রবিবার, ১৯ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

আমলাদের সঙ্গে সাংবাদিকদের সম্পর্ক

আবু আলম মো. শহিদ খান, সাবেক সচিব

আমলাদের সঙ্গে সাংবাদিকদের সম্পর্ক

স্বাধীন ও শক্তিশালী সংবাদমাধ্যম সুশাসন প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার রক্ষা ও  রাষ্ট্রযন্ত্রের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে যায়।

 

আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্র বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে কোনো ধরনের সরকার ব্যবস্থায় গণকর্মচারীদের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনার জন্য রাজনীতিবিদদের স্থায়ী গণকর্মচারীদের ওপরই নির্ভর করতে হয়। এর চেয়ে কোনো ভালো বিকল্প আমাদের হাতে আপাতত নেই। তাই, গণকর্মচারীদের দলনিরপেক্ষ, জনবান্ধব, মিডিয়াবান্ধব, সৎ, যোগ্য, দক্ষ ও পেশাদার হবেন এটাই সবার চাওয়া।  নাগরিক সমাজের প্রত্যাশা সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রের ন্যায়পরায়ণ আচরণ গণকর্মচারীদের মাধ্যমেই নিশ্চিত হবে।

আমরা সবাই জানি, কর্তৃত্বপরায়ণতা, কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা, দায়িত্বের অপব্যবহার, অদক্ষতা, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা সুশাসনের প্রধান প্রধান অন্তরায়। স্বাধীন ও শক্তিশালী সংবাদমাধ্যম সুশাসন প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার রক্ষা ও রাষ্ট্রযন্ত্রের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে যায়। গণমাধ্যম উন্মোচন করে দেয় রাষ্ট্রযন্ত্রের নানান বিচ্যুতি। গণমাধ্যমের পূর্ণ ও অবাধ স্বাধীনতা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে আমাদের পবিত্র সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক্-স্বাধীনতা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করা হয়েছে। সংবিধানে সেটি যেভাবে বিবৃত আছে-৩৯। (১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইল। (২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে —(ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং (খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।

বিগত ৫০ বছরের চিত্র হচ্ছে দেশের গণমাধ্যম কখনোই পুরোপুরি স্বাধীন ছিল না। শাসকগোষ্ঠী এবং গণকর্মচারীরা বারবার সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে আমাদের গণমাধ্যমের ভূমিকাও তেমন শক্তিশালী নয়। কোনো কোনো মিডিয়া হাউস, সম্পাদক, প্রকাশক এবং গণমাধ্যমকর্মী গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অপব্যবহার করে ক্ষেত্রবিশেষে বিশেষ সুবিধা নিয়ে, চাটুকারিতা করে তাদের গ্রহণযোগ্যতা ও অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।

গণকর্মচারীদের সঙ্গে গণমাধ্যমকর্মীদের সম্পর্ক যতটা টক ঝাল ততটা মিষ্ট নয়। আমলা সংস্কৃতি, যা আমরা বহন করছি ঔপনিবেশিক আমল থেকে, সংবাদকর্মীবান্ধব নয়। জনগণ এবং মিডিয়ার কাছ থেকে সবকিছু লুকিয়ে রাখা শেখানো হয় গণকর্মচারীদের। এ জন্য ছিল/আছে The Official Secrets Act, 1923 (ACT NO. XIX OF 1923) । আইনটি সমগ্র ভারতবাসীর ওপর ব্রিটিশরা চাপিয়ে দিয়েছিল ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ এবং নির্যাতন পাকাপোক্ত করার জন্য। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ (বিজয় দিবস) থেকে কার্যকর হয়। পবিত্র সংবিধানের ‘মৌলিক অধিকার’ ভাগে মৌলিক অধিকারের সহিত অসামঞ্জস্য আইন বাতিল বিষয়ে বলা হয়েছে- ২৬। (১) এই ভাগের বিধানাবলির সহিত অসামঞ্জস্য সকল প্রচলিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, এই সংবিধান-প্রবর্তন হইতে সেই সকল আইনের ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে। (২) রাষ্ট্র এই ভাগের কোন বিধানের সহিত অসামঞ্জস্য কোন আইন প্রণয়ন করিবেন না এবং অনুরূপ কোন আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোন বিধানের সহিত যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে। কিন্তু সেটি করা হয়নি। উল্টো প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পড়ানো হয়েছে এই আইনটি। ফলাফল সহজেই অনুমেয়। সমসাময়িক সময়ে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়ের করা অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টস, ১৯২৩ ও দন্ডবিধিতে বর্ণিত চুরির অভিযোগে করা মামলাটিতে অভিযোগ এই যে, চীন রাশিয়ার সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সম্ভাব্য চুক্তির ডকুমেন্টস তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ঢুকে চুরি করেছেন।

বর্তমান সরকার জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশকারীকে আইনগত সুরক্ষা প্রদানের জন্য জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন, ২০১১ প্রণয়ন করেছে। তার আগে ২০০৯ সালে সরকার তথ্যের অবাধ প্রবাহ এবং জনগণের তথ্য অধিকার নিশ্চিতকরণের নিমিত্ত বিধান করবার লক্ষ্যে তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ প্রণয়ন করে। তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯-এর প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে- ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে চিন্তা, বিবেক ও বাক-স্বাধীনতা নাগরিকগণের অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃত এবং তথ্য প্রাপ্তির অধিকার চিন্তা, বিবেক ও বাক-স্বাধীনতার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ; এবং জনগণ প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক ও জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য তথ্য অধিকার নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক; এবং জনগণের তথ্য অধিকার নিশ্চিত করা হইলে সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থা এবং সরকারী ও বিদেশী অর্থায়নে সৃষ্ট বা পরিচালিত বেসরকারী সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পাইবে, দুর্নীতি হ্রাস পাইবে ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হইবে; এবং সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থা এবং যেহেতু সরকারী ও বিদেশী অর্থায়নে সৃষ্ট বা পরিচালিত বেসরকারী সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বিধান করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয় মনে করে।’ কিন্তু অফিসিয়াল সিক্রেটস এক্টস ১৯২৩, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ প্রয়োগে সরকার এবং আমলা পুলিশ যত তৎপর তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন, ২০১১ প্রয়োগে কিংবা চর্চায় মোটেও উৎসাহী নয়। সরকার না চাইলে আমলারা বোধকরি কোনো ঝুঁকি নিতে চান না। অথচ তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন, ২০১১ সুশাসনের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল বয়ে আনতে পারে। অবস্থা যাই হোক না মানুষের তথ্য জানার অধিকার এবং তথ্য জানানোর দায়বদ্ধতার প্রশ্নে যার যে ভূমিকা তা পালন করতে হবে।

গণমাধ্যম আমলাদের শত্রু নয়। আমার দীর্ঘ চাকরিজীবনে আমি গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কাজ করেছি। তাদের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। তাদের তথ্য দিয়েছি। এর ফলে দেশ এবং রাষ্ট্রের কোনো ক্ষতি হয়নি। আমরা আরও ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর আমলে নিয়ে আমরা আমাদের সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করতে সক্ষম হয়েছি। তবে ব্যক্তিগত বিদ্বেষ, একপেশে খবর ও পত্রিকার কাটতি বাড়ানোর জন্য নৈতিকতাবিবর্জিত সংবাদ প্রচার করে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয় কখনো কখনো। অনেক সময় মিডিয়া ট্রায়ালের ফলে রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা, বিচারক ও বিচারপ্রার্থী জনগণ বিব্রত হয়, যা অনাকাক্সিক্ষত। এরকম ঘটনায় মিডিয়াবান্ধব কর্মচারীরা নিজেদের শম্বুকের মতো গুটিয়ে নেন। যাতে লাভবান হয় অন্যরা।

গণকর্মচারী এবং সাংবাদিক একে অপরের প্রতিপক্ষ মনে হলেও বাস্তবে প্রতিপক্ষ নন। আমার কাছে সম্পর্কটি সহযোগিতামূলক মনে হয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় আমরা ৩৬০০০ (ছত্রিশ হাজার) প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ করি। সেই সময় নিয়োগ বাণিজ্য, দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ, নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতি নিয়ে সংবাদপত্রে অনেক খবর ছাপা হয়। আমরা স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলাম। তাই পুরো মন্ত্রণালয়, অধিদফতর সাংবাদিকদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলাম। ফলাফল, আমরা আইন বিধি অনুসরণ করে দুর্নীতিমুক্ত নিয়োগ নিশ্চিত করতে পেরেছিলাম।

প্রায়শই রাজনীতিবিদ এবং সরকারি কর্মচারীরা নীতিনির্ধারণ বিষয়ক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া গোপন করতে চান। তাঁরা সাংবাদিকদের ক্ষমতা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন থাকেন। কিন্তু সঠিক নীতি প্রণয়ন করার জন্য সাংবাদিকদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। নীতিমালার সীমাবদ্ধতাগুলো জানার জন্য, জনগণের মতামত জানার জন্য, জনসমর্থন বাড়ানোর জন্য মিডিয়ার সহযোগিতা প্রয়োজন। আমরা চাইলেও মিডিয়াকে দূরে রাখতে পারব না। তথ্যের জন্য সাংবাদিকদের প্রয়োজন সরকারি কর্মচারীদের। আবার ইতিবাচক সংবাদ প্রকাশের জন্য কিংবা বা অন্তত নেতিবাচক সংবাদ প্রশমিত করার জন্য সরকারি কর্মচারীদের মিডিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে হবে। মিডিয়াকে এড়িয়ে চললে গুজব, মিথ্যা, অসত্য তথ্য বাজার পায়। ক্ষতি হয় সব পক্ষের। তাই অবশ্যই স্বল্প সময়ের নোটিসে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে গণকর্মচারীদের। মিডিয়া খবরের অনুসন্ধানে অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ করে। অতি গোপনীয় খবর রাজনীতিবিদ, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারী, ভিত্তি পর্যায়ের কর্মচারীদের কাছ থেকেই তারা পেয়ে যান। তাদের সূত্র আমলাতন্ত্রের গভীরে থাকতে পারে। মন্ত্রিসভার বৈঠকে কী আলোচনা হবে, কী কী আলোচনা হলো, কে কী বললে, প্রধানমন্ত্রী কাকে বকেছেন এরকম অনেক খবর মন্ত্রিসভার সদস্যের কাছ থেকে সাংবাদিকরা পেয়ে যান। এরকম অনেক খবর আমি প্রকাশিত হতে দেখেছি। দু-এক দিন হইচই হয়েছে। তারপর সব কিছু থিতিয়ে গেছে। আজকাল সেরকম খবর খুব কম দেখি বা দেখি না বলাও চলে।  কারণ জানি না। এসব পরিস্থিতি নিয়ে অনুসন্ধানী বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন হতে পারে।

হলদে সাংবাদিকতা নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়। গণকর্মচারীরা মনে করে তাঁরা হলদে সাংবাদিকতার শিকার হন। সাংবাদিকতার মান নিয়ে বিশেষ করে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের সাংবাদিকদের নিয়েও অনেক কথা।  আবার ব্যবসায়ীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনেকেই তথ্য যাচাই বাছাই করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। গণকর্মচারীদের কেউ কেউ মনে করেন সাংবাদিকরা তাদের ব্লাকমেল করার চেষ্টা করেন। গণমাধ্যমে কোনো প্রতিবাদ পাঠানো হলে তা সমান গুরুত্ব দিয়ে কখনো ছাপা হয় না। এতে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হন, সামাজিকভাবে হেয় হন, অকারণে মানহানির শিকার হন। সময় এসেছে এসব বিষয় নিয়ে গণকর্মচারী এবং সংবাদকর্মীদের মধ্যে খোলামেলা আলাপ-আলোচনার। গণকর্মচারী এবং সংবাদকর্মীর লক্ষ্য কিন্তু অভিন্ন। সুশাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, আইনের শাসন নিশ্চিত করা সুশাসন প্রতিষ্ঠা।

সর্বশেষ খবর