মাতারবাড়ী-মহেশখালীকে ঘিরে সিঙ্গাপুরের আদলে একটি আধুনিক বন্দরনগরী গড়ে তুলতে চান প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শিল্পের চাহিদা পূরণে সেখানে তৈরি করা হবে অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। থাকবে ছয় লেনের রাস্তা। বন্দরনগরীটি হবে এ অঞ্চলের জন্য অন্যতম উৎপাদন, সরবরাহ ও জ্বালানি হাব (কেন্দ্র)। এ বন্দরের সুবিধা ভোগ করতে পারবে আশপাশের দেশগুলোও। এতে বাংলাদেশও আর্থিকভাবে লাভবান হবে। তবে অবকাঠামো ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নসহ পুরো প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ (প্রায় ১৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) বিনিয়োগ। এবারের জাপান সফরে সেই বিনিয়োগ অনুসন্ধান করবেন অধ্যাপক ইউনূস।
গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি জানান, গত রাত ২টায় জাপানের উদ্দেশে বাংলাদেশ ত্যাগ করার কথা প্রধান উপদেষ্টার। ফিরবেন ৩১ মে। এ সফরে নিক্কেই সম্মেলনে যোগদান এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের কথা রয়েছে প্রধান উপদেষ্টার। এ ছাড়া জাপানের জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদ ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। বিনিয়োগ নিয়ে জাইকা ও জেট্রোর প্রধানদের সঙ্গেও বৈঠক করবেন। এসব বৈঠক ও সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোর জন্য তহবিল নিশ্চিতের চেষ্টা করবেন তিনি। শফিকুল আলম বলেন, প্রধান উপদেষ্টা মহেশখালী-মাতারবাড়ী সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন উদ্যোগ (এমআইডিআই)-এর ওপর খুব গুরুত্ব দিচ্ছেন। তার লক্ষ্য মাতারবাড়ী-মহেশখালী ঘিরে একটা নতুন সিঙ্গাপুর প্রতিষ্ঠা।
সেখানে একটা পরিকল্পিত শহর হবে, অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্র হবে, লজিস্টিক হাব (কেন্দ্র) থাকবে, উৎপাদন হাব হবে, এনার্জি হাব হবে। ছয় লেনের হাইওয়ে হবে। ছয়টা পোর্ট টার্মিনাল হবে। এগুলোতে বিশ্বের বড় বড় কন্টেইনার জাহাজ ভিড়তে পারবে। এ সুবিধা আশপাশের দেশগুলোও নিতে পারবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে ১১-১২ মিটারের বেশি ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারে না। মাতারবাড়ীতে ২০ মিটার ড্রাফটের জাহাজও ভিড়তে পারবে। এখানে অনেক প্ল্যান। পুরো প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে ২০৫০ সাল পর্যন্ত বিনিয়োগ লাগবে অন্তত ১৪০ বিলিয়ন ডলার। এগুলো প্রত্যেকটির জন্য জাপান সফরে বিনিয়োগ খুঁজবেন ড. ইউনূস। মাতারবাড়ীর উন্নয়ন হলে কক্সবাজারেরও দ্রুত উন্নয়ন হবে। মাতারবাড়ীর বিনিয়োগকারীরা সরাসরি কক্সবাজার বিমানবন্দরে নামবেন। তাদের চট্টগ্রাম বা ঢাকায় আসতে হবে না।
জাপানের কাছ থেকে এবার এক বিলিয়ন ডলার সহযোগিতা আশা করা হচ্ছে জানিয়ে প্রেস সচিব বলেন, এর মধ্যে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলারের মতো হবে বাজেট সহযোগিতা, ২৫০ মিলিয়ন ডলার রেলের জন্য, বাকিটা অন্যান্য প্রকল্পের জন্য। এ ছাড়া অধ্যাপক ইউনূস একটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাওয়ার্ড পাবেন বলে জানান তিনি।
মাতারবাড়ীতে প্রাথমিক বিনিয়োগ চাহিদার ধারণা দিয়ে শফিকুল আলম বলেন, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) জানিয়েছে, মাতারবাড়ী ও মহেশখালীতে একটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও লজিস্টিক হাব করতে প্রাথমিকভাবে ১৮ বিলিয়ন ডলার লাগবে। কক্সবাজারের উন্নয়নে আড়াই বিলিয়ন ডলার ও একটা ইন্টিগ্রেটেড কানেক্টিভিটি ইনফ্রাস্ট্রাকচার করতে ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার লাগবে। এ পুরো জায়গায় সব মিলে প্রায় ২৯ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে। প্রাথমিকভাবে সবচেয়ে দরকারি প্রকল্পগুলো নিয়ে জাপান সফরে কথা হবে।
শফিকুল আলম বলেন, সফরে দুটা গুরুত্বপূর্ণ সেমিনারে অংশ নেবেন প্রধান উপদেষ্টা। জাপানে কীভাবে বাংলাদেশ থেকে দক্ষ মানবসম্পদ পাঠানো যায় সে ব্যাপারে একটা সেমিনারে আলোচনা করবেন তিনি। প্রধান উপদেষ্টার১ লক্ষ্য ১ লাখ বাংলাদেশিকে জাপানে পাঠানো। এ ছাড়া আড়াইহাজারে জাপানিদের জন্য একটা ইকোনমিক জোন করা হয়েছে। সেখানে যেন আরও জাপানি বিনিয়োগকারী আসে, সে ব্যাপারে আরেকটি সেমিনারে কথা বলবেন প্রধান উপদেষ্টা। আশা করছি, সেই সেমিনারে ৩ শতাধিক জাপানি বিনিয়োগকারী থাকবে।
সংবাদ সম্মেলনে জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের সহযোগিতার বিষয়ে উপপ্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেন, এখন পর্যন্ত জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও আহতদের সহযোগিতায় সরকারের ২৮৫ কোটি ১৮ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে এখন পর্যন্ত ১৫ হাজার ৩৯৩ জন চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করেছেন। যাদের মধ্যে ৩৩৮ জন এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ৫১ জন জুলাইযোদ্ধাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও রাশিয়া পাঠানো হয়েছে। আরও ২৮ জনকে বিদেশ পাঠানোর কার্যক্রম চলছে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, চীন, মালয়েশিয়া ও নেপাল থেকে ২৬ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এসে বিনামূল্যে চিকিৎসা দিয়েছেন। তাদের শুধু যাতায়াত খরচ দেওয়া হয়েছে। ৮৩৪ শহীদ পরিবারের মধ্যে ৬৩০টিকে ১০ লাখ টাকা করে সঞ্চয়পত্রের জন্য চেক দেওয়া হয়েছে। এ ক্যাটাগরির আহত ৪৯৩ জনকে ২ লাখ করে, বি ক্যাটাগরির আহত ৯০৮ জনকে ১ লাখ করে ও সি ক্যাটাগরির আহত ১০ হাজার ৬৪২ জনকে ১ লাখ করে টাকা দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও জানান, আগামী ১ জুন বাংলাদেশ ও চীন সরকারের যৌথ উদ্যোগে দিনব্যাপী চায়না-বাংলাদেশ কনফারেন্স অন ইনভেস্টমেন্ট শীর্ষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এতে প্রায় ১০০টি চীনা প্রতিষ্ঠান ও ২৫০ জন বিনিয়োগকারী অংশগ্রহণ করবেন। থাকবেন চীনের চারটি চেম্বার অব কমার্সের শীর্ষ প্রতিনিধিরা।