বুধবার, ১৫ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

বাংলাদেশ প্রতিদিনের শুভ জন্মদিন

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম , রাজনীতিক

বাংলাদেশ প্রতিদিনের শুভ জন্মদিন

আসলে আমার জীবনটা শুরু থেকেই কেমন যেন খাপছাড়া, এলোমেলো।  কখনো পরিকল্পিতভাবে এগোয়নি। ছেলেবেলায় লেখাপড়ায় এত কাঁচা ছিলাম যা বলেকয়ে শেষ করা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও যে তেমন খুব একটা পন্ডিত হয়েছিলাম তা নয়। প্রবাদ আছে, ‘বাঙ্গি বনে শিয়াল রাজা’, আমিও অনেকটা তেমন।  যখন কেউ ছিল না তখন মুক্তিযুদ্ধের সেই দুর্যোগপূর্ণ দিনে আমি ছিলাম। যখন মৃত্যু ছিল পায়ে পায়ে, গায়ে গায়ে;

 

১৫ মার্চ দেশের বহুল প্রচারিত বাংলাদেশ প্রতিদিনের ১৩তম বর্ষপূর্তি। বর্ষপূর্তির জন্য বিশেষ ক্রোড়পত্র ছাপা হবে। প্রিয় সম্পাদক নঈম নিজামের চিঠি এসেছে ‘লেখা চাই’। আসলে আমার জীবনটা শুরু থেকেই কেমন যেন খাপছাড়া, এলোমেলো। কখনো পরিকল্পিতভাবে এগোয়নি।  ছেলেবেলায় লেখাপড়ায় এত কাঁচা ছিলাম যা বলেকয়ে শেষ করা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও যে তেমন খুব একটা পন্ডিত হয়েছিলাম তা নয়। প্রবাদ আছে, ‘বাঙ্গি বনে শিয়াল রাজা’, আমিও অনেকটা তেমন। যখন কেউ ছিল না তখন মুক্তিযুদ্ধের সেই দুর্যোগপূর্ণ দিনে আমি ছিলাম। যখন মৃত্যু ছিল পায়ে পায়ে, গায়ে গায়ে; কখন মৃত্যু এসে ছোবল মারে সেসব ভাবার সুযোগ ছিল না, ঠিক সেই সময় জীবন বাজি রেখে রুখে দাঁড়িয়েছিলাম। হ্যাঁ, এটা ঠিক, তখন তেমন প্রতিদ্বন্দ্বী নেতা, উপনেতা বা পাতিনেতা ছিল না। কিন্তু পাকিস্তান হানাদাররা যমদূতের মতো গায়ে গায়ে, পায়ে পায়ে ছিল সর্বত্র। সেই হানাদারদের ঠেকিয়ে রাখা ছিল এক অভাবনীয় ব্যাপার। আল্লাহর দয়ায় সেই অভাবনীয় কাজটি আমরা করতে পেরেছিলাম, তাই আজও বেঁচে আছি। কিন্তু একেবারে অসময়ে হঠাৎই বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে সেই যে তখন থেকে এক অসহনীয় চরম যাতনার মধ্যে চলেছি।  কবে যে এর শেষ কিছুই জানি না।

তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পে যে কেয়ামতের আলামত দেখলাম, তা এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। এভাবে মুহূর্তে সবকিছু তছনছ, বিলীন হয়ে যাওয়া অভাবনীয়। এটা ইসরাফিল (আ.)-এর শিঙায় ফুঁ দিয়ে পৃথিবী ধ্বংস করে ফেলার মতো। যেখানে ভূমিকম্প হয়েছে, সেখানে কেয়ামতের চেয়ে কম কিছু হয়নি। দিনে ভূমিকম্প হলে হয়তো কিছু মানুষ কম মারা যেত। দিনে হলে বাচ্চাকাচ্চারা স্কুলে এবং অনেক মানুষ কর্মক্ষেত্রে থাকত। সেসব জায়গা ভূমিকম্পের আওতায় না পড়লে হয়তো আরও কিছু মানুষের প্রাণহানি কম হতো। শুধু মানুষ কেন, কত জীবজন্তু মারা গেছে, সম্পদের ক্ষতি হয়েছে।

তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পে যে প্রাণ ও সম্পদের ক্ষতি হয়েছে তা অভাবনীয়। এ পর্যন্ত ৫৬ হাজার মানুষের লাশ উদ্ধার হয়েছে। প্রাণহানি ঘটেছে আরও অনেক অনেক বেশি। ২০০ ঘণ্টা পরও ধ্বংসস্তূপের ভিতর থেকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে, এটাই আল্লাহর লীলা। তুরস্ক ও সিরিয়া তার ব্যতিক্রম নয়। তবে দুর্গতদের জন্য আমরা কে কী করছি, এটাই বড় কথা। সত্যিই গর্ব হয়। আমরা তুরস্কের দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াতে পেরেছি। এমনকি আমাদের উদ্ধারকারী দল এ পর্যন্ত কয়েকজনকে জীবিত উদ্ধার করেছে। সুরা মায়েদার ৩০-৩১ আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘যে ফ্যাসাদ করে হত্যা করে এমন ছাড়া কেউ একজনকে হত্যা করলে সে যেন সারা পৃথিবীকে হত্যা করল। ঠিক তেমনি কেউ যদি একজনকেও রক্ষা করে তাহলে সে যেন সারা দুনিয়ার মানুষকে রক্ষা করল।’ আমার কাছে আজ তেমনই মনে হচ্ছে। আমাদের উদ্ধারকারী দল মনে হয় সারা পৃথিবীকে উদ্ধার বা রক্ষা করেছে।

৭০-৮০টি দেশ উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ অনেক আগেই অংশ নিয়েছে। এটা খুবই গর্বের কথা, ভূমিকম্পের চার দিন পর বাংলাদেশের উদ্ধারকারী দল উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়েই একজনকে জীবিত উদ্ধার করেছে। এটা আমাদের জন্য পরম সৌভাগ্য এবং গৌরবের। আমাদের উদ্ধারকারী দল তুরস্কে পাঠানো বর্তমান সরকারের সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত। একসময় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বর্তমান সরকারপ্রধান বোন হাসিনা মানবতার দরবারে উচ্চাসনে আরোহণ করেছিলেন। মানবতার খাতিরে রোহিঙ্গাদের জায়গা দিয়ে তিনি শাশ্বত বাঙালির উদার মনের পরিচয় দিয়েছিলেন। তুরস্ক ও যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের উদ্ধারে তেমন কোনো আধুনিক যন্ত্রপাতি, ভারী কোনো যন্ত্রপাতি দেখা যাচ্ছে না। যেমনটা কয়েক বছর আগে আমাদের সাভারের রানা প্লাজা ধসে দেখা যায়নি।  আমাদের তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেছিলেন, ‘বিএনপির আন্দোলনকারীরা রানা প্লাজার দেয়াল ধরে নাড়াচাড়া করেছে তাই ধসে পড়েছে।’ এমন বোধহীন বাংলাদেশে দ্বিতীয় কেউ আছে বলে মনে হয় না।  সেই রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে মাঝেমধ্যে দু-চারজন জীবিতকে উদ্ধার করে উদ্ধারকারী দল ‘আল্লাহ আকবর’ ধ্বনি তুলে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তুলত। কেউ কাউকে শিখিয়ে দেয়নি। পরম আনন্দে তারা ‘আল্লাহ আকবর’ ধ্বনি তুলেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরাও কত জায়গায় ‘আল্লাহ আকবর’ ধ্বনি তুলে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তুলেছি। কাছাকাছি থাকা হানাদাররা অনেক সময় আমাদের কণ্ঠে ‘আল্লাহ আকবর’ শুনে চিৎকার করত, চেঁচামেচি-গালাগালি করত ‘শালা লোক জয় বাংলা ভি বলতা হ্যায়, আউর আল্লাহ আকবর ভি বলতা হ্যায়। শালা লোক ক্যায়সা আদমি হ্যায়।’ আমার এখনো মনে পড়ে, ’৬২ সালে শরিফ শিক্ষা কমিশন বাতিল আন্দোলনে সাদত কলেজের ভিপি ফজলুল করিম মিঠু, ফজলুর রহমান ফারুক, শওকত তালুকদার, আল মুজাহিদী, লতিফ সিদ্দিকী, আবু মোহাম্মদ আনোয়ার বক্স, বুলবুল খান মাহবুব, আতিকুর রহমান সালু ছিলেন। শাজাহান সিরাজকে তখনো দেখিনি। তাকে দেখেছি ’৬৪-৬৫-এর পর। হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর যখন মিছিল হতো, তখনো মাঝেসাঝে ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহ আকবর’ ধ্বনি দেওয়া হতো।  আমরা কেউ তখন সেই ধ্বনিকে সাম্প্রদায়িক ভাবিনি। ভেবেছি শক্তি। তখন দেশের মানুষ এমন ছিল না। অনেক ন্যায়নীতি ছিল। কিন্তু এখন সেসব কোথায় মিলিয়ে গেছে আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় নীতি-নৈতিকতার দিক থেকে শ্রেষ্ঠ ছিলাম। এখন আমরা আবার সেই নৈতিকতা কীভাবে ফিরে পাব বুঝতে পারছি না। পাকিস্তানিদের কাছে অনেক আঘাত পেয়েছি, যুদ্ধ ক্ষেত্রে গুলি খেয়েছি, রক্ত দিয়েছি। আমাদের বুকের রক্ত দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে এখন কেউ যদি ‘বাই চান্স’ বলে, তাকে কী বলি? স্বাধীনতায় যাদের বিন্দুমাত্র ভূমিকা নেই, তাদের এ রকম রাষ্ট্রবিরোধী, মানবতাবিরোধী কথাবার্তা ভালো লাগে না। এসবের বিচার হওয়া উচিত। আবার আর এক নেতা বলেছেন, ‘এর চাইতে পাকিস্তানই ভালো ছিল’! সত্যিই তার কাছে যদি পাকিস্তান ভালো লাগে তাহলে রক্তে ভেজা বাংলাদেশে কেন? যান না পাকিস্তানে। পাকিস্তানে গিয়ে দেখুন, লাফালাফি চিৎকার-ফাৎকার করুন। কেউ বাধা দেবে না। বাংলাদেশে থাকবেন, খাবেন আর পাকিস্তানের কীর্তন করবেন তা মেনে নেওয়া যায় না। পাকিস্তানের জন্য এত দরদ, পাকিস্তানি হতে চান, যান না পাকিস্তান। একবার ঝাপসা চোখ মুছে পাকিস্তানের দিকে তাকান। ভালো করে দেখুন পাকিস্তানের অবস্থা। যেভাবে চলছে পাকিস্তান, সেভাবে চললে কয় টুকরো হবে বলা যায় না। পাকিস্তানে কখনো গণতন্ত্র নিরাপদ ছিল না। গণতান্ত্রিকভাবে পাকিস্তান কখনো চলেনি। এখনো চলছে না। ইমরান খান বিশ্বখ্যাত ক্রিকেটার। তিনি পাকিস্তানকে ক্রিকেটে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ খেতাব এনে দিয়েছিলেন। একজন প্রকৃত নেতার যে গুণ থাকা দরকার তার প্রায় সবই আছে। তাকে নিয়ে কী খেলাই না হচ্ছে! জনতা তার দিকে, মানুষ তার দিকে। কিন্তু সরকার তাকে পদে পদে নাজেহাল করার চেষ্টা করছে। সেই পাকিস্তানে যদি কারও যেতে ইচ্ছা করে তাহলে কে বাধা দেবে। তবে এটা বলতে পারি, শহীদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করে যারা বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানাতে চান, তারা কোনো দিন কোনোভাবে সফল হবেন না। কারণ বাংলাদেশকে পাকিস্তানে ফিরিয়ে নিতে বাংলার মানুষ রক্ত দেয়নি, মা-বোন সম্ভ্রম দেয়নি। তাই সরকারবিরোধী রাজনীতি করলেই যা খুশি তা বলা যাবে, করা যাবে তা ঠিক না। এ রকম কথাবার্তা বাংলার মানুষ কখনো গ্রহণ করবে না। তাই সাধু সাবধান! সীমার বাইরে যাবেন না। সীমা লঙ্ঘনকারীকে দয়ালু স্রষ্টা পছন্দ করেন না, সাধারণ মানুষও করে না। মনে রাখবেন, সবসময় সবকিছু অর্থ-বিত্ত বা গায়ের জোরে চলে না। পাকিস্তানিদের গায়ের জোর, অস্ত্রের জোর আমাদের চেয়ে হাজার গুণ বেশি ছিল। তবু কেন তারা আমাদের হাতে পরাজিত হলো। কারণ আমরা ছিলাম ন্যায় ও সত্যের পক্ষে, পাকিস্তানিরা ছিল অন্যায় ও অসত্যের দিকে। তাই তারা পরাজিত হয়েছে। প্রিয় নবী (সা.)-এর সময় বদরের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীতে ৩১৩ জন ছিল। অন্যদিকে আক্রমণকারীরা ছিল হাজারের ওপর। কিন্তু তারা মুসলিম বাহিনীর সঙ্গে পেরে ওঠেনি। কারণ অমুসলিম বাতিলদের আল্লাহ পছন্দ করেননি। তাই তারা হেরে গেছে। আল্লাহকে নাখোশ করে কেউ কোনো দিন জয়ী হতে পারে না, কোনো দিন পারবেও না। তাই যারা দেশকে নিয়ে টানাটানি করেন, দেশকে ধ্বংস করতে চান তারা কোনোমতেই সফল হবেন না।

অগ্নিগর্ভা বিশ্বের পরিস্থিতি দেখে আমরা খুবই শঙ্কিত। দেশ মোটেই ভালো নেই। বাজারের দিকে তাকানো যায় না। সাধারণ মানুষের সবকিছুতেই নাভিশ্বাস উঠেছে। তেলের দাম, বিদ্যুতের দাম, গ্যাসের দাম প্রতিদিন ইচ্ছামতো বৃদ্ধি- এর অশুভ ফল ফলতে বাধ্য। উচ্চপদের অনেকের বেপরোয়াভাব মানুষ ভালো চোখে দেখছে না। চাল-ডাল-নুন-তেল-মরিচ-পিঁয়াজ সবকিছুই দিন এনে দিনে খাওয়া মানুষের নাগালের বাইরে। এসব অত্যন্ত যত্ন নিয়ে দেখা দরকার। বিরোধী দলের শুধু শুধু সমালোচনা করলেই যে এর কোনো সমাধান বা প্রতিকার হবে, তেমন নয়। এর প্রতিকারের জন্য সরকারকে আরও আন্তরিক হতে হবে। বিএনপির সমালোচনা আর সব বিরোধী দলের সমালোচনা এক নয়। সমালোচনা আর শত্রুতাও এক নয়। সমালোচনা আর গালাগাল সে-ও এক কথা নয়। বিষয়গুলো সবাইকে ভাবতে বলছি। যারা আজ বড় বড় নেতা, ক্ষমতাধর, আলিশান প্রাসাদের বাসিন্দা; বাংলাদেশ না হলে তারা অনেকেই পিয়ন-দারোয়ানের চাকরিও পেতেন না। তাই দেশকে, মুক্তিযুদ্ধকে, বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের তাচ্ছিল্য বা অপমান করবেন না, একটু সম্মান করার চেষ্টা করুন।

’৭৫-এর ১৪ আগস্ট ছিল বৃহস্পতিবার, জেলা গভর্নরদের প্রশিক্ষণ শেষ। সেদিন যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণির দুটি ক্লাস ছিল। যেমন অসাধারণ বলতেন, লিখতেন তার চেয়েও ভালো। অনেক ক্লাসে অনেক রকম কথা হতো, বক্তৃতা হতো। সেসবে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। সত্যিকার অর্থে ’৭৫-এ জেলা গভর্নর প্রশিক্ষণে মন দিয়ে অংশগ্রহণ না করলে এত দিন গাং দিয়ে ভেসে যেতাম। জ্ঞানী-পন্ডিতদের জ্ঞানের চাপায় কবে ব্যাঙচ্যাপ্টা হয়ে যেতাম, যা শুধু আল্লাহই জানেন। আমার সারা জীবনের যে বিদ্যা অন্তত তার অর্ধেক অর্জিত হয়েছিল ’৭৫-এ জেলা গভর্নর প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে। শেষের দিন শেষ ক্লাসে শেখ ফজলুল হক মণি বলেছিলেন, ‘আমরা যে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিয়েছি এ পদক্ষেপে সফল হলে সারা পৃথিবী আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে। অনেকে আমাদের অনুকরণ-অনুসরণ করবে। সারা পৃথিবীতে আমরা হব পথপ্রদর্শক। তবে এটা সহজে হবে না। আমাদের এই যুগান্তকারী পদক্ষেপে যারা লাভবান হবে তারা এখনো ঘুমিয়ে। তাদের প্রত্যক্ষ লাভ পেতে বেশ সময় লাগবে। কিন্তু আমাদের এই যুগান্তকারী পদক্ষেপে যারা ক্ষতিগ্রস্ত তারা কিন্তু মরিয়া হয়ে আমাদের ব্যর্থ করার চেষ্টা করছে। আমরা যদি তা না বুঝি ধ্বংস হয়ে যাব। মহাধ্বংসের হাত থেকে আমাদের কেউ রক্ষা করতে পারবে না।’ মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে আমাদের ধ্যানজ্ঞান, আমাদের শক্তি-সাহস যে মানুষটিকে ঘিরে তাঁকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। নির্মম হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে সবকিছু এলোমেলো, সবকিছু অন্ধকার হয়ে যায়। ১৫ আগস্ট ভোর ৫টা-সাড়ে ৫টার দিকে ছোটবোন শুশু দরজায় কড়া নাড়ে, ‘ছোট ভাই ছোট ভাই, দরজা খোলেন। ক্যু হয়েছে, ক্যু হয়েছে।’ দরজা খুললে সে উ™£ান্তের মতো বলে ‘ক্যু হয়েছে, ক্যু হয়েছে। রহিমা আপা ফোনে আছে।’ ড্রয়িংরুমে গিয়ে ফোন ধরলে রহিমার এক কথা- ‘ছোট ভাই বেরিয়ে যান, ক্যু হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সরকারের পতন হয়েছে।’ ভীষণ বিস্মিত হয়েছিলাম। কারণ ১৪ তারিখ রাত ১টা ৪০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির বাড়িতে দেখে এসেছিলাম। ১টা ৪০ মিনিটকে তো ১৫ তারিখই বলে। আমরা যদি রাত ১২টার হিসাব না করি তাহলে সেটা ১৪ তারিখ। কিন্তু আদতে সেটা ১৫ তারিখই ছিল। মাত্র ৪-৫ ঘণ্টা আগের কথা। প্রথম প্রথম বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কিন্তু বেরিয়ে পড়েছিলাম। গিয়েছিলাম গণভবনের কাছে। সেখানে এক জয়েন্ট সেক্রেটারি মনসুর আলী বাধা দিয়েছিলেন। কেন তিনি তখন সেখানে ছিলেন, জানি না।

-কোথায় যান?

বলেছিলাম, রক্ষীবাহিনী ক্যাম্পে।

-না, ভালোভাবে খোঁজখবর না নিয়ে ওদিকে যাবেন না।

কেন যে তার কথায় ফিরেছিলাম, কোনো যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পারব না। তার পরে গিয়েছিলাম ধানমন্ডি ৩২-এর দিকে। ২৭ নম্বর হয়ে ৩২-এর বাড়িতে যাওয়ার পথে পিতার এক বাড়ি পশ্চিমে এক ভদ্রলোক রাস্তা আগলে ধরেছিলেন। এক টানে আমাকে তার ড্রয়িংরুমে নিয়ে বসিয়েছিলেন। আমার সারা শরীর ঘামছিল। চোখ দিয়ে অবিরাম পানি ঝরছিল। ভদ্রলোক এক গ্লাস পানি দিয়েছিলেন। সেই পানি পান করতে কয়েক সেকেন্ড লেগে ছিল। ভদ্রলোক আমার থেকে খুব বেশি বড় হবেন না। মাথা-পিঠে হাত বুলিয়ে বলছিলেন, ‘ও বাড়ির সব শেষ হয়ে গেছে। আপনি গেলে আপনার ওপরও কয়েকটা বুলেট খরচ করবে। ফিরে যান। তারপর যা করার করুন।’ সেখান থেকে ফিরে এসেছিলাম। উঠেছিলাম গজনবী রোডে দাদু মোহাম্মদ মোদাব্বেরের বাড়ি। সেখানে দুপুর পর্যন্ত ছিলাম। তারপর খিলজি রোডে। সারা দিন কীভাবে গেছে বলতে পারব না। সন্ধ্যায় সবাই জোর করে খাবার টেবিলে নিয়ে গিয়েছিল। টেবিলে বেশ কয়েক রকমের তরিতরকারি, সঙ্গে মাংস ছিল। শাকসবজি, ভাজি দিয়ে হয়তো দু-চার লোকমা মুখে দিয়েছিলাম। এক টুকরা মাংস যেই মুখে দিয়েছি তখনই মনে হলো আমি যেন বঙ্গবন্ধুর মাংস চিবাচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে মুখের খাবার ফেলে দিয়েছিলাম। চোখ থেকে অঝোরে পানি পড়ছিল। ছেলেবেলায় বড়দের কাছে শুনেছি, খাবার থালায় চোখের পানি পড়লে দুঃখ বাড়ে, যন্ত্রণা হয়। ভবিষ্যৎ হয় অনিশ্চিত। আমারও তা-ই হয়েছে। কয়েক ফোঁটা চোখের পানি ভাতের থালায় পড়ায় কতই যে দুঃখ বেড়েছে তার যেন শেষ নেই। চারদিকে অন্ধকার। এমন অমানিশার অন্ধকার জীবনে দেখিনি। মুক্তিযুদ্ধ করেছি, না খেয়ে থেকেছি। কিন্তু পথ হারাইনি। বঙ্গবন্ধুর নির্র্মম হত্যা এ যেন সবকিছু অন্ধকার করে দিয়েছে। দেহমনে কেন যেন বল নেই। শুধুই এক অসহায় ভাব। খিলজি রোডের সবুর দারোগার বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম। উঠেছিলাম কলোনির এক বাড়িতে। সেখান থেকে সর্বপ্রথম এক লিফলেট ছেড়েছিলাম। লিখেছিলাম, ‘খুনিরা বঙ্গবন্ধুর তিন পুত্র কামাল-জামাল-রাসেলকে হত্যা করতে পারলেও তাকে নির্বংশ করতে পারেনি। আমি কাদের সিদ্দিকী বঙ্গপিতার চতুর্থ সন্তান। পিতৃহত্যার বদলা আমরা নিবোই নিবো।’

