বাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র খুব কমই রয়েছে। বিশেষত বাংলাদেশে গোয়েন্দা সাহিত্যে হাতেগোনা দু-একটি গোয়েন্দা চরিত্র পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে আছে। আর এরকমই একটি সিরিজ ‘তিন গোয়েন্দা’। কম করে হলেও তিনটি প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় সিরিজ এটি। কিশোর, মুসা, রবিন নাম তিনটির সঙ্গে কোটি বাংলাদেশির কৈশোরের সব দুরন্ত দিনের রয়েছে আন্তরিক মেলবন্ধন। শিশু-কিশোরদের সামনে নতুন পৃথিবী তৈরি করেছে কিশোর, মুসা, রবিনরা। তিন গোয়েন্দার সঙ্গে একটির পর একটি জটিল রহস্যের জাল ছিন্ন করার অভিজ্ঞতা যে কাউকেই মুগ্ধ করে। এ তিন গোয়েন্দার সঙ্গে ঘরে বসেই বেড়িয়ে আসা যায় অ্যামাজন জঙ্গল কিংবা দুর্গম পাহাড়ে। অদ্ভুত রহস্যময়তার সেই জগৎটা এ দেশের শিশু-কিশোরদের বছরের পর বছর, প্রজন্মের পর প্রজš§ মোহিত করে রেখেছে। প্রায় তিন যুগ ধরে চলছে একটি গোয়েন্দা সিরিজ, অথচ তার জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি এতটুকুও! ইতিহাসের বিরল ঘটনা বটে। এ ঘটনাটির কেন্দ্রে যিনি, তিনিই রকিব হাসান। বাংলাদেশের সাহিত্যে ‘তিন গোয়েন্দা’ লিখে যিনি কাটিয়ে দিয়েছেন ৩০-৩৫ বছর। শুধু কী তাই? স্বনামে-বেনামে তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা সাড়ে পাঁচ শরও বেশি। এ মানুষটিকে নামে সবাই চেনে। কিন্তু মিডিয়া কিংবা বইয়ের ফ্ল্যাপ সব জায়গায়ই নিজেকে আড়াল করে রেখেছেন লেখালেখির ৩০ বছর। কখনো কোথাও কোনো ছবি ছাপতে দেননি। বাংলাদেশ প্রতিদিনই দীর্ঘ আড়াল ভেঙে তাঁকে সামনে নিয়ে আসে। এরপর অবশ্য অনেকেই তাঁর ইন্টারভিউ করেছেন। তবু তিনি বরাবরই প্রচারবিমুখ থেকেছেন। সব সময় চেষ্টা করেছেন নিজেকে আড়াল করে রাখতে। নিভৃতচারী হয়ে কেবল লিখে গেছেন দুই হাতে। খ্যাতিমান এ মানুষটির জš§ ১৯৫০ সালে কুমিল্লায়। তাঁর লেখা প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৯৭৭ সালে, ছদ্মনামে। স্বনামে প্রথম প্রকাশিত বইটি ছিল অনুবাদগ্রন্থ, ব্রাম স্টোকারের ‘ড্রাকুলা’। এরপর অনুবাদ করেছেন জুলভার্ন, জিম করবেট, কেনেথ এন্ডারসন, মার্ক টোয়েন, হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড, এরিক ফন দানিকেনের মতো বিখ্যাত লেখকদের অনেক ক্লাসিক বই। অনুবাদ করেছেন মহা ক্লাসিক ‘অ্যারাবিয়ান নাইটস’ ও এডগার রাইস বারোজের ‘টারজান’ সিরিজ। এতসব বইয়ের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছে ছোটদের উপযোগী ‘তিন গোয়েন্দা’ সিরিজটি। এ সিরিজের তিনটি মূল চরিত্র কিশোর, মুসা, রবিনকে নিয়ে লিখেছেন আরও দুটি সিরিজ-‘তিন বন্ধু’ ও ‘গোয়েন্দা কিশোর-মুসা-রবিন’। এ ছাড়া লিখেছেন কিশোরদের উপযোগী কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ ‘খুদে গোয়েন্দা’। জাফর চৌধুরীর ছদ্মনামে ‘রোমহর্ষক’ সিরিজ, ‘আবু সাঈদ’ ছদ্মনামে ‘গোয়েন্দা রাজু’ সিরিজ এবং কিশোরদের উপযোগী বেশ কিছু ভূতের বই ও সায়েন্স ফিকশন। ১৫ অক্টোবর ২০২৫ প্রায় ৭৫ বছর বয়সে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান এই গুণী লেখক। আপাদমস্তক সোজাসাপটা এ মানুষটি বছরের পর বছর পাঠকের মনের ভিতর বসবাস করছেন ভালোবাসার মানুষ হয়ে। থাকবেন চিরকাল।
অনেক দিন ধরেই লেখালেখির সঙ্গে আছেন, আপনার কাজ আপনাকে কতটুকু তুষ্ট করেছে?
-তুষ্টি না থাকলে কোনো কাজ নিয়মিত করা যায় না। সে হিসেবে নিজের কাজে কিছুটা তুষ্টি তো অবশ্যই ছিল। আবার বেশি তুষ্টি চলে এলে সৃজনশীলতা নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু আমার সন্তুষ্টিটা সে রকম ছিল না। আমি নতুন কিছু করার জন্য ভিতর থেকে সব সময়ই একটা তাগিদ অনুভব করেছি।
সেবা প্রকাশনী দিয়েই শুরু। সেবার সঙ্গে আপনার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। বেশ কয়েক বছর হলো সেবায় তেমন লিখতে দেখি না আপনাকে। কেন?
-ইচ্ছা থাকলেও সেবায় ইদানীং তেমন লেখা হয়ে উঠছে না, এটা ঠিক। কারণ, অন্য জায়গায় ব্যস্ততা। তবে সেবার কথা যখন উঠলই, এখানে একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। আমার লেখালেখির শুরুর দিকের সাপোর্টের জন্য আমি সেবার প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের কাছে বিশেষভাবে ঋণী।
রকিব হাসান ছাড়াও ছদ্মনামে লিখেছেন অনেক। আবার রকিব হাসান নাম নিয়েও ক্যামেরার সামনে আসতে চান না। ছবি ছাপতে নিষেধ করেন। কেন?
-বিষয়টি একেবারেই আমার নিজস্ব ধ্যানধারণার। ইচ্ছা করেই আমি কারও সামনে লেখক হিসেবে নিজের পরিচয়টা তুলে ধরি না। কারণ, আমার বিশ্বাস লেখককে চিনে ফেললে তাঁর লেখা সম্পর্কে পাঠকের আগ্রহে ভাটা পড়ে। বিষয়টি আমি আমার নিজেকে দিয়েই উপলব্ধি করেছি। আমি যখন লেখালেখি ঠিক শুরু করিনি, তখন থেকেই প্রচুর বই পড়তাম। দেশিবিদেশি সব ধরনের বই পড়তাম। লেখালেখি শুরু করার পর বই পড়ার তাগিদটা আরও বেড়ে গেল। বিদেশি লেখকদের বই পড়ে আমি মনে মনে তাদের চেহারা কল্পনা করতাম। একসময় ওই লেখকদের চেহারা যখন আমার সামনে এলো আশ্চর্যজনকভাবে তাদের প্রতি আমার আকর্ষণটা অনেক কমে গেল। তাই নিজের বই প্রকাশের সময় ছবি না ছাপার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
বিখ্যাত হতে কে না চায়? সেলেব্রিটি তকমা লাগানোর জন্য কত কী করে। অথচ তিন গোয়েন্দার মতো জনপ্রিয় সিরিজের লেখক হয়েও আপনি আড়ালে থাকতে চান!
-আড়ালে থাকার চেয়ে আমি বলব নিজেকে প্রকাশ না করা। আসলে নিজেকে প্রকাশ না করার মধ্যেও একটা আনন্দ আছে। সেই আনন্দটা সেলেব্রিটিদের চেয়ে কম নয়। কারণ, সেলেব্রিটিদের সবাই চিনে ফেলে বলে তাদের কোনো ব্যক্তিগত জীবন থাকে না। কিন্তু আমি ক্যামেরার সামনে না এসেও নিজের জনপ্রিয়তা অনুভব করি কেবল নামে। আমাকে কেউ চেনে না, এটা আমাকে স্বাধীনতা দিয়েছে। এখনো যখন প্রথম কেউ জানে যে আমি রকিব হাসান, তখন সে বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ থেমে আমাকে বলে, ‘আপনার লেখা বই কত্তো পড়েছি!’ আমি তো বলব সেলেব্রিটি হওয়ার চেয়ে বেশি আনন্দ এখানেই পেয়েছি। এ আনন্দটিই সবচেয়ে বেশি উপভোগ করি। এর বাইরে খ্যাতির বিড়ম্বনা পোহানো অথবা স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হওয়ার মতো খ্যাতি কখনই চাইনি আমি। আর এখন এ বয়সে এসে আর কী চাওয়ার থাকতে পারে?
বাংলা অনুবাদ ও গোয়েন্দা সাহিত্যের একজন মহিরুহ আপনি। সাহিত্য নিয়ে ভাবনা অথবা আমাদের সাহিত্যের গন্তব্য কোথায়?
-আসলে আমি এত বড় কিছু নই। সাহিত্যের সাধারণ একজন কর্মী মাত্র। কাজ করার চেষ্টা করছি। আর অনুবাদ বা সর্বোপরি সাহিত্য নিয়ে কম-বেশি ভাবনা সব লেখকেরই আছে। তবে সেই ভাবনার গন্তব্য আবার নিরূপণ করে সময়। সময় এগিয়ে যাচ্ছে। জনপ্রিয় ধারার লেখক হুমায়ূন আহমেদ চলে গেছেন। এর প্রভাব অবশ্যই পড়েছে সাহিত্যাঙ্গনে। কিন্তু আমার বিশ্বাস, সর্বোপরি খুব দ্রুতই পট পরিবর্তন করবে বাংলা সাহিত্য। আর এ ঐশ্বর্যের জ্যোতি বিশ্বময় ছড়াবে আমার প্রত্যাশা এমনই।
অনুবাদ প্রসঙ্গ। সাহিত্যে এর গুরুত্ব কতখানি হওয়া উচিত?
-বিশ্বসাহিত্যে অনুবাদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য উল্লেখ করার মতো। আমাদের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য যেমন বেশি বেশি বিদেশি বই অনুবাদ করা দরকার, তেমনই বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার জন্য বাংলা থেকে বেশি বেশি ইংরেজি অনুবাদ দরকার। কিন্তু হতাশার কারণ হলো, আমাদের দেশে খুব বেশি ভালো অনুবাদ লেখক নেই। অনেকেই চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ ভালোও করছেন। কিন্তু সাহিত্যে বিশ্বমান বজায় রাখার জন্য আমাদের অনেক দক্ষ অনুবাদক প্রয়োজন।
চারদিকে তারুণ্যের জয়জয়কার। জীবনের অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়ার পর আজকের তরুণদের নিয়ে আপনার উপলব্ধি কী?
-প্রায় সব ক্ষেত্রে তরুণরা অতীতের সবকিছুকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে, এটি এককথায় অসাধারণ।
নতুন লেখকদের প্রসঙ্গে কিছু বলুন।
-দিন পাল্টেছে। এখন লেখালেখির সুরটাও বদলে গেছে। প্রচুর নতুন লেখক তৈরি হচ্ছে। এ প্রজš§ই আগামী দিনের কান্ডারি হবে। পড়ার অভ্যাসটা ধরে রাখতে হবে। আর সেই সঙ্গে লেখালেখির বৈশ্বিক সুরটা ভিতরে ধারণ করতে হবে। তাহলেই তরুণরা এগিয়ে যেতে পারবে।
তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে ভবিষ্যতের কোনো পরিকল্পনা বা ভাবনা?
-তিন গোয়েন্দা কিশোর, মুসা, রবিনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক দুই যুগেরও বেশি। তাদের নিয়ে নানারকম পরিকল্পনা করতে আমি ভালোবাসি। পেপারব্যাকে অনেক তো লিখলাম ‘তিন গোয়েন্দা’ সিরিজ। তাই এখন আবার নতুন প্রজন্মের পাঠকদের জন্য ‘গোয়েন্দা কিশোর-মুসা-রবিন’ শিরোনামে লিখছি। হার্ড বাউন্ডে সাদা কাগজে প্রকাশিত হচ্ছে এ সিরিজের বইগুলো। একাধিক প্রকাশনী থেকে বেরোচ্ছে বইগুলো। এ কাজগুলো দিয়েই পাঠকের কাছাকাছি থাকতে চাইছি। বাকিটা বলে দেবে সময়।