দিনের পর দিন ট্রেন যাত্রায় চরম দুর্ভোগ ও ভোগান্তিতে আছেন চট্টগ্রাম-সিলেট ও সিলেট-ঢাকা রুটের ট্রেন যাত্রীরা। অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, পুরাতন কোচ, পুরাতন ইঞ্জিন, ঝুঁকিপূর্ণ রেললাইন, আসন সংকট, শিডিউল বিপর্যয়, বিদ্যুৎ সংকট, সিলেট স্টেশনে টিকেট নিয়ে বাণিজ্য, চোরাকারবারি, জনবলের অভাব, বিভিন্ন ট্রেন চলাচলের ক্ষেত্রেও বৈষম্যসহ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। এসব কারণে সিলেট-ঢাকা রুট ছাড়াও চট্টগ্রাম-সিলেটের ট্রেন যাত্রার অন্যতম মাধ্যম পাহাড়িকা ও উদয়ন এক্সপ্রেসের সেবার কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। দীর্ঘদিনের পুরনো ইঞ্জিনের কারণে প্রায়ই বিকল হয়ে যায়। তাছাড়া পাহাড়িকা ও উদয়ন ট্রেনের খাবার ব্যবস্থাপনায়ও রয়েছে চরম অনিয়ম এবং নিন্মমানের খাবারও। সবমিলে এ রুটের যাত্রীদের অভিযোগের অন্ত নেই। তবে বৈষ্যম নেই জানিয়ে নানাবিধ সংকট উত্তরণে নতুন কোচ সংযোজনসহ আরো অনেক কাজ করছেন বলে জানান রেল প্রশাসন।
পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী (সিই) মো. আরিফুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, চট্টগ্রাম-আখাউড়া ডাবল লাইনে উন্নত হয়েছে। লাকসাম থেকে শুরু করে বাকিগুলো কাজ চলছে। সিলেটের কিছু অংশ বর্ষার সময় নানাবিধ সমস্যা হয়। তবে এটা ছোটখাটো বিষয় এবং এগুলো সমাধানের জন্য প্রতিনিয়ত কাজ চলছে এবং সার্বক্ষণিক মনিটরিং এ রয়েছি আমরা। পূর্বাঞ্চলের প্রধান যান্ত্রীক প্রকৌশলী (সিএমই) মো. মনজুর উল আলম চৌধুরীকে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি।
সিলেট সদরের খাদিমপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান ও ব্যবসায়ী এড. মোঃ আফছর আহমদ বলেন, দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে কেউ সিলেটে আসার পর চট্টগ্রাম যেতে চান। যারা দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলো ঘুরতে আসেন তারা মূলত পূর্বাঞ্চলে এলে এই দুই জেলা বা বিভাগের পর্যটন এলাকাগুলো একই সাথে ঘুরে দেখতে চান। সেক্ষেত্রে সিলেট থেকে ট্রেনে চট্টগ্রাম যাওয়ার আগ্রহ থাকে। কিন্তু মানসম্পন্ন ট্রেন নেই বলে হয়তো মানুষ সড়কপথে যাতায়াত করে। এ রুটে ট্রেন আরো বাড়ানো উচিত। একই সাথে ট্রেনগুলোতে সেবার মানও উন্নত করতে হবে বলে জানান তিনি।
রশীদ মামুনসহ একাধিক ভুক্তভোগী ট্রেন যাত্রী বলেন, দেশের গুরুত্বপূর্ণ পর্যটক নগরী দু’টির মধ্যে ট্রেন যোগাযোগ থাকলেও তা মানসম্মত নয়। তারপরেও যাত্রী সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ রুটে মাত্র দু’টি আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করে। রুটভেদে গুরুত্বপূর্ণ হলেও ট্রেন দু’টি বৈষম্যের শিকার। যাত্রীর তুলনায় কোচ কম। নেই এসি কোচ। উদয়নে একটা এসি কোচ থাকলেও মাঝে মধ্যে তা যান্ত্রিক ক্রুটির কারণে সেটিও কাটা পড়ে। এ ছাড়া কোচগুলো অপরিচ্ছন্ন, টয়লেটে পানি থাকে না, চলতে পথে হকারদের উৎপাতসহ আরও কতো ঝামেলা পোহাতে হয় যাত্রীদের। দ্রুত সমাধান না হলে আরো বেশী কষ্টের মধ্যে থাকবে যাত্রীরা।
শফিউল আজম নামের চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ী বলেন, আমরা যারা নিয়মিত ভ্রমণ করি তারা প্রথমে ট্রেনকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকি। কারণ ট্রেন অপেক্ষাকৃত নিরাপদ এবং ভ্রমণ আরামদায়ক। কিন্তু ট্রেনের অবস্থার কথা শুনলে পিছপা হতে হয়। তখন বাস ছাড়া আর উপায় থাকে না। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম-সিলেট রুটের দুটি ট্রেনের বেশিরভাগ চেয়ারের হাতল ভাঙা। আবার অনেক চেয়ারের হাতলই নেই। আর এসব ভাঙা হাতলে ছাড়পোকা ধরে আছে। টয়লেট অপরিচ্ছন্ন। টয়লেটে পানির টেপ থাকলেও পানি থাকে না। এসবের পরেও এ রুটে যাত্রীদের আরো বগির চাহিদা রয়েছে। তিনি সিলেট রুটকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দাবি করে বলেন, রেল কর্তৃপক্ষের উচিত এ রুটকে গুরুত্ব দেয়া।
রেলওয়ে ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম-সিলেট রুটে আন্তঃনগর ট্রেন আছে মাত্র দু’টি। পাহাড়িকা ও উদয়ন এক্সপ্রেস। পৃথক সেট কোচ নেই বলে এই দু’টি ট্রেনের অবস্থা ঘুরে ফিরে একই অবস্থা। এ দুটি ট্রেন চালু হওয়ার পর থেকে এই দু’টি ট্রেন বৈষম্যের শিকার। যাত্রীর তুলনায় কোচ কম। এ কারণে টিকেট নিয়ে চলে কাড়াকাড়ি। গুরুত্বপূর্ণ এই ট্রেন দু’টির কোচ খুলে অন্য কম গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনে লাগানোর নজিরও আছে। যে কোচগুলো দিয়ে ট্রেন দু’টি চলছে সেগুলো নিম্নমানের। চট্টগ্রাম ও সিলেট পর্যটকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। দেশ-বিদেশ থেকে সারা বছরই এই দুই জেলায় হাজার হাজার মানুষ বেড়াতে আসে। শীতের মৌসুমে পর্যটকের সংখ্যা অনেক বাড়ে। এ অবস্থায় চট্টগ্রাম-সিলেট রুটে ট্রেনের চাহিদাও বেশী। কিন্তু ট্রেনের বেহাল দশা এবং চাহিদা মতো ট্রেনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বা প্রথম শ্রেণীর কোচ না থাকায় অনেক যাত্রীই হতাশ হয়ে ফিরে যান।
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, বিভাগীয় শহর সিলেটের সঙ্গে ঢাকা ও চট্টগ্রামের রেল যোগাযোগ শুরু হয় ব্রিটিশ আমলে। যাত্রীদের নিরাপদ ও আরামদায়ক ভ্রমণের কথা চিন্তা করে ১৯৮৭ সালে আন্তঃনগর ট্রেন চালু করা হয়। সিলেট-চট্টগ্রাম রুটে যাত্রীবাহী ট্রেন চলছে পাহাড়িকা, উদয়ন ও জালালাবাদ মেইল। সিলেট-আখাউড়া রুটে যাত্রীবাহী ট্রেন চলছে দুটি ডেমো ও কুশিয়ারা। ঢাকা-সিলেট রুটে প্রতিদিন পাঁচটি আন্তঃনগর ট্রেন, কালনী, জয়ন্তিকা, পারাবত, উপবন ও সুরমা মেইল চলাচল করে। পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম-সিলেট-ঢাকা রুটে চলাচলকারী ট্রেনের ইঞ্জিনগুলো প্রায় অর্ধশতাব্দীর পুরনো। সিলেট থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামে চলাচলকারী ট্রেনগুলোর মধ্যে উদয়নে ২০টির স্থলে ১৪টি, পাহাড়িকায় ২০টির স্থলে ১৩টি, উপবন, জয়ন্তিকা ও পারাবতে ২০টির স্থলে ১২টি কোচ চলাচল করছে। এদিকে সিলেট-আখাউড়া রুটে ৬টি কোচ নিয়ে বেসরকারি নিয়ন্ত্রণে চলছে কুশিয়ারা এক্সপ্রেস।
বিডি-প্রতিদিন/ সালাহ উদ্দীন