের ১ কোটি শরণার্থীকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছিল। এর নেপথ্যে আমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলাম।

১৯৭১ সালের আগস্টের ২১ ও ২২ তারিখে জেনেভায় পাকিস্তান ইনভয়েস কনফারেন্সে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে রাষ্ট্রদূতরা সমবেত হয়েছিল। ওয়াশিংটন ডিসি থেকে শাহ এ এস এম কিবরিয়া এবং কলকাতা থেকে এম হোসেন আলী আমাকে বললেন এ কনফারেন্সটা যেন আমি অবশ্যই কাভার করি এবং কনফারেন্সের যাবতীয় বার্তা যেন সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দিই। পাকিস্তান ইনভয়েস কনফারেন্সের প্রধান বক্তা ছিলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ইন্টেলিজেন্স কো-অর্ডিনেটর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ। চীন থেকে কনফারেন্সে এসেছিলেন খাজা মোহাম্মদ কায়সার। চীনে তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তিনি আমাদের জন্য একটি অতি জরুরি বার্তা নিয়ে এসেছিলেন জেনেভায়। ব্রেকফাস্ট টেবিলে চৌ এন লাই খাজা মোহাম্মদ কায়সারকে জানিয়েছিলেন চীন আর কোনো বিধ্বংসী মারণাস্ত্র পাঠাবে না পাকিস্তানে। কনফারেন্সে ওয়াশিংটন থেকে রাষ্ট্রদূত আগা হেলালী এবং নিউইয়র্ক থেকে রাষ্ট্রদূত আগা শাহী এসেছিলেন। আগা হেলালী জানিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট নিক্সিন এবং তার ন্যাশনাল সিকিউরিটি এডভাইজার হেনরি কিসিঞ্জার ছাড়া আর আমাদের পক্ষে কেউ নেই। বেলগ্রেড থেকে এসেছিলেন ইকবাল আকন্দ। তিনি বললেন, বেলগ্রেডের অবস্থান সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমি ইকবাল আকন্দকে আগে থেকেই জানতাম, কারণ বিবাহের সূত্রে তার সঙ্গে আমার আত্মীয়তা আছে। তার ছোট বোন মিসেস খুরশিদ আহমেদ আমার মামি শাশুড়ি। মিসেস খুরশিদ আহমেদ মিসেস হামিদা হোসেনের বড় বোন। মার্শাল টিটো ছিলেন সম্পূর্ণ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। মার্শাল টিটো প্রস্তাব দিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানকে জেল থেকে মুক্ত করে পাকিস্তানের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে সংকটের সমাধানে অগ্রসর হতে। মার্শাল টিটো ভাবছিলেন এ সমস্যার একমাত্র সমাধান হলো রাজনৈতিক সমঝোতা।

এ কনফারেন্সের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত, গোপনীয় বার্তা খুব দ্রুত আমাকে ওয়াশিংটনে শাহ এ এস এম কিবরিয়া ও কলকাতায় এম হোসেন আলীকে পাঠাতে হয়েছিল এবং কলকাতায় আমার কাউন্টার পার্ট ছিলেন আনোয়ারুল করীম চৌধুরী। লন্ডনে ছিলেন আন্তর্জাতিক ডিপ্লোম্যাটিক রিপ্রেজেন্টেটিভ বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী।

এরপর মুজিবনগর সরকারের নির্দেশে নভেম্বরের ২ তারিখে আমি চাকরি থেকে রিজাইন দিই কিন্তু চাকরি ছাড়ার আগে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত যতগুলো গোপন তথ্য আছে ইসলামাবাদ থেকে সবকিছুই আমি মুজিবনগর সরকারের কাছে পাঠিয়ে দিই তাদের নির্দেশ মোতাবেক। পদত্যাগের দিন ২ নভেম্বর হোটেল Belleuve Palace ইউরোপের প্রায় ১০০ সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। হোটেলে ইউরোপের প্রায় সব সংবাদপত্রে আমার পদত্যাগের খবর প্রকাশিত হয়েছিল পরের দিন। আর এ সবকিছুই করেছি কূটনৈতিক সাংবাদিকতার ভূমিকায়।

ভিন্নভাবে দেখতে গেলে আমার কর্মজীবনে বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং পরের দুটি কথা না বললেই নয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাকে বলা হলো যে, সুইজারল্যান্ডের কোথাও প্রেস ব্রিফিং দিতে পারব না। তাহলে কোথায় যাব, হয় আমাকে জেনেভার বর্ডারে ফ্রান্সে গিয়ে বক্তৃতা দিতে হবে অথবা জাতিসংঘে যে মিডিয়া সেল আছে সেখানে গিয়ে কথা বলতে পারব। আমি ওই মুহূর্তে দুটোই ব্যবহার করলাম এবং অনেক বড় একটা প্রতিক্রিয়া পেলাম। শুধু সুইস মিডিয়াতে নয়- ফরাসি, জার্মান, ইতালিয়ান এবং ফ্রান্স মিডিয়াতে আমরা সাড়া পেলাম। বিশেষ করে ইউএন মিডিয়া সেটে, সেখানে হামিদুল হক চৌধুরীর বড় মেয়ে নাফিসা চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণ শুরু করেছিলেন এবং পরবর্তীতে আমার বিরুদ্ধেও। সেই মুহূর্তে আমি জাতিসংঘের প্রধান ডিরেক্টর জেনারেল Vittorio Winspeare-Guicciardi এর কাছে অভিযোগ করলাম। এর ফলে তার কাছ থেকে প্রেসের আইডি কার্ডটি উইথড্র করে নেওয়া হলো।  কাজেই সেখানে আমাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার ছিল না। পাকিস্তানি মিশন থেকে যারা যেত তারা কোনো কাজ করত না, তাদের কথা কেউ শুনত না। ঠিক যুদ্ধের পরপরই আমরা ইউএনডিপির অনুদানের টাকা ৩৭ মিলিয়ন ডলারের অর্ধেক পেলাম ডেভেলপমেন্টের জন্য।  প্রয়াত জনাব কিবরিয়া ছিলেন ওয়াশিংটন ডিসিতে আর নিউইয়র্কে আমাদের কনসাল ছিলেন আবুল হাসান মাহমুদ আলী। তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে আমি ইউএনডিপির প্রেসিডেন্ট যিনি ছিলেন জেনেভাতে, তার কাছে একটা প্রস্তাবনা দিলাম। তার সঙ্গে আমি রাতে মিটিং করলাম ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে। মিটিংয়ের  পর তিনি বললেন, তোমাদের এই টাকা দেওয়া হবে। এটা প্রস্তুত কর। ইউএনডিপির প্রেসিডেন্ট একটা ড্রাফটের আউটলাইন আমাকে দিলেন। আমেরিকার প্রতিনিধি দলের যিনি প্রধান তার সঙ্গে আমাকে কথা বলতে বললেন। মিটিংয়ে তুমি এ প্রস্তাবনা দেবে এবং একটি বক্তৃতা দেবে। যদিও জাতিসংঘ এখনো তোমাদের স্বীকৃতি দেয়নি তবুও সাড়ে আঠার মিলিয়ন ডলার তোমরা পাবে। সেই মোতাবেক বক্তৃতা তৈরি করলাম, চিঠি লিখলাম। পরের দিন ইউএনডিপির মিটিং হলো WHO বিল্ডিংয়ে এবং সেখানে পাকিস্তানের রিপ্রেজেনটেটিভ ছিলেন রাষ্ট্রদূত নিয়াজ নায়েক। তার বক্তব্যের আগে আমি প্রস্তাব পেশ করলাম এবং বক্তৃতা দিলাম। তখন নিয়াজ নায়েক আমার বক্তৃতার অনেক কটূক্তি করলেন এবং বললেন, রিপ্রেজেনটেটিভ অব ঢাকা যে প্রস্তাব করলেন সেটাকে আমরা অগ্রাহ্য করি এবং আশা করি জাতিসংঘের ইউএনডিপি তারাও এ প্রস্তাবকে অগ্রাহ্য করবে। আনন্দের ব্যাপার সেই প্রস্তাবকে শুধু গ্রহণই করা হলো না, বরং সবাই দাঁড়িয়ে বাংলাদেশকে হাততালি দিয়ে অভিবাদন জানাল এবং সাড়ে আঠার মিলিয়ন ডলার আমাদের দিল। এই প্রথম স্বাধীনতার পরবর্তীকালে আমরা জাতিসংঘের অনুদান পেলাম। এটাই বোধহয় আমার জীবনে প্রথম জাতিসংঘে যুদ্ধ এবং সেই যুদ্ধে আমরা জয়ী হলাম। হয়তো এটাও আমাদের কূটনৈতিক সাংবাদিকতার পর্যায় পড়ে। এগুলো আমরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় করেছি। সেগুলো আজকে নাইবা বললাম।

আমরা পাবলিক ডিপ্লোম্যাসিতে গেছি, যাচ্ছি আরও যেতে হবে, সেখানে আমরা কূটনৈতিক সাংবাদিকতাকে আরও সামনে নিয়ে যেতে পারব। আমাদের স্বাধীনতার ৫১ বছর হতে চলেছে, তার মধ্যে ৩০ বছর কাটিয়েছি সামরিক, আধা-সামরিক শাসনে আর বাকি ২০ বছর গণতান্ত্রিক শাসন চলেছে বাংলাদেশে, সে হিসেবে সাংবাদিকতার দিক দিয়ে আমরা অনেক দূর এগিয়ে গেছি।  পৃথিবীর ইতিহাস দেখলে জানা যাবে যে, বাংলাদেশে যত নিউজ পেপার হয় এত সংখ্যক নিউজ পেপার খুব কম দেশে আছে। কাজেই বাংলাদেশে এ ক্ষেত্রে খুব উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি এবং সেখানে একজন সাংবাদিক যেমন কূটনীতিকের কাজ করে থাকেন তেমন একজন কূটনীতিবিদও সাংবাদিকের কাজ করে থাকেন দেশের ভাবমূর্তিকে এগিয়ে নেওয়াসহ বহির্বিশ্বে সুনাম বৃদ্ধির জন্য।

আগামী ১৫ মার্চ ২০২৩, বাংলাদেশ প্রতিদিন ১৪তম বর্ষে পদার্পণ করতে যাচ্ছে। বাংলাদেশে অনেক সংবাদ পত্রিকা আছে তার মধ্যে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখে বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকা সুনামের সঙ্গে সগৌরবে টিকে আছে। বাংলাদেশ প্রতিদিন বর্তমানে বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক সংবাদপত্রে পরিণত হয়েছে। দিন দিন তথ্য প্রযুক্তির নতুন নতুন উদ্ভাবন গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার নতুন দিক উন্মোচন করেছে।  আশা করি বাংলাদেশ প্রতিদিনও তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, অনন্য অর্জন ও নৈতিক আদর্শ নিয়ে এগিয়ে যাবে। গণমানুষের আস্থা ও ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে থাকবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর