রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে গতকাল অনুষ্ঠিত গোলটেবিল আলোচনায় বলা হয়েছে, তামাক বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের পথে বড় বাধা। অসংক্রামক রোগের মৃত্যু কমানো, সুস্থ প্রজন্ম গড়া এসডিজির (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) লক্ষ্য অর্জনে তামাক প্রধান প্রতিবন্ধকতা। আলোচকরা তামাকের ছোবল থেকে তরুণ প্রজন্মকে বাঁচাতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। ‘তামাকমুক্ত প্রজন্ম : আইন শক্তিশালীকরণে নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক এ গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নেন অর্থনীতিবিদ, চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও গণমাধ্যমকর্মীরা। অনুষ্ঠানের আয়োজক প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) এবং অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া অ্যালায়েন্স (আত্মা)। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনা করেন প্রজ্ঞার তামাক নিয়ন্ত্রণবিষয়ক প্রকল্প প্রধান হাসান শাহরিয়ার। সঞ্চালক ছিলেন আত্মার কো-কনভেনর নাদিরা কিরণ। প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। বক্তব্য দেন বাংলাদেশ জনস্বাস্থ্য সমিতির সভাপতি ডা. আবু জামিল ফয়সাল, বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) গবেষণা পরিচালক ড. মাহফুজ কবীর, বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক আবু তাহের, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. অনুপম হোসেন, আত্মার কনভেনর মর্তুজা হায়দার লিটন, প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এ বি এম জুবায়ের।
আলোচকরা বলেন, শুধু স্বাস্থ্য নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণও তামাক। তরুণদের নতুন ধূমপায়ীর ঝুঁকি কমাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশে ভিজ্যুয়াল ডিসপ্লে বন্ধ করা, নেতিবাচক প্রণোদনা নিয়ন্ত্রণ এবং আইন প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি।
প্রধান অতিথির ভাষণে ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণ শুধু স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, এটি একটি বহুমাত্রিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়। তামাকজনিত রোগব্যাধিতে প্রতি বছর ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। এটা আমাদের জনস্বাস্থ্যের জন্য জরুরি সংকেত। তামাক নিয়ন্ত্রণের প্রভাবে রাজস্ব হারানোর যেসব উদ্বেগ তার বিপরীতে সমাজে বৃহত্তর ইতিবাচক যে প্রভাব ঘটবে তা বিবেচনার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, তরুণ শ্রমশক্তি হারানো, ভবিষ্যৎ অর্থনীতির ক্ষতি এবং সমাজের স্বাস্থ্যগত ক্ষতি এড়ানো জরুরি।
প্রধান অতিথি বলেন, নতুন ধূমপায়ী ও তরুণদের আসক্তি প্রতিরোধ করা প্রধান চ্যালেঞ্জ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশে ভিজ্যুয়াল ডিসপ্লে সীমাবদ্ধ করা, তামাক সেবনে পরোক্ষ প্রণোদনা নিয়ন্ত্রণ এবং প্রশাসনিক ও আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তামাক চাষের কারণে জমির উর্বরতা নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। তাই তিনি কৃষির বৈচিত্র্য রক্ষা ও বিকল্প শস্য উৎপাদনের সুযোগ সৃষ্টির ব্যাপারে মনোযোগী হওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
অধ্যাপক গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক বলেন, তামাক পুরোপুরি নির্মূলের চেষ্টা তো দীর্ঘদিন ধরে চলছে। এখন দেশ ও জাতির কল্যাণে তামাকপণ্য উৎপাদক কোম্পানিগুলোকে আঘাত করার সময় এসেছে। এটা ছাড়া এ পরিবর্তন অর্জন সম্ভব নয়।
আবু জামিল ফয়সাল বলেন, তরুণ জনগোষ্ঠীকে তামাকের ছোবল থেকে সুরক্ষার জন্য তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপমুক্ত একটি শক্তিশালী আইন এবং এর কঠোর বাস্তবায়ন জরুরি। ড. মাহফুজ কবীর বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন দ্রুত সংশোধনে সরকারকে কঠোর হতে হবে। কম মূল্যের সিগারেট, জর্দা, বিড়ি এসব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
মানুষ এসবই বেশি গ্রহণ করছে। তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশে তামাকজাতীয় যে কোনো পণ্য বিক্রি করা আইন করে বন্ধ করে দেওয়ার ওপর জোর দিয়ে বলেন, বিকল্প হিসেবে কম নিকোটিনের কিছু উদ্ভাবন করা যায় কি না তা-ও দেখা উচিত।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রায় ৪ কোটি প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করে। তামাক ব্যবহারের কারণে দেশে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ প্রতি বছর মারা যান। পঙ্গুত্ব বরণ করেন আরও ৪ লাখ মানুষ। কর্মস্থলে কাজ করেন এমন প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠী ৪২ দশমিক ৭ শতাংশ পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। এ ছাড়া ধূমপান না করেও কর্মক্ষেত্রে নারীরা ১৯ শতাংশ, গণপরিবহনে ৩৮ শতাংশ ও বাড়িতে ৩৭ শতাংশ পরোক্ষভাবে শিকার হন।
বাংলাদেশে করোনা মহামারিতে অধূমপায়ীদের তুলনায় ধূমপায়ী রোগীদের মৃত্যুর হার ৩ গুণ বেশি। এ ছাড়া ঢাকা শহরের আশপাশে প্রাথমিক স্কুলে পড়া ৯২ শতাংশ শিশুর দেহে পাওয়া গেছে উচ্চমাত্রার নিকোটিন, যারা মূলত পরোক্ষ ধূমপানের শিকার।