গভীর রাত। ঘড়ির কাঁটা শব্দ করছে টিক টিক টিক। নেহাল বসে তার পড়ার টেবিলে। ঘুম আসছে না। কুপির মিটিমিটি আলো জ্বলছে। বিদ্যুৎ নেই। গ্রামে এই একটা সমস্যা। বিদ্যুৎ একবার চলে গেলে লাপাত্তা। কোথায় হারিয়ে যায় কে জানে? ঘুমিয়ে পড়ে কি না? বিদ্যুতেরও ঘুমাতে হয়! ধ্যাত, কি যা-তা ভাবছি, বলে দক্ষিণের জানালাটা খুলে দিল নেহাল। ধীরে ধীরে বাতাস বইতে লাগল তার কামরায়। নেহাল প্রায় রাতেই জানালা খুলে ঘুমায়। সাহসী ছেলে ও। কোনো কিছুর ভয় তার নেই। তার শুধু একটাই বিশ্বাস আল্লাহ ছাড়া আমি কাউকে ভয় পাই না।
নেহাল এবার খাতা কলম নিয়ে বসল। আগামীকালই একটা গল্প জমা দিতে হবে। স্কুলে গল্প প্রতিযোগিতা চলছে। কাল শেষ সময়। নেহালও ভেবেছে এবার সে একটা গল্প জমা দেবে। যদিও কোনো দিন গল্প লিখেনি ও। কিন্তু নেহালের পড়ার প্রতি ঝোঁক আছে। অনেক গল্পের বই তার সংগ্রহে আছে। আছে কিছু ম্যাগাজিনও। গল্প পড়তে ভীষণ ভালো লাগে নেহালের। তাও আবার ভূতপ্রেতের গল্প। এই জানালা খোলা রেখে কত ভয়ংকর ভয়ংকর ভূতের গল্প পড়েছে নেহাল তার কোনো ইয়ত্তা নেই। তার বন্ধুরা জানে, নেহাল প্রচুর গল্পের বই পড়ে। তাও আবার ভূতপ্রেতের গল্প। তাই সহপাঠীদের জোর আবদার, এবার গল্প প্রতিযোগিতার পুরস্কারটা যেন ক্লাস ফোরেই আসে।
নেহাল লেখা শুরু করে দিল। কুপির মিটিমিটি আলোয় কলম চলছে। গল্প এগোচ্ছে ধীরে ধীরে। খোলা জানালায় মৃদু বাতাসে কুপির আলো নিভুনিভু করছে। বাতাস কমলে ফের জ্বলছে। নেহাল কুপির নিভু নিভু আগুনকে উপভোগ করছে। ভূতের গল্প সামনে এগোচ্ছে আর ভয়ংকর হয়ে উঠছে। কখনো কখনো নেহালের চিবুকে সরু লম্বা হয়ে পশমের গোড়ায় ঘাম জমছে। নেহাল হারিয়ে গেছে ভূত গল্পে।
যখন গল্প লেখা শেষ তখন ঘড়ির কাঁটা ৩টার ঘরে। নেহাল মুখে হাই উঠিয়ে খাতাকলম গোছাতে লাগল। এমন সময় খোলা জানালা দিয়ে মৃদু বাতাসের সঙ্গে কেমন যেন বিচ্ছিরি গন্ধ আসতে লাগল। বাতাসটা ভারী ভারী হয়ে উঠল। নেহাল যেই না জানালা বন্ধ করতে যাবে ওমনি আওয়াজ আসল, ‘জানালা বন্ধ করো না। তোমার সঙ্গে কথা আছে।’
কে তুমি, কি-ই বা এমন কথা- এত রাতে বলতে হবে। সাহসী নেহাল প্রশ্ন করে।
আমি পিটু? ছানা ভূত। ওই যে একটা বট গাছ দেখতে পাচ্ছ? ওই গাছেই আমরা থাকি। যদিও আর বেশি দিন থাকা হবে না ওই গাছে।
কেন, বাসা পাল্টাবে নাকি? নেহাল একটু খোঁচা মারল।
পিটু মনটা খারাপ করে বলল, শুনছি ওইদিক দিয়ে রাস্তা যাবে। মানুষও নাকি ওই গাছের নিচে আসতে ভয় পায়। সব মিলিয়ে গাছটা কাটা পড়বে।
যাইহোক, ওই গাছ থেকে তোমার জানালাটা দেখা যায়। আসব আসব করেও আসা হয় না। এই এলাকা ছেড়ে চলেই যেহেতু যাব ভাবলাম তোমার সঙ্গে দেখা করে যাই। তাই আজ চলে এলাম।
কেন এলে? বিরক্তি দেখিয়ে বলল নেহাল।
গল্প করতে এসেছি। বলল ছানা ভূত পিটু। তা ছাড়া তুমি তো অনেক ভূতের গল্প পড়। ভাবলাম তোমার সঙ্গে জমবে, জমপেশ আড্ডা হবে।
কেন, তুমি আর কারোর কাছে গিয়েছিলে নাকি? নেহালেরও গল্প করতে মন চাইল।
পিটু ভূত বলল, আর বলো না। সেদিন ওই বাড়ির মন্টুর সঙ্গে গল্প করতে গিয়েছিলাম। আমার কথা শুনে বেচারা চিৎকার করতে করতে প্যান্ট নষ্ট করে দিল।
তারপর তারপর। নেহাল কৌতূহলী হয়ে উঠল।
তারপর আর কী, চলে এলাম সেখান থেকে। তুমি ভূতের গল্প পড়। তোমার সাহস আছে। তাই তোমার কাছে এলাম।
আমি ভূতের গল্প পড়ি তুমি কীভাবে জানলে। অবাক নেহালের প্রশ্ন।
পিটু বলল, তোমার নাম নেহাল, তুমি চতুর্থ, শ্রেণিতে পড়; সে আমি অনেক কিছুই জানি। আচ্ছা আমি লক্ষ করেছি তুমি অনেকক্ষণ ধরে কলম দিয়ে কী যেন লিখছ। তুমি এত রাতে কী লিখছ?
সে আর বলো না। আমাদের স্কুলে গল্প প্রতিযোগিতা চলছে। আগামীকালই লাস্ট ড্যাট। বন্ধুরা ধরেছে গল্প লিখতে হবে। তাও আবার ভূতের গল্প। মানে তোমাদের গল্প। শুধু লিখলেই চলবে না পুরস্কারও জিততে হবে। তাই একটা ভূতের গল্প লিখে শেষ করলাম মাত্র। ওমনি তুমি হাজির।
পিটু ভূত বলল, তা ভূতের গল্প লিখবে, রাত্রে কেন? তাও আবার এই নিশি রাতে। কুপি জ্বালিয়ে। দিনের আলোতে লিখলেই তো হয়।
নেহাল বলল, ভূতের গল্প লিখব তাও আবার দিনে- এমনটা কি হয়! জানত ভূতের গল্পে ভয় ভয় একটা বিষয় আছে, গা ছমছমের একটা ভাব আছে; রাতে না লিখলে এমটা কি অনুভব হয়!
তাই নাকি, আচ্ছা আমাদের নিয়ে গল্প লিখেছ? দেখি দেখি বলেও চুপসে গেল পিটু।
এই নাও। খাতাটা এগিয়ে দিল নেহাল।
পিটু বলল, আরে না না। দেখতে হবে না। বরং তুমিই পড়ে শুনাও।
পড়তে পার না বুঝি? কীভাবে পড়বে, লেখাপড়াই তো শেখনি।
লজ্জা-সংকোচে এতটু হয়ে পিটু বলল, তুমি কীভাবে জানলে! ছানা ভূত পিটু নিজেকে অবাক মানল। নেহালের সাহসের সঙ্গে বুদ্ধি আছে ঢের বেশি।
নেহাল পিটুর পেছনের কথার জবাব করল। বলল, মানুষদের অহেতুক কষ্ট দাও। ভয় দেখাও। ঝগড়া বাধাও। রাতদুপুরে খালবিল থেকে কাঁচা মাছ খাও। তাই তো তোমাদের শরীর থেকে আঁইশ আঁইশ গন্ধ আসে। সে আরও অনেক কিছুই জানি।
পিটু ফের অবাক হলো। ভাবল, নেহাল দেখি সবই জানে। সর্বনাশ মানুষ আমাদের সম্পর্কে এতকিছু কীভাবে জানে? এসব ভাবনা একপেশে রেখে মুহূর্তে পিটু কর্কশ গলায় বলে উঠল, দেখ নেহাল, আমাদের সবাই কিন্তু খারাপ না। তোমাদের মধ্যে যেমন ভালো-খারাপ দুটাই আছে তেমনি আমাদের মাঝেও। তবে, এটা জেনে খুশি হবে আমি আজ অবধি কাউকে ভয় এবং কষ্ট কোনোটাই দেয়নি।
নেহাল গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলল, হয়েছে হয়েছে, আর সাধুগিরি সাজতে হবে না। আমিই পড়ে শুনাচ্ছি আমার লেখা ভূতের গল্পটা। তোমাকে আর পড়তে হবে না।
তাই বলো। ছানা ভূত পিটু যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
নেহাল সদ্য লেখা ভূতের গল্পটা ছানা ভূত পিটুকে পড়ে শুনাল।
এবার বলো কেমন হলো। নেহাল পিটুর মতামত জানতে চাইল।
পিটু ভূত বলল, বেশ। তোমার গল্প লেখার হাত দারুণ। গল্পে আমাদের সম্পর্কে যা যা বলেছ তা সব সঠিক না হলেও অধিকাংশই মিলে যায়। আর হ্যাঁ, কী ভয়ংকর গল্পটা। আমি ভূত নিজেই তোমার গল্প শুনে ভীতু হয়ে গেলাম। কী সাংঘাতিক রে বাবা! আমার ধারণা এই গল্প দিয়ে তুমি ফার্স্ট হবে। এবং পুরস্কার জিতবে।
নেহাল বোধহয় বেশ খুশি হলো পিটুর প্রশংসা পেয়ে। সেই বোধহয় প্রথম লেখক যে ভূতের গল্প লিখে ভূতের প্রশংসা কুড়িয়েছে। কিন্তু নেহাল তা প্রকাশ করল না। নিজেকে সামলিয়ে ভূতদের সম্পর্কে কোন কোন ইনফরমেশন ভুল হয়েছে তা পিটু ভূত থেকে ঠিক করিয়ে নিতে লাগল। কারণ, ভূতের সম্পর্কে ভূতরাই তো ভালো জানবে, এটাই স্বাভাবিক। পিটুও এক এক করে বলতে লাগল কোথায় কোন বিষয়টা বসবে। কোনটা বসবে না।
নেহাল দেখল পিটুর পরামর্শ নিয়ে গল্প আরও ভয়ংকর হয়ে উঠছে। ওদের তথ্যগুলোও সঠিক সঠিক বসছে। এভাবে লিখতে লিখতে কখন যে নেহালের চোখ লেগে যায়। ফরজের আজানে ঘুম ভাঙল তার। কিন্তু এটা কি স্বপ্ন না বাস্তব কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না নেহাল। টেবিলে বসেই কাটিয়ে দিল সারারাত। গল্পও লেখা আছে খাতাতে। জানালাও খোলা। তাহলে কি সত্যি সত্যি পিটু এসেছিল?
নেহাল গল্প জমা দিল। কেটে গেল এক সপ্তাহ। দু-তিন রাতে জানালা খোলা রেখে নেহাল অপেক্ষা করেছিল ছানা ভূত পিটুর। কিন্তু না, পিটু আর এলো না। তাই ও ভেবেই নিল সেদিন গল্প লেখা শেষ করে ঘুমিয়ে গিয়েছিল ও। স্বপ্নেই বোধহয় এসেছিল ভূত ছানা পিটু।
এদিক দিয়ে স্কুলে প্রতিযোগিতার ফলাফল ঘোষণা হলো। গল্প বিভাগে ফার্স্ট হলো নেহালের শিশুতোষ ভূতের গল্প ‘পিটু ভূতের পরামর্শ’। নেহাল ও তার বন্ধুবান্ধব বেজায় খুশি। পুরস্কার হাতে পেয়ে ফের পিটু ভূতের কথা মনে পড়ল। তাই নেহাল তার বন্ধুবান্ধবসহ গেল ওই বট গাছ দেখতে। যদিও এদিকে খুব একটা আসা হয় না ওদের। গিয়ে দেখল সত্যি সত্যি বট গাছটা কেটে ফেলা হয়েছে। রাস্তারও কাজ চলছে। তাহলে কি সেদিন রাতে ছানা ভূত পিটু সত্যি সত্যি এসেছিল। নেহাল আবারও মন খারাপ করে নিল।