বুধবার, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

সুন্দরবনের নতুন ইতিহাস

মুস্তাফা জামান আব্বাসী

সুন্দরবনের নতুন ইতিহাস

লবণ না হলে আমরা বাঁচি না। আবার লবণ বেশি হলে সে খাবার খাওয়া যায় না। সুন্দরবন যদি লবণ দিয়ে ভর্তি হয় তা হলে সে সুন্দরবন আর সুন্দর রইবে না। তারঃস্বরে চিৎকার করলেও আমাদের কথা কারও কাছে পৌঁছবে না, কারণ পৃথিবীর মধ্যে মিষ্টি পানির সবচেয়ে বড় বনটি লবণাক্ততা গ্রাস করে নিচ্ছে। বিশ্বে আমাদের একটাই পরিচয় : তা হলো আমাদের সুন্দরবন। আর সেই বনের বাঘ আমাদের ক্রিকেট দল। আমাদের জার্সি কেউ খেয়ে ফেলছে, এটা সহ্য হবে না।

আজকাল একটা সুবিধা হচ্ছে যে কোনো বড় সভায় না গিয়েও সেই সভার খবর বাড়ি থেকেই ভিডিওতে পাওয়া যাচ্ছে। কলকাতা রামকৃষ্ণ মিশনে বসেছে বিশ্বব্যাংকের সভা। সে সভায় আলোচনা হচ্ছে সুন্দরবন নিয়ে। কারণ, ঢাকায় হলে তো মারামারি শুরু হবে। তাই বিশ্বব্যাংক বেছে নিয়েছে এই জায়গাটি। ১৭টি গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপনা করা হয়েছে। সেগুলো রাতের মধ্যেই আমরা পেয়ে গেলাম, এমনি আমাদের অগ্রগতি। কিন্তু যারা রাজ্যের নিয়ামক তারা সেগুলো পড়বেন না। এখানেই আমাদের জীবনের ঘনীভূত দুর্যোগ। সুস্মিতা দাসগুপ্তকে আগে কখনো দেখিনি। তিনি বিশ্বব্যাংকের পরিবেশ অর্থনীতি বিভাগের প্রধান। তিনি ব্যাপারটি পুরো স্টাডি করেছেন। এ রকম গবেষণা আমি আগে কখনো পড়িনি। ২০৫০ সালে যে লবণাক্ততা গ্রাস করবে তার সঙ্গে তুলনা করেছেন ২০১২ সালের উপকূলীয় এলাকার লবণাক্ততা। মিষ্টি পানির পরিমাণ এমনি কমে এসেছে ফারাক্কার প্রভাবে, সে কথা তিনি বলেননি। বাংলাদেশের উপকূলে এখন আছে ৪১ শতাংশ মিষ্টি পানি। ২০৫০-এ তা হবে ১৭ শতাংশ। এটি সহজ হিসাব।

মাছ পালিয়ে যাবে, যে পানিতে মিষ্টত্ব নেই, সেখানে মাছ থাকে না। গবেষক গোলাম মোস্তফা সেটি তুলে ধরেছেন। লবণাক্ততা সামান্য বাড়লে খুলনায় যে মাছগুলো আমরা বাজারে কিনি এবং ঢাকায় সরাসরি পেয়ে যাই নিউমার্কেটের বাজারে, সেগুলো আর পাওয়া যাবে না। আমি প্রতি সপ্তাহে এগুলোর খোঁজে বাজারের থলে নিয়ে বের হই। ২০৫০ পর্যন্ত আমি বাঁচব না। কিন্তু আমার ছেলেমেয়েরাও মাছগুলো পাবে না। এগুলোর ছবি আমাদের পাঠ্যপুস্তকে শোভা পাবে। মাছগুলোর নাম হচ্ছে : পারশে, দাঁতিনা, টেংরা, ভেটকি ও পোয়া মাছ। বাঙালির বাঙালিত্ব আর রইল কোথায়? শুধু বড় বড় বক্তৃতায়। আমি এই মাছগুলোর না পাওয়ার দুঃখে প্রায় কাঁদতে বসেছি। গোলাম মোস্তফাকে ধন্যবাদ দিচ্ছি তার এই প্রবন্ধের জন্য।

কৃষিতে এর কি প্রভাব হবে তা জানার জন্য গিয়েছিলাম আইনুন নিশাতের কাছে। তিনি আমাদের সবচেয়ে সম্মানিত পরিবেশ বৈজ্ঞানিক। তার কাছে এক বক্তৃতায় শুনেছিলাম যে আমাদের খাবার দাবারের তালিকায় অনেক কিছুই বাদ পড়ে যাবে। এ প্রবন্ধটি আমার কাছে আছে। যেটি সর্বসাধারণের মধ্যে প্রচলিত হওয়া বিশেষ প্রয়োজনীয়। গবেষণার ফলাফল যে সব সময় শতকরা ১০০ ভাগ সত্যি হবে তা নয়। কিন্তু আমরা বাঙালিরা বেঁচে থাকতে আমাদের খাবার কেড়ে নেবে তা কি করে হয়? ফলাফল তুলে ধরতে গিয়ে জহিরুল হক খান যা বলেছেন, তা অনেক সংবাদপত্রে ছাপা হবে না। ওটি বন্ধ করে দেওয়া হবে। কিন্তু আমরা তো পেয়ে গেলাম। ২০৫০ সালে বরগুনা, ভোলা, ঝালকাঠি, খুলনা, পটুয়াখালী জেলাতে যে সেচের কর্মসূচি বর্তমানে চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে তা হবে পরিত্যক্ত লবণাক্ততার কারণে।

বিশ্বব্যাংক আমাদের শত্রু নয়। তাদের পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ইশতিয়াক সোবহান আমার পরিচিত। তিনি বললেন এমন কথা যা শুনে আমার মন খারাপ হয়ে গেল। বললেন, সুন্দরী গাছ আর পাবেন না। কারণ এত লবণাক্ত পানিতে সুন্দরী গাছ হয় না। শুধু তাই নয়, সেখানে আসবে নতুন গাছ, যেমন গেওয়া, কেওড়া ও গরান। এরা লবণাক্ত পানিতে বেড়ে যায়। সুন্দরী গাছ হবে সুন্দরবন ছাড়া। সাধারণ মানুষরা আছে শুধু পলিটিকস নিয়ে, কীভাবে অন্য পার্টিকে ঘায়েল করা যায় কথা দিয়ে, লাঠি দিয়ে, আর সমস্ত পত্রিকা হাত করে নিজের ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করে। কিন্তু আল্লাহ আছেন। আল্লাহর বিচারে ওরা ভীষণভাবে অপমানিত হবে বলে আমার ধারণা। ভারত এত দিনে বুঝতে পেরেছে যে ফারাক্কা বাঁধ তাদের কোনো উপকারে আসেনি, বরং ক্ষতি হয়েছে। পশ্চিমবাংলার ক্ষতি হয়েছে। সে দেশটি আমারও। এই বোধটি খুবই প্রয়োজনীয়। পশ্চিমবাংলার প্রতিটি লোক আমার আত্মার আত্মীয়। তাদের কোনো ক্ষতি আমারই ক্ষতি। সুন্দরবনের ক্ষতি তাদেরও ক্ষতি। তাই সম্মেলনটি হলো কলকাতায়। এর বৃত্তান্ত ঢাকার কোনো কাগজে বের হবে না। কারণ কাগজগুলো ওদের পক্ষে।

কর্মশালায় বিভিন্ন বক্তব্যের সারবস্তু পাবেন আইনুন নিশাতের কাছে। তিনি অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। সত্যি কথা বলতে অভ্যস্ত। তিনি কখনো কারও মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেন না। ভারতের সুন্দরবনে বাস করে ৭৫ ভাগ লোক। আর বাংলাদেশের সুন্দরবনে জনবসতি নেই। বলাই বাহুল্য, বাংলাদেশের ক্ষতি হয়ে যাওয়ার অনেক পরে ওখানেও এর প্রভাব পড়বে। আমাদের একই মৃত্তিকা, আমাদের একই ধরিত্রী, ওরা আমরা আলাদা নই। আমাদের আলাদা করা হয়েছে। প্রতি পরিকল্পনায় তাই আইনুন নিশাতের কাছে যেতে হবে। আমরা শুনব বিশ্বব্যাংকের পরিবেশ বিভাগের প্রধানের কাছে। তিনি দুই বাংলার ভালোবাসার মানুষ, তার নাম ডাক্তার লিয়া কেরোল সিগার্ড। এদের কথা উপেক্ষা করবেন না। তা হলে দেশের ক্ষতি হবে। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে জাহাজ চলাচল অনেকের কাছে বেশ ভালো মনে হলেও আসল খবরটি পৌঁছে দিয়েছেন জয়দেব গুপ্তা, যিনি আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা থার্ড পোলের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান। জয়া বলছেন, সার, কয়লা ও তেল নিয়ে সুন্দরবনের ভিতরে চারটি জাহাজ ডুবি হয়েছে। এতে সর্বনাশ হয়েছে অঞ্চলটির। আমাদের কোনো অভিভাবক নেই, তাই এই দুর্ঘটনা। যদি মঙ্গল চাই তা হলে অমঙ্গলের ঘণ্টা বাজাবেন না।  আমরা এ নিয়ে রাস্তায় নামিনি। শুধু জানাতে চাই, দেশটি কারও ব্যক্তিগত সম্পদ নয়, ব্যবসার কথা ভুলে যান, মানুষের কথা ভাবুন।

লেখক : সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর