রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) সাবেক উপাচার্য এম আব্দুস সোবহান তার দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ দিনে ১৩৮ জনকে অবৈধভাবে নিয়োগ দিয়ে তুমুল সমালোচিত হয়েছিলেন। এই প্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের করা তদন্ত কমিটিও অভিযোগের সত্যতা পেয়ে প্রতিবেদন দেয়। এই ঘটনার এক বছরেও তার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এতে হতাশ ও ক্ষুব্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অবিলম্বে এম আব্দুস সোবহানের বিরুদ্ধে শাস্তি দাবি করেছেন।
এর আগে ২০২০ সালে সাবেক উপাচার্য এম আব্দুস সোবহানের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, আর্থিক লেনদেনসহ নানা অনিয়মের একাধিক অভিযোগ এনে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর দফতরে চিঠি পাঠায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬২ জন শিক্ষক। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, নিয়োগ পাওয়ার পরপরই ২০১৭ সালের ২১ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও রাষ্ট্রপতিকে অসত্য তথ্য দিয়ে উপাচার্য পদকে ১ দিনের জন্য শূন্য রেখে নিজের বিভাগ থেকে অবসর নেন তিনি। এছাড়াও মেয়ে ও জামাইকে নিয়োগ দিতে ২০১৭ সালের আগস্টে বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ নীতিমালায় যোগ্যতা শিথিল করেন।
এছাড়াও তিনি নিম্নস্তরের কর্মচারী নিয়োগে বয়স বাড়িয়ে শিক্ষাগত যোগ্যতাও কমিয়েছিলেন। এম আব্দুস সোবহানের দায়িত্বকালে প্রায় ৩৮ কোটি টাকার তিনটি বৃহৎ প্রকল্প অনুমোদন পায়। অভিযোগ রয়েছে, এসব প্রকল্পের খরচে অতিরিক্ত মূল্য ধরে তিনি অনুগত ও পছন্দের ব্যক্তিদের দায়িত্ব দিয়েছেন। এছাড়াও তার অনুগত ও পছন্দের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরদের স্বজনদেরও নানা পদে নিয়োগ দেয়ার অভিযোগও রয়েছে।
এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি ১৮ মাস নানা অজুহাতে দখলে রাখেন, যার ফলে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টাকার রাজস্ব ক্ষতি হয়। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে ২০২০ সালেই তদন্ত কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তদন্ত কমিটি এসব অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পায়। এরপর এম আব্দুস সোবহানসহ ঘনিষ্ঠজনদের সম্পদের গোয়েন্দা তদন্ত, তার মেয়ে-জামাতাসহ ৩৪ জন শিক্ষকের নিয়োগ বাতিল, কোষাধ্যক্ষকে অপসারণসহ একাধিক সুপারিশ করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ধরনের নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
কিন্তু গত বছর ৬ মে বিদায়কালে মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করেই ১৩৮ জনকে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দিয়ে যান এম আব্দুস সোবহান। একই দিন এই ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পরে গত বছর সেপ্টেম্বরে সুপারিশসহ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় কমিটি। এই তদন্তে বিদায়কালে এম আব্দুস সোবহানের দেয়া নিয়োগে অনিয়ম খুঁজে পাওয়া যায় বলে জানান ওই কমিটির এক সদস্য। এছাড়া ওই বছরের সেপ্টেম্বরে ১৩৮ জনের নিয়োগে স্থগিতাদেশ দেয়ার পাশাপাশি নিয়োগ বাতিল ও এম আব্দুস সোবহানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রশ্নে রুল জারি করে হাইকোর্ট।
সেসময় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমিটির এক সদস্য জানান, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার আলোকে নিয়োগের ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বিতর্কিত ১৩৮ জনের নিয়োগে এম আব্দুস সোবহানকে মূল অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তার ওপর দেশত্যাগেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা আছে।
এসব নিয়োগে বিদায়ী ভিসির সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তার জামাতা ও আইবিএ প্রভাষক এটিএম শাহেদ পারভেজ, ডেপুটি রেজিস্ট্রার ইউসুফ আলী, সহকারী রেজিস্ট্রার তারিকুল আলম ও সহকারী রেজিস্ট্রার মামুন অর রশীদকে। তাদের সকলের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
এদিকে, অনিয়ম করেও শাস্তির না পাওয়ায় হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী অর্বাক আদিত্য বলেন, নিয়োগবাণিজ্য, সিন্ডিকেটে মন মতো নিয়ম পরিবর্তন করে নিজের মেয়ে জামাইকে নিয়োগ, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগেও তার অনিয়মের অভিযোগ গণমাধ্যমে দেখেছি। এসব অভিযোগের তদন্ত হয়েছে, সত্যতাও মিলেছে। কিন্তু তিনি কেন বিচারের মুখোমুখি হলেন না তা আমরা জানি না। তাকে বিচারের মুখোমুখি না করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নোংরা রাজনীতি, অযোগ্য ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আসার স্রোত বন্ধ করা সম্ভব হবে না। এইটা জাতির জন্য, দেশের জন্য, একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দীর্ঘমেয়াদী একটা ক্ষতির কারণ।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এস এম এক্রাম উল্যাহ বলেন, অন্যায় রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে। এই জায়গা থেকে মুক্তির উপায় অন্যায়ের শাস্তি বিধান করা। সেই ক্ষেত্রে প্রফেসর আব্দুস সোবহানের বিষয়টি প্রমাণিত হবার পরও চাপা পরে যাচ্ছে এটা আমাদের শিক্ষিত সমাজের জন্য চরম ধাক্কা, হতাশা ও কষ্টের। এতে ন্যায়বিচার নষ্ট হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে যারা অন্যায় করবে বলে মনস্থির করেছে তারা উৎসাহ পাচ্ছে। এই জায়গা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হলো যত দ্রুত সম্ভব প্রফেসর সোবহান ও তার সাথে যারা জড়িত তাদের শাস্তির মুখোমুখি করা।
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন