শনিবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

জাগতিক ক্ষতি ও তার প্রতিকার

মুফতি আমজাদ হোসাইন

জাগতিক ক্ষতি ও তার প্রতিকার

জাগতিক মোহ জাহান্নামের পথ সুগম করে। আর ‘জুহদ’ তথা ইমানি হালতে আল্লাহকে রাজি-খুশি করার জন্য দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি সৃষ্টি ও জান্নাতের পথ সুগম করে। ‘জুহদ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ অনাসক্তি, নির্লিপ্ততা, অনুরাগ শব্দের বিপরীত শব্দকে ‘জুহদ’ বলা হয়। যে ব্যক্তি জুহদ গ্রহণ করে তাকে জাহিদ বলে। অর্থ নিরাসক্ত, নির্লোভ ব্যক্তি। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘এবং তারা তার ব্যাপারে নিরাসক্ত ও নির্লোভ ছিল।’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত ২০)। পরিভাষায় ‘জুহদ’ বলা হয় আকর্ষণীয় কোনো কিছু ছেড়ে অন্য কিছু অবলম্বন করা। মৌলিকভাবে জাগতিক মোহের বস্তু পরিত্যাগ করে পরকালমুখী হওয়াই একজন মুমিন-মুসলমানের কাজ। এ ব্যক্তিকেই জাহিদ বলে। একজন জাহিদের কাছে ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার চাকচিক্য ও মোহ অর্জন মুখ্য বিবেচ্য বিষয় নয়, জাগতিক কোনো কিছু লাভে তার আনন্দ বা হাতছাড়া হওয়ার কিছু নেই। এক কথায় দীনি কাজে হারানোর কিছু নেই। সে তো সর্বদা পরকালের ফিকির-ধ্যানে নিমগ্ন ও নিমজ্জিত থাকে। তার দৃষ্টিতে পরকালই শ্রেষ্ঠ ও স্থায়ী সম্পদ। দুনিয়া মাকড়সার জালের মতো বা কচুপাতার পানির মতো। মাকড়সার জাল বা কচুপাতার পানি স্থায়ীভাবে থাকে না, বরং তা একেবারেই ক্ষণস্থায়ী। দুনিয়ার কোনো ব্যক্তির কাছে স্থায়ীভাবে থাকে না। একদিন ধ্বংস ও বিলীন হয়ে যাবে। দুনিয়ার অসারতা সম্পর্কে কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘এই পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক ছাড়া আর কিছুই নয়। পরকালের গৃহই প্রকৃত জীবন, যদি তারা জানত।’ উল্লিখিত আয়াতে ‘হায়াত’ শব্দ সম্পর্কে আল্লামা কুরতুবি (রহ.) বলেন, হায়াতের অর্থ হলো জীবন, অর্থাৎ দুনিয়ার জীবন। দুনিয়ার জীবনকে ক্রীড়া-কৌতুকের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। উদ্দেশ্য এই যে, ক্রীড়া-কৌতুকের যেমন কোনো স্থায়িত্ব নেই তা একেবারেই ক্ষণিকের জন্য। আর ক্ষণিকের বস্তু দ্বারা কোনো স্থায়ী সমাধান করা যায় না। বরং তা কিছুক্ষণের মধ্যেই খতম হয়ে যায়। অন্য আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছা রুজি প্রশস্ত করেন এবং সংকুচিত করেন। কিন্তু এরা পার্থিব জীবনে উল্লসিত, অথচ দুনিয়ার জীবন তো আখিরাতের তুলনায় ক্ষণস্থায়ী ভোগমাত্র।’ (সুরা রাদ, আয়াত ২৬)। দুনিয়ার অসারতা বর্ণনা করেছে অসংখ্য-অগণিত হাদিস। যেমন এক হাদিসে এসেছে, হজরত জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, একদা নবী করিম (সা.) বাজার দিয়ে যাচ্ছিলেন, চারপাশে লোকজন। তখন একটি কানকাটা মৃত বকরির বাচ্চার কাছ দিয়ে অতিক্রম করলেন। নবীজি সেই মৃত বকরির বাচ্চার কান ধরে জিজ্ঞাস করলেন, তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে যে একে এক দিরহামের বিনিময়ে নিতে পছন্দ করবে? তারা (সাহাবা) বললেন, আমরা তো এটা কোনো কিছুর বিনিময়েই নিতে পছন্দ করব না। আর এটা নিয়েই বা কী করব। তিনি বললেন, তোমরা কি এটা বিনিময় ছাড়াই নিতে চাও? তখন তারা বললেন, আল্লাহর কসম, এটা জীবিত হলেও আমরা নিতাম না। কারণ তার মাঝে খুঁত রয়েছে। আর এখন তো এটার এক কান কাটা আবার মৃত! তখন তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! এটা তোমাদের কাছে যতটুকু নিকৃষ্ট, আল্লাহর কাছে দুনিয়া এবং দুনিয়ার সম্পদ তার চেয়ে অধিক নিকৃষ্ট। (মুসলিম)। অন্য হাদিসে এসেছে, হজরত সাহল ইবনে সা’দ (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি নবী করিম (সা.)-এর খিদমতে এসে বললেন, ইয়া রসুলুল্লাহ! আমাকে এমন একটি কাজের (আমল) কথা বলুন যা করলে আল্লাহ আমাকে ভালোবাসবেন এবং মানুষও ভালোবাসবে। তিনি বললেন, দুনিয়া ত্যাগ কর, আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন। আর মানুষের কাছে যা আছে তার লালসা করো না, তবেই লোকেরা তোমাকে ভালোবাসবে। (তিরমিজি ও ইবনে মাজাহ)। আম্বিয়ায়ে কিরাম, সাহাবায়ে কিরাম, তাবেয়িন, তাবেতাবেয়িন, আকাবিরে উলামা ও পীর-আউলিয়ারা দুনিয়াবিরাগী ছিলেন। দুনিয়ার প্রতি তাদের আসক্তি ছিল না। তাই তো তারা এক আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে পেরেছিলেন। তারা জানেন দুনিয়ার মোহ নেশাদার বস্তু থেকে আরও অধিক নিকৃষ্ট বা ভয়াবহ। মাতাল লোক সাধারণত একসময় জ্ঞান ফিরে পায়। কিন্তু দুনিয়ার মোহে মাতাল ব্যক্তি কবরের অন্ধকারে যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত জ্ঞান ফিরে পায় না। তাই তো বিশ্ববরেণ্য কবি আল্লামা শেখ সাদি (রহ.) বলেন, ‘তুমি সারাক্ষণ বল এই বাগান আমার, এই বাড়ি আমার, কিন্তু এই কথা তো কখনো বল না যে এই কবর আমার।’ এই অস্থায়ী দুনিয়ার প্রতি অধিক মোহব্বতই সব পাপের মূল। তার কারণ এক. দুনিয়ার প্রতি মোহব্বত মানুষের কাছে দুনিয়াকে বড় করে তোলে। অথচ এই দুনিয়া আল্লাহর কাছে বড়ই নিকৃষ্ট। আর আল্লাহর কাছে অতি নিকৃষ্ট বস্তুকে অতি মূল্যবান মনে করা বড় গোনাহর অন্তর্ভুক্ত। দুই. অপ্রয়োজনীয় দুনিয়ার মোহ আল্লাহর কাছে অতি অপছন্দনীয়। আল্লাহর কাছে অপছন্দীয় কোনো বস্তুকে পছন্দ করা আল্লাহর বিরাগভাজন হওয়ার নামান্তর। তিন. দুনিয়ার ভালোবাসা একজন ব্যক্তিকে পরকালের চিন্তা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। যার কারণে পরকালের অতি গুরুত্বপূর্ণ আমল দুনিয়াদারের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। যেমন— মসজিদে যখন নামাজের জন্য আজান দেওয়া হয়, তখন দুনিয়াবি সব কাজকর্ম ছেড়ে নামাজের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা প্রতিটি মুসলমানের ওপর অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। কিন্তু অনেক দুনিয়াদারকে দেখা যায় আজান কানে আসার পরও সে আপন কাজে ব্যস্ত থাকে। নামাজের জন্য, সফলতার জন্য তাকে যে আহ্বান করা হচ্ছে এদিকে তার একেবারেই ভ্রূক্ষেপ নেই। চার. দুনিয়ার প্রতি আকর্ষণ ব্যক্তিকে দুনিয়ার কাজের প্রতি অতি ব্যস্ত করে তোলে। সারাক্ষণ তার মন-মস্তিষ্কে দুনিয়ার বিষয়াদি ঘুরপাক খেতে থাকে। জাগতিক এই ক্ষতি থেকে বাঁচার উপায় হলো পরকালমুখী হওয়া।  এক আল্লাহর ওপর শত পার্সেন্ট ইয়াকিন ও বিশ্বাস করে একজন ব্যক্তি যখন বেশি করে নেক আমল করতে থাকে। তখন আল্লাহ তার জন্য দুনিয়া ও পরকাল উভয়টি সহজ থেকে সহজতর করে দেন।

লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও খতিব, বারিধারা, ঢাকা-১২১২।

সর্বশেষ খবর