শ্রাবণের ভরা মৌসুমেও তিস্তার বুকে জেগে উঠেছে অসংখ্য চর। একসময়ের খরস্রোতা তিস্তা এখন শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছে। নদীতে বৃহদাকার বালুর স্তূপ তৈরি হওয়ায় মূল গতিপথ হারাতে বসেছে।
সরেজমিনে তিস্তা দ্বিতীয় সেতু এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, একটি নালা দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে তিস্তার পানি। বিশাল তিস্তার বুকে নেই হাঁটুপানিও। পানিশূন্য তিস্তা যেন ডুকরে কাঁদছে।
জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে টানা বর্ষণ আর উজানের ঢলে ভয়ংকর আকার ধারণ করে তিস্তা নদী। ওই সময় লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় অবস্থিত দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প ‘তিস্তা ব্যারাজ’ রক্ষায় খুলে দেওয়া হয় ৫৪টি গেট। এতে শুধু ব্যারাজের উজানের বাসিন্দারাই নন, ভাটি এলাকার কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েন। নদী ভাঙনে বসতভিটাসহ সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে প্রায় ২০ হাজার পরিবার। সময়ের বিবর্তনে তিস্তার নাব্য এতটাই হ্রাস পাচ্ছে যে, আসন্ন রবি মৌসুমে তিস্তা ব্যারাজের সেচ কার্যক্রম চালানোই কঠিন হয়ে পড়বে। প্রতিদিনই পানি কমছে। কোথাও সামান্য পানি আবার কোথাও দিগন্তজোড়া বালুচর। ব্যারাজ থেকে শুরু করে তিস্তার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে পানি না থাকায় শঙ্কায় রয়েছেন কৃষক।
তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় একদিকে যেমন বর্ষা মৌসুমে ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে প্রতি বছর হাজার হাজার
মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে, তেমনি শুষ্ক মৌসুমেও তিস্তা ব্যারাজের ভাটিতে ভারত তাদের গজলডোবা বাঁধের সাহায্যে পানি আটকে বাংলাদেশের উত্তর জনপদের লাখ লাখ কৃষকের বোরা চাষাবাদ ব্যাহত করছে। ফলে দিনে দিনে প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে দেশের বৃহত্তম তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পটি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে যে হারে পানিপ্রবাহ কমে আসছে তাতে শিগগিরই কাক্সিক্ষত পানি চুক্তি সম্পন্ন না হলে, মরা খালে পরিণত হতে পারে বহুল আলোচিত তিস্তা নদী। সেই সঙ্গে তিস্তা নদীর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা উত্তর জনপদের জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তিস্তা সেচ প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে উজানের পানির ওপর। কিন্তু তিস্তা নদীতে পানি কম আসার কারণে সেচযোগ্য জমির আওতা কমছে। শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে খাঁ খাঁ করে বালুচর। আর বর্ষাকালে পানি উপচে ভাঙনের মুখে পড়ে বসতবাড়ি, স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, সড়ক-পুল-কালভার্ট। এর ফলে চাষাবাদ কমে বদলে যাচ্ছে এলাকার মানুষের জীবিকা।
চলতি বছরে বর্ষা মৌসুমেও লালমনিরহাট জেলার পাঁচটি উপজেলার তিস্তাপাড়ের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ধু-ধু বালুচর দেখা যায়। চরের মধ্যে ভেঙে পড়ে থাকতে দেখা যায় একাধিক সড়ক ও সেতু। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, তিস্তা ব্যারাজে এ মুহূর্তে পানি রয়েছে ৩৬ হাজার কিউসেক। এ সময়ে পানি থাকার কথা ৫০-৬০ হাজার কিউসেক। পানি প্রতিদিনই কমছে বলে জানান লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শুনীল রায়। নদী গবেষক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, বিজ্ঞানসম্মতভাবে তিস্তা খনন না হলে বাংলাদেশ অংশের ১৬৫ কিলোমিটারজুড়ে নদীর দুই পাড়ের মানুষের দুর্ভোগের শেষ থাকবে না। এ সময় যে পরিমাণ পানি থাকার কথা তা না থাকায় নদীটি একেবারে মরতে বসেছে। এই নদী রক্ষা হলেই বাঁচবে উত্তরাঞ্চল। তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের লালমনিরহাটের সভাপতি ড. শফিকুল ইসলাম কানু বলেন, পানি বণ্টন চুক্তি না হওয়ায় বর্ষা মৌসুমেও শুকিয়ে চৌচির হয়ে পড়ে তিস্তা নদী। জেগে উঠেছে অসংখ্য চর। এ অবস্থায় তিস্তার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন জরুরি। তিস্তা খনন ও মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে।