রবিবার, ২৩ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

ফসলি জমিতে পুকুর খননের মহোৎসব

বাবুল আখতার রানা, নওগাঁ

ফসলি জমিতে পুকুর খননের মহোৎসব

কৃষক তনজেব আলী মাঠের তিন বিঘা বোরো ধানের জমিতে পুকুর খননের জন্য লিজ প্রদান করেছেন। বাৎসরিক ২০ হাজার টাকা চুক্তিতে তিন বিঘা জমি থেকে তার আয় হবে ৬০ হাজার টাকা। শুধু কৃষক তনজেব আলীই নন। এভাবে আরও ৪৪ জন কৃষকের কাছে থেকে একইভাবে অন্তত ২০০ বিঘা ধানি জমি লিজ নিয়েছে একটি অসাধু সিন্ডিকেট। ইতিমধ্যে সেখানে খনন করা হয়েছে বিশাল আকৃতির পুকুর। ফলে চলতি মৌসুমে ওই মাঠের ২০০ বিঘা জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়নি। এতে করে প্রত্যেক বছর অন্তত ৬ হাজার মণ ধানের উৎপাদন বন্ধ হয়েছে। এ চিত্র নওগাঁর মান্দার কালিকাপুর ইউনিয়নের মাউল মাঠের। শুধু মাউল মাঠ নয়। উপজেলার যত্রতত্র আবাদি জমিতে চলছে পুকুর খননের মহোৎসব। বর্তমানে মান্দা, পরানপুর, ভারশোঁ, গণেশপুর, কাঁশোপাড়া ইউনিয়নসহ বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের নহলা কালুপাড়া গ্রামের মাঠে বোরো ধানের জমিতে এস্কেভেটর দিয়ে পুকুর খনন করা হচ্ছে। এভাবে আবাদি জমিতে অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খনন করায় প্রতিনিয়ত কমছে কৃষি জমির পরিমাণ। একই সঙ্গে কমছে ফসলের উৎপাদন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উত্তরাঞ্চল খরাপ্রবণ এলাকা। ক্রমেই এ অঞ্চলের তাপমাত্রা বাড়ছে। ফসল উৎপাদনে কাক্সিক্ষত বৃষ্টিপাত হচ্ছে না। এ কারণে ভূ-গর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার করতে হচ্ছে। এরই সঙ্গে অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খনন করা হলে পরিবেশের ওপর চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। দেশে বর্তমানে খাদ্য ঘাটতি না থাকলেও ভবিষ্যতে বিশাল খাদ্য ঘাটতির সম্মুখীন হবে জাতি। শিল্পপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, বসতবাড়িসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নির্মাণের কারণে প্রতিনিয়তই কমছে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ। বর্তমানে মাছ চাষের জন্য নিচু ফসলি জমি নির্বিচারে পুকুরে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। পুকুর খননের জন্য জমির লিজদাতা কৃষকরা জানান, এক বিঘা জমিতে ধান চাষ করে পাওয়া যায় ২০ থেকে ২৫ মণ।

ধান উৎপাদনে সার-কীটনাশক, হালচাষসহ অন্যান্য খরচ করতে হয়। একই সঙ্গে রয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। অনেক সময় উৎপাদন খরচের সঙ্গে বাজার মূল্যের সামঞ্জস্য না থাকায় লোকসান গুনতে হয়। কিন্তু মাছচাষের জন্য এক বিঘা জমি লিজ দিয়ে ২০ হাজার টাকা পাওয়া যাচ্ছে। এখানে কোনো টেনশন নেই। মাউল গ্রামের কৃষক সামসুল আলম ও আবদুল কাদের জানান, চলতি বোরো মৌসুম শুরুর আগেই উপজেলার কালিকাপুর ইউনিয়নের মাউল বিলে প্রায় ২০০ বিঘা জমির চারদিকে পাড় দিয়ে ধানি জমি পুকুরে পরিণত করা হয়েছে। এতে করে প্রত্যেক মৌসুমে ওই বিল থেকে অন্তত ৬ হাজার মণ বোরো ধানের উৎপাদন চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বগুড়ার উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম প্রামাণিক বলেন, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশে মাথাপিছু আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ২৫ শতক। বর্তমানে তা কমে ১০ শতকে এসে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় অনুমতি ছাড়াই শ্রেণি পরিবর্তন করে খনন করা হচ্ছে পুকুর। এতে করে দেশে ভবিষ্যতে খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে। ফসলি জমিতে পুকুর খনন বন্ধ করতে আইনি পদক্ষেপ জরুরি বলে মনে করছেন এই কৃষিবিদ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রোনমি বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আবদুল আলিম বলেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে বসতবাড়ি নির্মাণ, নতুন নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা স্থাপনসহ বিভিন্ন কারণে দিন দিন কমছে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ। এর মধ্যে চলছে অপরিকল্পিত পুকুর খনন, যা কখনই কাম্য নয়। তিনি আরও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উত্তরাঞ্চলের তাপমাত্রা বাড়ছে, তেমন বৃষ্টিপাত হচ্ছে না। এ অবস্থায় অপরিকল্পিত পুকুর খনন করা হলে জলবায়ুর ওপর চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আগামীতে খাদ্য ঘাটতির সম্মুখীন হবে জাতি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. মাহাবুবুর রহমান বলেন, ধান ও মাছের দামের পার্থক্য, মাছচাষ সহজ ও তুলনামূলক লাভবান বেশি হওয়ার সম্ভাবনায় মাছচাষে লোকজন ঝুঁকে পড়েছে। অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র কৃষিজমিতে খনন করা হচ্ছে পুকুর। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে পরিবেশের ওপর। তিনি আরও বলেন, মাছচাষের ফলে মাটির গুণাগুণ পরিবর্তন হয়। এ ছাড়া মাছচাষে ব্যবহৃত বিভিন্ন ফিডও কোয়ালিটিসম্পন্ন নয়। এ কারণে পুকুরের আশপাশের জমিগুলোতে ভালো ফসল উৎপন্ন হয় না। যত্রতত্র অপরিকল্পিত পুকুর খনন বন্ধ করা প্রয়োজন।  মান্দা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ইমরানুল হক বলেন, সরকারি জমিতে কেউ পুকুর খনন করলে সে ক্ষেত্রে অত্র দফতরের আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে। ব্যক্তি মালিকানার জমিতে পুকুর খনন হলে এ দফতরের ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই। তবে কেউ সংক্ষুব্ধ হয়ে দেওয়ানি আদালতে মামলা করতে পারেন।

সর্বশেষ খবর