বিয়ের আসর। তবে তা বাড়ি বা কমিউনিটি সেন্টারে নয়। হাসপাতালের সাদা শয্যায়। কনের নাকে অক্সিজেনের নল। শরীরে লাল শাড়ি। গলায় গয়না। বরের গায়ে সোনালী রঙের পায়জামা-পাঞ্জাবি। ইসলামী রীতিতে করা হয় আকদ-কাবিন। দুইজন মিলে কাটেন কেক। করেন মালাবদল। উপস্থিত সবাইকে খাওয়ানো হয় খেজুর ও মিষ্টি। মুহূর্তেই রঙিন হয়ে উঠল হাসপাতালের কেবিনের বেড। এভাবে ক্যান্সার আক্রান্ত ফাহমিদা কামালের সঙ্গে বিয়ে হয় মাহমুদুল হাসানের।
কিন্তু তা বেশিদিন দীর্ঘায়িত হয়নি। মাত্র ১২ দিনের মাথায় হার মানতে হল মরণব্যাধি ক্যান্সারের কাছে। জীবনে ভালবাসার যুদ্ধে জয়ী হলেও ক্যান্সারের কাছে হার মানতে হল ফাহমিদা কামালকে। লাল শাড়ি পরা ফাহমিদা হাসপাতাল ছেড়েছেন সাদা কাফনে।
সোমবার সকাল ৭টা ২৩ মিনিটে হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ২৬ বছর বয়সী তরুণী ফাহমিদা কামাল। চট্টগ্রাম নগরের দক্ষিণ বাকলিয়া চর চাক্তাইয়ে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
ফাহমিদা চট্টগ্রামের বেসরকারি চিটাগং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ করেছিলেন। তাদের বাড়ি নগরের দক্ষিণ বাকলিয়া চর চাক্তাই এলাকায়। আর কক্সবাজারের চকরিয়ার ছেলে মাহমুদুল হাসান নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা শেষ করেন। ফাহমিদা ছিলেন দুই বোন এক ভাইয়ের মধ্যে মেজ। তার বড় বোন থাকেন চীনে এবং ছোটভাই এখন পড়ালেখা করছেন।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, শিক্ষাজীবনেই মাহমুদুলের সঙ্গে ফাহমিদার পরিচয় হয়। পরে তাদের মধ্যে তৈরি হয় প্রেমের সম্পর্ক। ফাহমিদার স্বপ্ন ছিল প্রেমিক মাহমুদুলের সঙ্গে ঘর বাঁধার। তাদের সম্পর্কের বিষয়টি জানাজানিও হয়। পরে দুই পরিবারের সম্মতি মেলে। ২০২০ সালের শেষ দিকে বিয়ের কথাবার্তাও এগোয়। কিন্তু ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে ফাহমিদার শরীরে ধরা পড়ে রেকটাম ক্যান্সার। এরপর বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশেই চলে চিকিৎসা। টানা একবছর চিকিৎসার পর চিকিৎসকরা জানিয়ে দেন ফাহমিদার চিকিৎসা আর সম্ভব নয়।
তবে শরীরে ক্যান্সার বাসা বাধার পরও এতটুকু ফিকে হয়নি তাদের স্বপ্ন। এমন সময় মাহমুদুল হাসান ফাহমিদার ইচ্ছা ও স্বপ্নকে সম্মান জানাতে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন। ফাহমিদার পরিবার থেকে সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু আপন সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন মাহমুদুল। অবশেষে গত ৯ মার্চ উভয় পরিবার সম্মতিতে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে থাকা ফাহমিদাকে হাসপাতালের কেবিনেই বিয়ে করেন মাহমুদুল। বধূবেশে লাল শাড়িতে ফাহমিদা ও পাঞ্জাবি পরা বর মাহমুদুলের বিয়ের সেই ছবি ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক মাধ্যমে।
গত ১৪ মার্চ ফাহমিদা অনেকটা মনের জোরেই হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরে যান। কিন্তু পরদিনই আবার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। তাকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। সেখানে কেবিনে রেখে তার চিকিৎসা চলছিল। গত রবিবার অবস্থা গুরুতর হলে নেওয়া হয় আইসিইতে। সোমবার সকাল ৭টায় তিনি সেখানেই মারা যান।
ফাহমিদার চাচা ইউসুফ সালাম বলেন, শারিরীক অবস্থার অবনতি হওয়ায় ফাহমিদাকে রবিবার হাসপাতালের কেবিন থেকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার সকাল ৭টা ২৩ মিনিটে মারা যান। আছরের নামাজের পর পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
ফাহমিদার নানা সাইফুদ্দিন সাকী বলেন, ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুপথযাত্রী কাউকে বিয়ে করার ঘটনা বিরল। এতে বর-কনে উভয়ের ভালোবাসার দিকটিই উঠে এসেছে। কিন্তু বিয়ের ১২ দিন পর ফাহমিদার মৃত্যু হয়। সবাইকে শোকের সাগরে ভাসাল সে।
বিডি প্রতিদিন/আরাফাত/এমআই