ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কারাগারে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় ফেঁসে যাচ্ছেন এ কারাগারের সাবেক জেল সুপার নুরুন নবী ভূঁইয়া, জেলার এজি মাহমুদ ও কারা হাসপাতালের চিকিৎসক হুমায়ুন কবির। ইতিমধ্যে এ অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে কারাগারের সর্ব প্রধান কারারক্ষী আবদুল ওয়াহেদকে সাময়িকভাবে বরখান্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া জেল সুপার নুরুন নবী ভূঁইয়াকে মুন্সীগঞ্জে, জেলার এজি মাহমুদ, ডেপুটি জেলারসহ ২৬ কারারক্ষীকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। কারা হাসপাতালের চিকিৎসক হুমায়ুন কবিরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কারাগারের অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দাখিল করতে কারা অনুবিভাগের যুগ্ম-সচিব সৈয়দ বেলাল হোসেনের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি করা হয়। তিনি সুরক্ষা সেবা বিভাগের উপসচিব মো. মনিরুজ্জামানের সমন্বয়ে তদন্ত সম্পন্ন করে প্রতিবেদন দাখিল করেন এবং কারা অধিদফতরের কাছে জেল সুপার, জেলার ও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগের লিখিত বিবরণ চাওয়া হলে গতকাল সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত কারা অধিদফতর শুধু চিকিৎসকের লিখিত বিবরণ হাতে পায় কিন্তু জেল সুপার ও জেলারের বক্তব্য মন্ত্রণালয়ে এখনো পৌঁছায়নি। তাদের লিখিত বিবরণ পেলেই বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ওই কমিটি সম্প্রতি ৫১ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। তদন্তে বন্দী নারীদের সঙ্গে কারাগারে থাকা শিশুদের মাঝে নিম্নমানের দুধ বিতরণ, বন্দী বেচাকেনা, সাক্ষাৎ বাণিজ্য, সিট বাণিজ্য, খাবার বাণিজ্য, চিকিৎসা বাণিজ্য এবং জামিন বাণিজ্যের প্রমাণ মেলে। এ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করে কারা কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং কারারক্ষীদের বিরুদ্ধে ভাগ-বাটোয়ারার অভিযোগের সত্যতা পায় তদন্ত কমিটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কারাগারে বন্দীদের বিভিন্ন ওয়ার্ডে বিক্রি করা হয়। ওয়ার্ড নিয়ন্ত্রণ করে পুরাতন বন্দী ও কারারক্ষীরা। ওয়ার্ড থেকে হাসপাতালে চিকিৎসার নামে বিক্রি হয়। চিকিৎসার জন্য মাসে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা দিতে হয়। অন্য ওয়ার্ডে থাকতে হলে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা দিতে হয়। কারা কর্মকর্তাদের টাকা দিয়ে ওয়ার্ডের নিয়ন্ত্রণ নেয় পুরনো বন্দীরা।
প্রতিবেদনে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, কারাগারের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে দেখা যায়, কারাগারের হাসপাতালে সাধারণ বন্দীর ছড়াছড়ি। যত্রতত্র রশি টাঙিয়ে কাপড় শুকাতে নেড়ে দেওয়া হয়েছে। মাসিক ১০-২০ হাজার টাকায় আর্থিকভাবে সচ্ছল/প্রভাবশালী বন্দীরা হাসপাতালটিকে নিজস্ব বাসাবাড়িতে পরিণত করেছে। পরিদর্শনের সময় ১২টি বেডের বন্দী পালিয়ে যায়। নয়জন বন্দীকে হাসপাতালে পাওয়া যায়। কারাগারে দুটি ক্যান্টিন রয়েছে। একটি কারাগারের ভিতরে, অন্যটি বাইরে। বাইরের ক্যান্টিনে মূল্য তালিকা নেই। ভিতরের ক্যান্টিনে খাবারের মূল্য কয়েকগুণ বেশি নেওয়া হতো। ক্রয়কৃত মালামালের বিপরীতে মূল্য পিসি (প্রিজনার ক্যাশ) কার্ড থেকে কর্তন করা হয়। সর্ব প্রধান কারারক্ষী আবদুল ওয়াহেদ কারাগারে বন্দী নারীদের সঙ্গে থাকা শিশুদের মাঝে নিম্নমানের দুধ সরবরাহের ঘটনা স্বীকার করে বলেন, এসব নিম্নমানের দুধ সরবরাহের সঙ্গে তিনি, প্রধান কারারক্ষী, ডেপুটি জেলার, জেলার এবং জেল সুপার জড়িত। প্রতিবেদনে বলা হয়, অফিস কলের মাধ্যমে সাক্ষাতের সময় অফিসে অবস্থানের জন্য আত্মীয়-স্বজনকে বন্দীপ্রতি ৫০০ টাকা দিতে হয়। কারা অভ্যন্তরের জানালা দিয়ে কথা বলার জন্য বন্দীকে ১০০ টাকা দিতে হয়। অফিস কল এবং সাক্ষাৎকালে টাকা আদায়ের সঙ্গে সর্ব প্রধান কারারক্ষী, প্রধান কারারক্ষী জড়িত। পরবর্তীকালে এ টাকা ডেপুটি জেলার, জেলার এবং জেল সুপারের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হয়। বন্দীরা আদালত থেকে জামিন লাভ করলেও অর্থ প্রদান না করলে জামিননামা আটকে রেখে মুক্তি বিলম্বিত করা হয়। এর জন্য সর্বনিম্ন এক হাজার টাকা দিতে হয়।