মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কেউ হারিয়েছেন ভাই, কেউ বাবা, আবার কেউ সন্তান। পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা তুলে নিয়ে গিয়েছিল তাদের। এরপর আর কোনো সন্ধান মেলেনি। দেশ স্বাধীনের পর ৫২ বছর ধরে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের সমাধি খুঁজেছেন তারা। কিন্তু মেলেনি কোনো সন্ধান। শুধু জানতেন একটি পতাকা ও স্বাধীন ভূখন্ডের জন্য তাদের রক্ত মিশে আছে এদেশের মাটিতে। মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হওয়া এমন ৬৬ জনের গণকবর খুঁজে শনাক্ত করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ আবদুস সালাম বীরপ্রতীক ও শহীদ বুদ্ধিজীবী সন্তান, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী চিকিৎসক বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক জিয়াউদ্দিন আহমদ চৌধুরী। দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর সিলেটের সালুটিকরের বধ্যভূমিতে শহীদ ৬৬ জনের পরিচয় শনাক্ত করে তারা সেখানে নির্মাণ করেছেন স্মৃতিস্তম্ভ। পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা বধ্যভূমিতে স্থাপন করা হয়েছে ৬৬ জন শহীদের নামখচিত স্মৃতিফলক। নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও পাকহানাদার বাহিনীর বর্বরতার কথা তুলে ধরতে বধ্যভূমিতে তৈরি করা হয়েছে ‘শহীদ স্মৃতি উদ্যান’। গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে এই স্মৃতিফলক ও উদ্যান উদ্বোধন করেন শহীদ সিরাজুল আবদালের স্ত্রী সৈয়দা সকিনা আবদাল। অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী ও মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের সাবেক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) হেলাল মোর্শেদ খানসহ শহীদ স্বজনরা। উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, এই বধ্যভূমিতে আরও অনেক শহীদ শায়িত আছেন। তাদের নাম-পরিচয় শনাক্তেরও চেষ্টা চলছে। গতকাল বধ্যভূমিতে এসে বাবা গকুলানন্দ চক্রবর্তীর নামখচিত স্মৃতিফলকে হাত বুলাতে বুলাতে অশ্রুবিসর্জন করেন রীনা চক্রবর্তী। আবেগাপ্লুত কণ্ঠে রীনা বলেন, ‘আমার বাবার মৃত্যুর কয়েক মাস পর আমার জন্ম হয়। জন্মের পর বাবাকে চোখে দেখিনি। শুধু জানতাম বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। কিন্তু বাবার সমাধি কোথায় তা জানতাম না। আজ বাবার স্মৃতিফলকে হাত বুলাতে গিয়ে মনে হচ্ছিল আমি যেন আমার বাবাকে স্পর্শ করছি।’
১৯৭১ সালে সিলেট শহরের পার্শ্ববর্তী সালুটিকর এলাকার সিলেট ক্যাডেট কলেজে ক্যাম্প গড়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। মুক্তিযোদ্ধাসহ বাঙালিদের ধরে এনে হত্যা ও নির্যাতন করা হতো এখানে। হত্যার পর ক্যাডেট কলেজের পেছনেই গণকবর দেওয়া হয় তাদের। এখানে অন্তত ২০০ বাঙালিকে গণকবর দেওয়া হয় বলে ধারণা করা হয়। সালুটিকরের এই গণকবরটি সবার কাছেই বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত থাকলেও এতদিন এটি পড়েছিল পরিত্যক্ত অবস্থায়। ঘন জঙ্গলে পূর্ণ ছিল এই টিলাভূমি। ছিল না কোনো স্মৃতিচিহ্নও। সেনানিবাসের সংরক্ষিত এলাকায় এই বধ্যভূমির অবস্থান হওয়ায় সাধারণের প্রবেশাধিকারও ছিল না। অবশেষে স্বাধীনতার ৫২ বছর পর দুই মুক্তিযোদ্ধার উদ্যোগে এই বধ্যভূমি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তাদের উদ্যোগেই এখানে নির্মাণ করা হয়েছে নান্দনিক শহীদ স্মৃতি উদ্যান। কথা হয় ‘শহীদ স্মৃতি উদ্যান’-এ আসা শাহরীন রহমান লুবনার সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বাবা শহীদ কর্নেল ডা. আবু ফজল জিয়াউর রহমান ছিলেন সিলেট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ। তিনি জানতেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তার বাবা শহীদ হয়েছেন। কিন্তু কোথায় কীভাবে তার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে তার কোনো তথ্যই জানতেন না। শাহরীন বলেন, ‘৫২ বছর ধরে বাবার স্মৃতিচিহ্ন খুঁজছি। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি। কিন্তু কোথাও পাইনি। অবশেষে আজকে বাবার স্মৃতি খুঁজে পেলাম।’
শহীদ স্মৃতি উদ্যান ঘুরে দেখা যায়, বিশাল চত্বরে নির্মাণ করা হয়েছে দুটি স্মৃতিস্তম্ভ। একটি স্তম্ভে রয়েছে এখানে শায়িত সব শহীদের নাম। এ ছাড়া সব শহীদের নামখচিত আলাদা স্মৃতিফলকও রাখা হয়েছে। ফুল আর গাছে গাছে আচ্ছাদিত পুরো চত্বরের বিভিন্ন স্থানে এই উদ্যান নির্মাণের পটভূমি, এখানে শায়িত সব শহীদের জীবনী লেখা রয়েছে। এই স্মৃতি উদ্যানে পাঠাগার, জাদুঘর, কফিশপ এবং আলাদা বসার জায়গা নির্মাণ করা হবে বলে জানান উদ্যোক্তারা।উদ্যোক্তাদের অন্যতম বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ডা. জিয়াউদ্দিন আহমদ। তার বাবা শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. শামসুদ্দিন আহমদকে সিলেট মেডিকেলে কর্মরত অবস্থায় হত্যা করে পাকিস্তানিরা। এ উদ্যোগ প্রসঙ্গে ডা. জিয়াউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমরা কেবল মুখে বলি ৩০ লাখ শহীদ। কিন্তু তাদের পূর্ণাঙ্গ কোনো তালিকা নেই। কাকে কোথায় হত্যা করা হয়েছে, কোথায় কবর দেওয়া হয়েছে কেউ জানে না। আমরা এসব খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। সে লক্ষ্যে সালুটিকর বধ্যভূমিকে উদ্যান করার উদ্যোগ নেই।’ তিনি বলেন, ‘এটা কেবল কবরস্থান নয়, আমাদের ইতিহাসেরও অংশ। তাই এটিকে সেভাবেই নির্মাণের চেষ্টা করেছি। এখানে এসে মানুষজন কেবল কষ্ট পাবে না, জানতে পারবে এবং আনন্দ পাবে।’