ছেলেবেলায় অনেকটা সময় হেলাফেলায় কাটিয়েছি। জীবনের পাঁচ-ছয়টি শিক্ষাবছর অহেতুক নষ্ট করেছি। তার পরও কলেজে এসে যখন কিছুটা লেখাপড়ার দিকে আকৃষ্ট হয়েছিলাম ঠিক তখনই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। সেই যুদ্ধ আমাকে বদলে দেয়, কী করে কেমনভাবে যেন নতুন মানুষ হয়ে যাই। কাজেকর্মে ফাঁকিজুকি, অলসতা বড় বেশি বুকে বাঁধে। সেই বুকের বাঁধাই আমাকে আজকের পর্যায়ে এনেছে। ’৭৫-এর প্রতিরোধযুদ্ধের একপর্যায়ে নির্বাসিত জীবনে বড় বেশি একাকিত্ব বোধ করেছি। একসময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রিয় বোন শেখ হাসিনা দেশে চলে এলে একাকিত্ব আরও বেড়ে যায়। বোন থাকতে ভাগনে-ভাগনি জয়-পুতুলের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই দেখা হতো, সময় কাটত। নতুন দিল্লির ১৬ পান্ডারা রোডে গেলে জয়-পুতুল যেমন খুশি হতো, আমারও ভালো লাগত, বোনও ভীষণ খুশি হতেন। আমার জন্য এটাওটা কতরকম বেহিসাবি খাবার বানাতেন। পরম আগ্রহে খাবার বানাতে গিয়ে তিনিও অনেকটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। ওই সময়টুকু তাঁর ভালো কাটত। কিন্তু প্রিয় বোন ’৮১ সালে চলে এলে সময় যেন পাথর হয়ে বুকে চেপে বসে। এ সময় দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কের জে-১৮৮১ নম্বর যে বাড়িতে থাকতাম, সেই বাড়ির কর্তা এ সি সেন মানে অমরেশ চন্দ্র সেন নানাভাবে চেষ্টাতদবির করে আমাকে বই পড়তে শিখিয়েছিলেন। আর কিছুটা লিখতে শিখেছিলাম কলকাতার দৈনিক যুগান্তর ও এলাহাবাদের রমাপ্রসাদ ঘোষালের আলোকপাতে লিখে। ’৯০-এ দেশে ফেরার পর কয়েক বছর একেওকে এটাওটা লেখা দিতে দিতে কিছুটা লেখার অভ্যাস হয়েছিল। অন্যদিকে ভারতের মহান নেতা ও রাষ্ট্রপিতা মহাত্মা গান্ধী প্রায় ৭০ হাজার চিঠি লিখেছিলেন। প্রবাসে থাকার কারণে আমিও প্রায় ৮০ হাজারের ওপর চিঠিপত্র পেয়েছি, প্রায় ৬০ হাজার চিঠির উত্তর লিখেছি। তাই কীভাবে কীভাবে যেন লেখার একটা গতি এসেছিল। কিন্তু সেটা স্থায়ী রূপ নিয়েছে বাংলাদেশ প্রতিদিন জন্মের পর। বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রাণপুরুষ নঈম নিজামকে খুবই ভালোবাসি। দেশে ফিরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এখানে-ওখানে সাংবাদিক হিসেবে বোরহান কবীর, নঈম নিজাম, শাহেদ চৌধুরীসহ আরও বেশ কয়েকজনকে মাঝেমধ্যেই দেখেছি। সংবাদ সংগ্রহে কী যে অমানুষিক কষ্ট তারা করেছেন। এখন অনেক মাধ্যমের কারণে সংবাদ সংগ্রহে আগের মতো তেমন অমানুষিক কষ্ট করতে হয় না। আর সেই সময়ের সাংবাদিকদের মতো নিষ্ঠা-ভালোবাসা এখন অনেকের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। সেই কঠিন সময় পার করতে গিয়ে অনেক কঠিন অবস্থাকে অতিক্রম করতে হয়েছে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর দেশে এক নবযুগের সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে সংবাদপত্র জগতে এবং কিছুদিন পর ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিল পাকিস্তান রেডিও ও টেলিভিশন, ভারতের আকাশবাণী ও দূরদর্শন, আমাদের স্বাধীন বাংলা বেতার। কিন্তু এখন পৃথিবীজোড়া শত শত ইলেকট্রনিক মিডিয়া, রেডিও-টেলিভিশন, পত্রপত্রিকা। আজ থেকে ৫০ বছর আগে একটা পত্রিকা ছাপতে যে সময় লাগত এখন সেই সময়ে একটা বই ছাপা যায়। বিজ্ঞানের কী যে উন্নতি হয়েছে, কাউকে বলেকয়ে বোঝানো যাবে না। বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ন্যায়নীতি-মানবতার অনেক অবনতি হয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিদিনে লেখালেখি শুরু করেছি যখন পত্রিকাটি মগবাজারের রেড ক্রস অফিসের কাছে ছিল। প্রতিদিনের প্রাণপুরুষ নঈম নিজাম কী করে যেন ইলেকট্রনিক মিডিয়া এটিএন বাংলায় গিয়েছিলেন। তখন এটিএন বাংলার খুবই দুর্দিন। হঠাৎ ইরাকের যুদ্ধ শুরু। এটিএন বাংলা ঘণ্টায় ঘণ্টায় সংবাদ পরিবেশন শুরু করে। অল্প দিনে কপাল খুলে যায়। বিজ্ঞাপন বেড়ে যায় হাজার গুণ। এর কিছুদিন পর নঈম নিজামের নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিদিন যাত্রা শুরু করে। প্রথমে তিনি ছিলেন ব্যবস্থাপনা সম্পাদক। ইলেকট্রনিক মিডিয়া থেকে প্রিন্ট মিডিয়ায় ফিরতে খুব কম সাংবাদিককেই দেখেছি। এরপর আর তাঁকে এবং বাংলাদেশ প্রতিদিনকে পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। পত্রিকাটি প্রথম ছিল ২ টাকার, এখন ৭ টাকা। ২ টাকায় যেমন চলত, ৭ টাকায়ও তেমন চলে। বরং ২ টাকার চেয়ে ৭ টাকার বাংলাদেশ প্রতিদিন অনেক বেশি চলে। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্রচারিত-পঠিত পত্রিকা বাংলাদেশ প্রতিদিন। পাঠকপ্রিয়তায় সবার সেরা। বাংলাদেশ প্রতিদিনে একসময় পীর হাবিব যোগদান করায় সম্পাদকীয় কলামের মর্যাদা আরও অনেক বেড়ে যায়। আমি আমার জীবনে কোনো সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় এত আলোচিত, এত জনপ্রিয় হতে পারে কখনো দেখিনি। মুক্তিযুদ্ধের আগে ইত্তেফাক ছিল খুবই জনপ্রিয় পত্রিকা। ইত্তেফাকের জন্ম হয়েছিল মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মাধ্যমে।  তিনি সভা-সমাবেশে গিয়ে পাঞ্জাবি পেতে মানুষের কাছে সাহায্য চাইতেন এবং তা ইত্তেফাকের প্রাণপুরুষ তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার হাতে তুলে দিতেন। যদিও বাংলাদেশ প্রতিদিনের জন্য জনগণের কাছে হাত পেতে সাহায্য চাইতে হয় না। কিন্তু জনপ্রিয়তা পাঠকপ্রিয়তার দিক থেকে প্রচ- গতিতে এগিয়ে গেছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর বহু দেশে ইন্টারনেটে তো বটেই, কাগজে ছাপা বাংলাদেশ প্রতিদিনও ঘরে ঘরে পাওয়া যায়।  তাই তার শুভ জন্মদিনে পত্রিকার সঙ্গে লেখালেখি করা একজন হিসেবে খুবই গর্ববোধ করি এবং পত্রিকাটির সাফল্য কামনা করছি। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিদিনসংশ্লিষ্ট সবার মঙ্গল ও পত্রিকাটির সাফল্য কামনা করছি।

সর্বশেষ খবর