চট্টগ্রাম কলেজটি শিবির মুক্ত করে ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে আনার পর আভ্যন্তরীণ কোন্দল ও দখল- বেদখলের গত আট মাসে নিজেরাই কমপক্ষে ২০ বারেরও বেশি ছোট-বড় সংঘর্ষে জড়িয়েছে ছাত্রলীগ। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৩০ জন। এতে শিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থী অভিভাবকদের মধ্যেই রীতিমতো রয়েছে আতংক-উদ্বেগও। এসব প্রত্যেকটি ঘটনার পর চট্টগ্রাম কলেজ কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করলেও প্রতিবেদনে অপরাধী চিহ্নিত না হওয়ায় জড়িতরা রক্ষা পেয়ে যাচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। কলেজ কর্তৃপক্ষ শৃঙ্খলা কমিটি, ভিজিলেন্স কমিটি, লিয়াঁজো কমিটি গঠন করে বারবার চেষ্টা করা হয়েছে। পুলিশ প্রশাসনকেও সবকিছু অবহিত করেছেন। তবে চকবাজার থানার ওসিসহ প্রশাসনের রহস্যজনক ভূমিকার কারণে এসব ঘটনা থামছে না বলেও জানান সংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, জামায়াত-শিবিরের দখলে থাকা চট্টগ্রাম কলেজকে উদ্ধারে অধক্ষ্যের কার্যালয়ের সামনে রক্ত ঢেলে প্রতিবাদ, আট দফা দাবি আদায়, গণস্বাক্ষর কর্মসূচি মিলেমিশেই চালায় ছাত্রলীগ। এতে সফলও হয় ছাত্রলীগ। ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হয় শিবির। ক্যাম্পাসে বসে পুলিশ ফাঁড়ি। জামায়াত-শিবিরের মিনি ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রাম কলেজে উড়তে থাকে প্রগতির পতাকা। হঠাৎ চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষার পরিবেশ অস্থির হয়ে উঠে। ছাত্রলীগ জড়িয়ে পড়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। তিন গ্রুপে বিভক্ত ছাত্রলীগের শুরু হয় রক্তারক্তি।
চকবাজার থানার ওসি মো. আজিজ আহমদ বলেন, ছাত্রলীগের গ্রুপগুলো যেভাবে একে অপরের বিরুদ্ধে হামলা করছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে এখানেই আমাদের দিনভর কাটাতে হয়। এ পর্যন্ত ছাত্রলীগের মারামারির বিভিন্ন ঘটনায় ছয়টি মামলা হয়েছে। তবে এরা নেতাদের আশ্রয় প্রশ্রয় পাওয়ায় বেপরোয়া হয়ে পড়ছে। তিনি বলেন, রবিবারের ঘটনায় তদন্ত চলছে। জড়িতদেও চিহ্নিত করে দ্রুত গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর জেসমিন আক্তার সাংবাদিকদের বলেন, যতবার ঘটনা হয়েছে ততবার তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে কোন নাম আসেনি। যে কারণে কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়নি। তবে নিয়মিত কলেজে উপস্থিত হওয়ার জন্য সবাইকে নির্দেশ দিয়েছি। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, পরিস্থিতি ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে যাচ্ছে।
নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রণি ক্ষোভের সাথে বলেন, রবিবারের সংঘর্ষে বহিরাগত ও অছাত্ররাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে। বহিরাগতরা বাইরে ও আইডি কার্ডধারী ছাত্ররা ভিতরেই অবস্থান করছিল। এসব সমস্যার সমাধান করার মত অভিভাবক কেউ চট্টগ্রামে নেই। এ ভাবে চলতে থাকুক। লাশ পড়ুক। ছাত্রলীগ বিতারিত হউক। শিবির পুনঃপ্রতিষ্টা হলে তারপর হুঁশ হবে হয়তো! তবে প্রশাসনের কৌশলী ভূমিকার কারণে প্রতিনিয়ত এসব ঘটনা ঘটছে বলেও দাবি করেন রণি।
যুবলীগ নেতা নুরুল মোস্তফা টিনু বলেন, শিক্ষ প্রতিষ্ঠানে কোন ধরনের সংঘর্ষ মেনে নেয়া যায় না। এতে যারা এসব ঘটনা সাথে জড়িত তাদেও চিহ্নিত কওে দ্রুত গ্রেপ্তার না করলে কঠোর আন্দোলন ও কর্মসূচী দেয়া হবে বলে তিনি জানান।
সর্বশেষ গত রবিবার ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনাতেও তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিন কার্যদিবসের মধ্যে এ কমিটিতে প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। তদন্ত কমিটির সদস্যরা হলেন- প্রাণীবিদ্যা বিভাগের প্রধান প্রফেসর প্রনব কুমার চক্রবর্ত্তী, দর্শন বিভাগের প্রধান প্রফেসর ফরিদ আহমদ চৌধুরী ও ইসলামি ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আনোয়ার মালেক মজুমদার।
প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কলেজ ক্যাম্পাস দখলে নেয়ার পর ঈদে মিলাদুন্নবী অনুষ্ঠান করতে গিয়েই প্রথম বারের মতো উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে ছাত্রলীগের বিবাদমান গ্রুপগুলোর মধ্যে। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি প্যারেড কর্নার ও কলেজ ক্যান্টিন গেটে ককটেল বিস্ফোরণ, গত ২৩ এপ্রিল মহসীন কলেজ ও চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উপর হামলা, গত ২৮ এপ্রিল ছাত্রলীগের দুটি পক্ষ মারামারি, গত ১১ মে জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামীর গায়েবানা জানাযা নিয়ে ছাত্রলীগের সাথে শিবিরের সংঘর্ষেও নেতৃত্ব নিয়ে ছাত্রলীগের বিবাদমান গ্রুপগুলোর মধ্যে উত্তেজনা, গত ১৮ জুন নবাগতদের স্বাগত জানানো নিয়ে রনি অনুসারী ও কায়সার হামিদ অনুসারী ছাত্রলীগের দুটি পক্ষের সংঘর্ষ, গত ২০ জুন পুনরায় ছাত্রলীগের বিবাদমান পক্ষগুলো কলেজে অবস্থান নিতে চাইলে পুলিশ দুই পক্ষকেই পিটিয়ে বের করে, ২৩ জুলাই নগর ছাত্রলীগের দুই সহ-সভাপতিকে সাময়িক বহিষ্কারের প্রতিবাদে মিছিলে সংর্ঘষ, গত ২৯ জুলাই দলীয় সমাবেশ শেষে বাসায় ফেরার পথে চকবাজার তেলপট্টি মোড়ে এক ছাত্রলীগ নেতাকে মারধর, গত ৩০ জুলাই চকবাজারে জঙ্গি ও সন্ত্রাস বিরোধী সমাবেশ শেষে মেয়র নাছির ও মহিউদ্দিন চৌধুরী অনুসারী ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হাতাহাতি, গত ৩১ জুলাই ছাত্রলীগের নেতারা মানববন্ধন কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে টিনু ও রণির সর্মথকদের মধ্যে সংর্ঘষসহ ২০টার মতো ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ ঘটনার পর থেকে গত তিনদিন ধরে কলেজ পরিস্থিতি উত্তপ্ত রয়েছে।
বিডি-প্রতিদিন/ ০৩ আগস্ট, ২০১৬/ আফরোজ