গাজীপুরের কালীগঞ্জ শ্রমিক কলেজের অধ্যক্ষ মো. ফেরদৌস মিয়ার বিরুদ্ধে শিক্ষক নিপীড়ন, নিয়মনীতি লঙ্ঘন, অন্যায়কে প্রশ্রয় ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ এনেছেন গ্রন্থাগারিক মো. দেলোয়ার হোসেন। সোমবার দুপুরে উপজেলা প্রেস ক্লাবে তিনি এক সংবাদ সম্মেলনে এসব অভিযোগ করেন।
সংবাদ সম্মেলনে দেলোয়ার হোসেন বলেন, ১৯৯০ সালে কালীগঞ্জ শ্রমিক কলেজে গ্রন্থাগারিক হিসেবে যোগদান করেন। অধ্যক্ষ ফেরদৌস মিয়া ১৯৯৮ সালে সাধারণ শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পান। নিয়োগ লাভের পর থেকে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ক্লাস কামাই দিয়ে নোট বইয়ের সহায়তায় বিরামহীনভাবে প্রাইভেট পড়ানো শুরু করেন। শিক্ষার্থীদের অভ্যন্তরীণ ও পাবলিক পরীক্ষায় নকল সরবরাহ করাসহ সকল অসাধু উপায় অবলম্বন করা তার চরিত্রের অবিচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়। আর তার এ অনৈতিক ও অশিক্ষকসুলভ কাজের প্রতিবাদ করায় তার সাথে বিরোধ চরমে উঠে। ২০১৩ সালে অধ্যক্ষ হিসাবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে পূর্বের বিরোধকে কেন্দ্র করে তাকে চাকুরিচ্যুত করতে ধারাবাহিকভাবে নিয়ম বহির্ভূত ও বিরোধপূর্ণ প্রশাসনিক বিধি-নিষেধ আরোপ শুরু করেন। অধ্যক্ষ তার প্রতি ন্যূনতম সম্মান দেখানোর পরিবর্তে তাকে নিম্নশ্রেণির কর্মচারী হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
তিনি বলেন, অধ্যক্ষ সরকারি বিধি অগ্রাহ্য করে ২০১৩ সালের ২৮ অক্টোবর এক অফিস আদেশ জারি করে তাকে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকাল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত গ্রন্থাগারে অবস্থান করতে বাধ্য করেন। ২০১৩ সালে ২৫% বোনাস কেটে দেন। প্রতিদিন অফিস চলাকালে দুপুরের খাবারের সময় না দিয়ে বাথরুমে যেতে হলেও তার অনুমতি নিয়ে যেতে বলেন। ২০১৩ সালে ২৮ নভেম্বর তার এমন বৈরী আচরণ ও অপ্রশাসনিক কার্যকলাপের প্রতিবাদ ও প্রতিকার চাওয়ায় তাকে প্রাণনাশের হুমকি দেন অধ্যক্ষ। পরে ওইদিনই নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে তিনি কালীগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়রি করেন।
গ্রন্থাগারিক বলেন, অজ্ঞাত এক নীলনকশা তৈরি করে ২০১৬ সালের ২৭ আগস্ট কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করে ৩০ আগস্ট তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ওই সময় শ্রমিক কলেজ সরকারিকরণের অংশ হিসেবে আসা পরিদর্শন টিমের কাছে তার বিরুদ্ধে রুজুকৃত মামলা এবং সাময়িক বরখাস্তের তথ্য গোপন করেন। মাত্র তিন দিনের নোটিশে সাময়িক বরখাস্ত করায় তিনি উপায়ান্তর না দেখে বিধি বহির্ভূতভাবে সাময়িক বরখাস্ত করার প্রতিকার চেয়ে ওই বছর ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বরাবর আপিল করেন। ভিসি ১৯ অক্টোরবর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এক চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে দেন গ্রন্থাগারিক মো. দেলোয়ার হোসেন গভর্নিং বডি কর্তৃক দণ্ড প্রাপ্ত নন। অন্যদিকে একই বছর তিনি আদালতেরও আইনের আশ্রয় নেন। যার দেওয়ানী মোকদ্দমা নং ১৩৪/২০১৬ খ্রিঃ। আদালত বাদির আরজিতে সন্তুষ্ট হয়ে ২০১৭ সালের ২২ মার্চ বিবাদীর বিরুদ্ধে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করেন এবং বিধি মোতাবেক জীবনধারণ ভাতা প্রদানের নির্দেশ দেন। কিন্তু ওই অধ্যক্ষ আদালতের আদেশ উপেক্ষা করে কলেজে উপস্থিত থাকার পরও হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করতে না দিয়ে জীবনধারনের ভাতাও কর্তন শুরু করেন। দীর্ঘ তিন মাস জীবনধারণ ভাতা বন্ধ করে রাখেন এবং অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার ভিতর তদন্ত কমিটি গঠন করেন।
মো. দেলোয়ার হোসেন অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলেন, অধ্যক্ষের আক্রোশের শিকার হয়ে দীর্ঘ ২৮ বছর চাকুরি জীবনের বর্তমান অবস্থা তাকে চরম আর্থিক সংকটে ও হতাশাগ্রস্থ করে ফেলেছে। আর তার এ আর্থিক অবস্থার কারণে একমাত্র মেয়েকে চলতি বছরে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়ানো সম্ভব হয়নি। আর পরিবার পরিজন নিয়ে প্রায় দুই বৎসর যাবৎ মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
জানা গেছে, হাইকোর্টের রিট পিটিশন নং ৩৬৫৭/২০১৫ এর রায়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোন শিক্ষককে ৬০ দিনের বেশি সাময়িক বরখাস্ত না রাখার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে যা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ ২০১৭ সালের ৬ আগস্ট পরিপত্র জারি করেন। অধ্যক্ষ হাইকোর্টের নির্দেশনা এবং সরকারি পরিপত্র অমান্য করে অদ্যাবধি গ্রন্থাগারিক মো. দেলোয়ার হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করে রেখেছেন। অথচ নৈতিক স্খলনের দায়ে ২০১৭ সালে ১৭ নভেম্বর একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সাময়িক বরখাস্তকৃত এক শিক্ষককে ৬০ দিনের মধ্যে চাকুরিতে বহাল করেন।
হাইকোর্টের নির্দেশনা ও সরকারি পরিপত্র গভর্নিং বডির সভাপতির নজরে এনে ২০১৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সাময়িক বরখাস্ত প্রত্যাহারের আবেদন করলে গভর্নিং বডির সভাপতি আবেদনটিতে মার্ক করে অধ্যক্ষের কাছে পাঠান এবং জরুরী ভিত্তিতে তা সমাধানের নির্দেশ দেন। কিন্তু অধ্যক্ষ এসব নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে কালক্ষেপণ করে চলেছেন। চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি অধ্যক্ষ তার প্রভাব খাটিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তদন্ত প্রতিবেদন আনয়ন করেন। গ্রন্থাগারিক উক্ত প্রতিবেদন পাওয়ার অধিকার রাখার পরও তাকে প্রতিবেদন দেয়া হচ্ছে না। উপরন্তু প্রতিবেদন চাওয়ায় গ্রন্থাগারিকের সাথে অশোভন আচরণ করেন।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত অধ্যক্ষ মো. ফেরদৌস মিয়া জানান, এটা তার সিদ্ধান্ত নয়। কলেজ গভর্নিং বডির সিদ্ধান্তেই তার বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া গ্রন্থাগারিক মো. দেলোয়ার হোসেন নিয়মিতভাবে কলেজে আসে না।
বিডি প্রতিদিন/৭ মে, ২০১৮/ফারজানা