বৃহস্পতিবার, ১০ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

গৃহকর্মী নির্যাতন

তসলিমা নাসরিন

গৃহকর্মী নির্যাতন

পুরনো ঢাকার দরিদ্র দরজি বিশ্বজিৎ দাসের হত্যাকাণ্ডের একটি ভিডিও দেখলাম। নিরপরাধ নিরীহ ছেলেটি বাঁচার জন্য কী আপ্রাণ চেষ্টাই না করছিল। আর যেভাবে উন্মাদের মতো ওকে মারা হচ্ছিল, কোপানো হচ্ছিল— রড দিয়ে, চাপাতি দিয়ে, দেখে আঁতকে উঠেছি। যারা ওকে নির্যাতন করেছে, হত্যা করেছে, — ওদের মধ্যে কেউ কিন্তু মেয়ে ছিল না। সবাই পুরুষ। দেখেছি রাস্তায় পড়ে আছে প্রগতিশীল প্রতিভাবান যুবক অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান, অনন্ত বিজয় দাস, রাজিব হায়দার। কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে ওদের। দেখেছি নিলয়, জুলহাসের রক্তাক্ত শরীর। ওদের হত্যাকারীরা সকলেই পুরুষ। প্রতিদিন যারা মানুষকে নির্যাতন করছে, ধর্ষণ করছে, হত্যা করছে, তারা প্রায় সবাই পুরুষ। সারা পৃথিবীতে যুদ্ধ লেগেই আছে, মানুষের দিকে গ্রেনেড ছুড়ছে, গুলি ছুড়ছে, বোমা ছুড়ছে, তীর ছুড়ছে, সব পুরুষ। ঘরে ঘরে অত্যাচার চলছে, স্ত্রীকে মারছে স্বামী, গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে। রাস্তাঘাটে কারও পেটে ছুরি মারছে, কারও বুকে গুলি করছে, পকেটমারকে পিটিয়ে মেরে ফেলছে কারা? পুরুষ। আমরা জানি ক্রাইম যত হয়, তত ক্রাইমের রিপোর্ট হয় না। পুলিশের খাতায় ২০০২ থেকে ২০১৫ সাল অবধি ক্রাইমের সংখ্যাটা একবার একটু দেখি—

ডাকাতি ১০৭৩৮টি। দস্যুতা ১৫৮৯৫। খুন ৫৫৮২৫। দাঙ্গা ৫৩১৫। অপহরণ ১১৮৮৭। নারী নির্যাতন ২৪৩৩৭৩। পুলিশি নির্যাতন ৬৬৪১। ঘরে ঢুকে চুরি ৪৭১৩৩। চুরি ১২৩২৫৪। অন্যান্য অপরাধ ১১৫৬৭৮৬। অস্ত্র হাতে অপরাধ ২২৫৬৮৭। বোমাবাজি ৬১৪৮। মাদক অপরাধ ৩৪১১৭৭। স্মাগলিং ৮১৫৩৫। মোট অপরাধ সংখ্যা— ২১৫৭২৫৬।

এত যে লক্ষ লক্ষ অপরাধ, এগুলো করেছে কে? পুরুষ না নারী? উত্তর কিন্তু আমরা সবাই জানি। হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া সবই করেছে পুরুষ। কিন্তু গৃহকর্ত্রীরা যখন গৃহকর্মীকে নির্যাতন করেন, আমরা আঁতকে উঠি। আমরা পুরুষের বর্বরতা দেখে অভ্যস্ত, আমরা নারীর বর্বরতা তত দেখিনি বলে বিস্মিত হই!

গত পাঁচ বছরে ১৭০ জন গৃহকর্মীকে নির্যাতন করে মেরে ফেলা হয়েছে। আহত করা হয়েছে ১৬৫ জনকে। মোট নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে প্রায় ৩৫০টি। দেশজুড়ে গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা নিশ্চয়ই আরও অনেক ঘটেছে। কিন্তু কাগজে সেগুলো লেখা নেই। শুনেছি কিছু ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। আদুরী নামের এক গৃহকর্মীকে নির্যাতন করার কারণে গৃহকর্ত্রী নওরীনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়ে গেছে। আরও একটি ভালো খবর শুনলাম, গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনায় তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকারের গঠিত ‘গৃহকর্মী বিষয়ক কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেল’। এই সেলের পক্ষ থেকে নির্যাতিতকে সাহায্য তো করা হচ্ছেই, নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে। শিশুশ্রম বন্ধ করার উদ্যোগও শুনেছি সরকার নিয়েছে। গৃহকর্মীদের শুধু যে গৃহকর্ত্রীরাই নির্যাতন করেন, তা নয়। গৃহকর্তারাও করেন। গৃহকর্মীরা হামেশাই ধর্ষণের শিকার হন। যারা বদ গৃহকর্তা, তাঁরা এই অমানবিক কাজটি করে আসছেন আদিকাল থেকেই। গৃহকর্ত্রীদের গৃহকর্মী নির্যাতন নতুন ঘটছে। কেন গৃহকর্ত্রীরা হঠাৎ এত বর্বর হয়ে উঠল! এক সময় গৃহকর্তার স্ত্রীও গৃহকর্মী হিসেবে গৃহে বাস করতো। তাদের কখনো গৃহকর্ত্রী হতে দেওয়া হয়নি। সংসারের কোনও ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার তাদের কোনও অধিকার বা স্বাধীনতা ছিল না। গ্রামেগঞ্জে বা শহরের নিম্ন-মধ্যবিত্তের ঘরে যে গরিব মেয়েরা কাজ করে, তাদের সঙ্গে বাড়ির স্ত্রীটির এক ধরনের সখ্য গড়ে উঠতো। দুজনে সুখ দুঃখের গল্প করতো। দুজনের অসহায়ত্বের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য ছিল না। দুজনই দাসী। গৃহকর্তা দুজনেরই কর্তা। এই চিত্রটি হাওয়া হয়ে যায়নি, এখনো বহাল তবিয়তে আছে। কিন্তু পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি শহুরে মধ্যবিত্তের ঘরে। মধ্যবিত্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। মধ্যবিত্ত মেয়েরাও ইস্কুল কলেজ পাস করছে। বিয়ের পর তাদের এখন গৃহকর্ত্রী আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। ঘরকন্নার তদারকি এখন মেয়েদের হাতে। তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারে সংসারের ছোটখাটো অনেক ব্যাপারেই। লেখাপড়া জানার, হাতে ডিগ্রি থাকার, গৃহকর্ত্রী হওয়ার, সংসারের ক্ষমতা হাতে পাওয়ার একটা অহংকার এসে ভর করে মেয়েদের ওপর। তখন তারা সেই আচরণটি করে, যে আচরণ ক্ষমতাবানরা করে, ধনীরা করে। তারা গরিবকে নির্যাতন করে। অশান্তির সংসারে দিনের পর দিন কাটাতে থাকলে মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে থাকে, তখন গৃহকর্মীদের পান থেকে চুন খসলেই শাস্তি দেয় তারা। অশান্তির ক্ষতিপূরণ। যে স্ত্রী মার খায় স্বামীর, সে স্ত্রীই মার দেয় অন্যকে। নিজের চেয়ে দুর্বল, নিজের চেয়ে ক্ষমতাহীন জগতে কেউ যদি থেকে থাকে, সে দাসী। নাগালের মধ্যে আছে বলেই তার ওপর গৃহকর্ত্রী নির্যাতন চালায়, এতে নিজের ক্ষমতা প্রকাশিত হয়, পুষে রাখা ক্রোধও কিছুটা প্রশমিত হয়।

মেয়েরা বর্বরতা জানে না এটা ভাবা খুবই ভুল। মেয়েরা সুযোগ পেলে নিষ্ঠুর, বর্বর, খুনি সবই হতে পারে। এসব না জানলেও পুরুষের কাছ থেকে বর্বরতা এর মধ্যে শিখে নিয়েছে মেয়েরা। এক সমাজে এক ঘরে পুরুষের সঙ্গে জীবনভর বাস করছে, আর পুরুষ যা করে, তার কিছুই করতে শিখবে না তারা, এ কেমন কথা? মেয়েরা এখন পুরুষ যা করতে পারে, তার প্রায় সবই করতে পারে। পুরুষের মতো ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে পারে, বৈমানিক, বিজ্ঞানী, প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট— সব হতে পারে। এত সব পারে বলেই পুরুষের মতো নির্মমও হতে পারে। আগুনে পুড়িয়ে দিতে পারে গৃহকর্মীদের।

পুরুষেরা ৯৯টি অন্যায় করলে, আর নারী ১টি অন্যায় করলেও মানুষ নারীর দিকে আঙ্গুল তুলে গালাগালি করে। সব নারী গৃহকর্মীদের অত্যাচার করে না। কেউ কেউ করে। যারা করে, তাদের শাস্তি হচ্ছে, শাস্তি হবে। বর্বরতায় পুরুষের সঙ্গে নারীর তুলনা হাস্যকর। পুরুষ এ ব্যাপারে মাস্টার। নারী নিতান্তই শিশু। সমাজকে সুস্থ করতে চাইলে পুরুষকে বর্বরতা আর নিষ্ঠুরতা ত্যাগ করতে হবে। পরিবারে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সংসারে শান্তি থাকলে গৃহকর্ত্রী প্রফুল্ল থাকে, গৃহকর্ত্রী প্রফুল্ল থাকলে গৃহকর্মীও প্রফুল্ল থাকে। এই পৃথিবী এখনো পুরুষের পৃথিবী। এই পৃথিবীতে আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাস করি। গৃহকর্মী, গৃহকর্ত্রী কেউই নিরাপদে নেই। আমরা মেয়েরা যত বড় লেখক সাংবাদিক হই না কেন, যত বড় ব্যবসা-বাণিজ্য করি না কেন, যত বড় ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হই না কেন, কেউই নিরাপদে নেই।

      লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর