অনেক রাত এখন। বাইরে কুকুরের হাঁকডাক। দূর থেকে নাইট গার্ডের শিস শোনা যাচ্ছে। জানালা খুলে বাইরে তাকালাম। বাইরে চাপ চাপ অন্ধকার। হালকা ঝিরিঝিরি বাতাস এসে দোল খেয়ে গেল আমার ঘরে। মনোরম বাতাস। মধ্যরাতে শরীরটা বাতাসের আবেশে ঝরঝরে হযে উঠল। আমি এক গ্লাস পানি খেলাম। ওয়াসরুমে গেলাম। তারপর লেখার টেবিলে। খাতাটা খোলা ছিল। পাশে একাকী কলমটা পড়ে আছে। আমি টেবিলে বসে পড়ি। গায়ে সুতি চাদর ঝুলিয়ে দিলাম। শাদা মুড়ি চিবুতে চিবুতে সন্ধ্যার লেখাটায় চোখ বুলাতে লাগলাম।
একটা সুবিধাবঞ্চিত মেয়ের গল্প শুরু করেছি। মেয়েটি থাকে হাতিরপুলের বাজারের এক বস্তিতে। ভোরবেলা মা যান পরের বাসায় কাজ করতে। বাবা বের হন রিকশা নিয়ে মেয়েটির নাম আনোয়ারা। বয়স কত হবে? আট অথবা দশ। সে একা একা ঘুরে বেড়ায় শাহবাগ, টিএসসি, রমনা পার্কে। পথের শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা করে। সুযোগ পেলে হাত পাতে পথচারীদের কাছে। দু-চার টাকা জুটে যায়। সেই টাকায় দুপুরের খাবার হয়। কিংবা খিদা লাগলে ঝালমুড়ি খায়। চিপস খায়। কিংবা ছোট ছোট কলা খায়। অন্য শিশুরা যদি ভাগ চায় তখন আনোয়ারা সবাইকে সঙ্গে নিয়ে খায়।
এই মেয়েটির গল্প লিখতে শুরু করেছি। ছোটদের গল্প। কিন্তু গল্পটি খুব মানবিক হবে। দুঃখের পরশ মাখানো গল্প। কলম নিয়ে প্রস্তুত হলাম। গল্পটার বাকি অংশ লেখা শুরু করব। বাইরের মনোরম বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে হৃদয় ও মনে। নীরব পরিবেশ। কোথাও কোনো ভারী শব্দ নাই। নিঝুম হয়ে আছে মধ্যরাতে আমাদের পাড়া।
এমন সময় ঘরের ভিতরে টুপ করে একটা শব্দ হলো। তাকিয়ে দেখি, আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ফুটফুটে এক মেয়ে। একদম পরির মতো দেখতে। পরনে শাদা জামা। লাল স্কার্ফ গলায়। চোখ দুটো খুব মায়াময়। যে আনোয়ারাকে নিয়ে গল্প লিখছি তারই বয়সী হবে। ভারী মিষ্টি মেয়ে। যেন পরির মতো দেখতে।
তুমি কোথা থেকে এলে পরিসোনা।
আমার নাম সোনালি। আমি জানি তুমি গল্প লিখ আমাদের জন্য। আমি তোমার কিছু গল্প পড়েছি। ভালোই লেগেছে। তোমার লেখা নিয়ে কিছু প্রশ্ন আছে আমার।
আমি একটু শক্ত হয়ে বসলাম।
তুমি কি জানতে চাও? কী নাম যেন তোমার? সোনালি?
জি। আমার প্রথম প্রশ্ন, কেন তুমি ছোটদের জন্য লিখ?
ভালো লাগে তাই লিখি।
না। নিশ্চয়ই কারণ আছে। সেটা বল।
অনেক বড় উত্তর হবে।
না। ছোট করে বল।
মানুষ আর প্রকৃতিকে ভালোবাসতে হবে। আমারা প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হবে। এই গাছপালা, নদী, পাহাড়, সমুদ্র, অরণ্য কোনোকিছুকে ধ্বংস করা যাবে না। নষ্ট করা যাবে না। প্রকৃতিকে রক্ষা করতে না পারলে আমরাও ধ্বংস হয়ে যাব। দ্যাখ বাইরে কেমন ফাল্গুনের বাতাস বইছে। উদাসী বাতাস। পৃথিবীতে যা কিছু সুন্দর আমি সেটাই বলতে চাই ছোটদের।
তুমি যা বলতে চাও আমরা কি সেটা বুঝতে পারি সবসময়?
তা আমি জানি না। বললাম আমি। ছোটরা বড়দের চেয়ে বুদ্ধিমান। ছোটদের সবসময় বোঝা যায় না। তাই যা কিছু লিখি তা সবসময় ছোটরা বোঝে কিনা তা কেউ বলতে পারে না। ছোটদের জন্য লেখা আমি অনেক পড়েছি। কোনো কোনো লেখা একেবারেই বুঝি না। ভালো লাগে না-
হয়তো সেসব লেখা বড়দের জন্য লেখা। বিষয়ের কারণে ছোটদের পাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা। কিংবা সব লেখক যে ছোটদের মন বুঝতে পারে এমন কথা বলা যায় না। ছোটদের জন্য লিখতে হলে দরদি মন থাকা দরকার। হৃদয় খুব উদাস উদার হতে হবে।
এবার বইমেলায় তুমি কী লিখলে?
অনেকগুলো বই ই তো লিখেছি তোমাদের জন্য। মায়ের স্মৃতি নিয়ে খুব মর্মস্পর্শী একটা বই লিখেছি। নাম ‘মা আমার পৃথিবী’। আমার মায়ের জীবন থেকে নেওয়া কিছু সত্য ঘটনা নিয়ে গল্পের মতো করে লিখেছি।
বাহ! বইটা পড়তে হবে।
খুব বিজ্ঞের মতো বলল মেয়েটি।
আর কী লিখলে?
দুটো ছড়ার বই। তরুণদের জন্য লেখা।
তখন মেয়েটি বলল,
তোমার বড় ছড়াগুলো একদম ভালো লাগে না। মানে বুঝি না। আবার তোমার ছোট ছোট ছড়াগুলো খুব মজার।
একেবারে ঠিক বলেছ। আর তুমি কিন্তু খুব সুন্দর রূপকথা লিখে থাক। তোমার রূপকথা পড়ে কী যে আনন্দ পাই। মন ভরে যায়। কত দেশের রূপকথা তুমি লিখেছ।
ইংল্যান্ডের রূপকথা, আফ্রিকার রূপকথা, রেড ইন্ডিয়ান রূপকথা, জাদু বাস্তব রূপকথা আমি দু-তিনবার করে পড়েছি।
মেয়েটির এই কথা শুনে খুব আনন্দবোধ হলো আমার। তাহলে শিশুরা আমার বই পড়ে মজা পায়। বইয়ের নাম মনে রাখে। এর চেয়ে খুশির খবর আর কী হতে পারে?
মেয়েটি উপদেশ দিল, তুমি তো ছোটদের জন্য লেখ। তুমি আরও ভালো ভালো লেখা লিখবে। লেখা লিখতে গিয়ে তাড়াহুড়া করবে না। যত্ন সহকারে লেখবা। বুঝলা?
আমি চোখ বন্ধ করে মাথা ঝাঁকালাম। ভাবছি, কত অবহেলায় না ছোটদের জন্য লিখি। এখন থেকে খুব যত্ন নিয়ে লিখব। বুঝলে সোনালি।
তাকিয়ে দেখি সামনে মেয়েটি নাই। ডানে বাঁয়ে তাকালাম। নেই। যেন রূপকথার রাজকন্যে। হঠাৎ করে চলে গেল।
আমি সোনালির কথা ভাবতে ভাবতে আনোয়ারার জন্য গল্পের বাকি অংশ লিখতে শুরু করলাম।