বৃহস্পতিবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষাব্যবস্থা দুর্নীতির আঁতুড়ঘর

তুষার কনা খোন্দকার

দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষাব্যবস্থা দুর্নীতির আঁতুড়ঘর

ইবনে খলদুন তাঁর আল মুকাদ্দিমা বইয়ে বলেছেন, শিক্ষকও একজন মানুষ। সমাজের আর ১০ জন মানুষের মতো শিক্ষকের ব্যক্তিগত জীবনে বেঁচে থাকার উপকরণের প্রয়োজন আছে। কাজেই, সমাজের উচিত শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে মেনে নেওয়া। শিক্ষাদান করার পরিশ্রমের বিনিময়ে একজন শিক্ষকের পারিশ্রমিক নেওয়ার অধিকার আছে। খলদুনের জমানায় শিক্ষকতা জনসেবার অংশ ছিল। শিক্ষকদের ভরণ-পোষণ রাজা কিংবা রাজ্যের ধনী প্রজাদের দান-দক্ষিণার ওপর নির্ভর করত। খলদুনের জমানা অনেক আগে পার হয়ে গেছে। বর্তমান জমানায় শিক্ষকতা একটি স্বীকৃত পেশা। পেশাদারি মনোভাব থেকে শিক্ষক বেতন-ভাতা বাড়ানো কিংবা এমপিওভুক্তির জন্য মিছিল-মিটিং-অনশন করেন। এটি করা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। এতে দোষের কিছু নেই। আমাদের দেশে শিক্ষকতা পেশায় যারা নিয়োজিত, বিশেষত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ছোট বাচ্চাদের যারা পড়ান তাদের বেতন-ভাতা যথেষ্ট কিনা তা সরকারের দেখা উচিত। কারণ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক এ দুটি পর্বে পড়ানো বেশ খাটুনির কাজ। বাচ্চা পড়ানোর মতো পরিশ্রমসাধ্য কাজ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকরা অনেক বেতন পান তা বলব না, তবে তাদের বেতন-ভাতা এখন চলনসই পর্যায়ে। বর্তমানে শিক্ষকরা যা বেতন-ভাতা পান তা দিয়ে তাদের সংসার চলে কি চলে না তা আপেক্ষিক বিষয়। সংসার চলা এবং না চলা বিষয়টি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর অনেকখানি নির্ভর করে। স্বল্প আয়ের মানুষের সংসার অল্প টাকায় চলে। আবার বেশুমার আয়ের মানুষের সংসারে খরচের অন্ত নেই। আমি শিক্ষকদের বেতন-ভাতা নিয়ে বিচার-বিশ্লে­ষণ করতে যাব না। শিক্ষকদের বেতন-ভাতা কম হলে তারা আন্দোলন করে বাড়িয়ে নিতে পারেন সেটি তাদের বিষয়। আমার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু শিক্ষকদের পেশাদারিত্বের মান নিয়ে। আমাদের দেশের শিক্ষকরা বেতন-ভাতা বাড়ানোর আন্দোলন করার ক্ষেত্রে পেশাদারিত্বের পরিচয় দিলেও স্কুল-কলেজে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের ক্ষেত্রে তারা ভয়ানক অপেশাদারি। বর্তমান দুনিয়ায় শিক্ষকতা যে একটি পেশা সে কথা আমাদের দেশের শিক্ষকরা কোনোক্রমেই মনে রাখতে পারেন না। তারা স্কুল-কলেজের শ্রেণিকক্ষে হাজির থাকার জন্য বেতন-ভাতা নিতে উম্মু খ, তবে শ্রেণিকক্ষে ছাত্রছাত্রীদের পড়াতে রাজি নন। এ দেশের শিক্ষকসমাজ অনেক বছর ধরে শিক্ষকতাকে যেনতেন উপায়ে টাকা কামাইয়ের সুবর্ণ সুযোগ বলে বিশ্বাস করে আসছেন। শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে দেখলে তারা নিজ পেশাকে সম্মান করতেন। তারা জানতেন পেশাদারিত্ব শব্দটি আজকের দিনে অত্যন্ত সম্মানের বিষয়। যে সমাজের মানুষ যত বেশি পেশাদারি মনোভাব নিয়ে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে সেই সমাজ তত দ্রুত সামনে এগিয়ে যায়। বেশ কয়েক দশক ধরে আমাদের শিক্ষকরা শিক্ষকতার বিষয়ে চরম অপেশাদারি মনোভাবের পরিচয় দিচ্ছেন। শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের ক্লাসে কিছু পড়াতে নারাজ। অভিভাবকদের শিক্ষকদের ব্যক্তিগত ঠিকানায় যোগাযোগ করে সন্তানের জন্য নগদ টাকা খরচ করে বিদ্যা কিনে আনতে হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আর বিদ্যাপীঠ বলে সম্মানিত করার সুযোগ নেই। বলা যায় মাস্টারদের টাকা কামাই করার মতলবে ওগুলো ছাত্র ধরার ফাঁদ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের স্কুল-কলেজের ক্লাসরুমে কী পড়ানো হয় তা আমরা কেউ জানি না। শুধু জানি, অমুক স্যারের কোচিং ক্লাস তমুক স্যারের কোচিং ক্লাস। অমুক স্যারের কাছে কোচিং করলে ছাত্রের ভাগ্যে এ প্লøাস অবধারিত। অথচ ক্লাসে পড়ানোর জন্য শিক্ষকরা নিয়মিত বেতন-ভাতা পান। কিন্তু ক্লাসে তারা কিছু না পড়িয়ে সব বিদ্যা কোচিং ক্লাসে নিয়ে গিয়ে কেন ঢেলে দেন, সে কথার জবাব আমরা সবাই জানি। দেশের বেশির ভাগ শিক্ষক যে উপায়ে টাকা বানাতে ব্যস্ত তাকে চৌর্যবৃত্তি, ছিনতাই কিংবা রাহাজানির সঙ্গে তুলনা করা চলে। কিন্তু দুর্ভাগা জাত আমরা। সবাই সবকিছু জানে কিন্তু প্রতিকার করার কেউ নেই।

শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্যের শুরুর জমানা নিয়ে আমার ঝুলিতে একটি অভিজ্ঞতা আছে। আজকের এই সুযোগে সেই অভিজ্ঞতার কথা আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করার মওকা আমি হাতছাড়া করতে চাই না। গত শতকের আশির দশকে ঢাকায় কোচিং বাণিজ্যের রমরমা শুরু হলো। ঢাকার স্কুল-কলেজে মাস্টারি নিতে পারলে টাকার ওপর গড়াগড়ি খাওয়া যাবে এ খবর গ্রামের স্কুলগুলোয় চাউর হতে সময় লাগল না। শহরের স্কুলে কোচিং বাণিজ্যের রমরমার খবর পেয়ে গ্রামের স্কুলের মাস্টাররা জমিজমা বেচে নগদ টাকার বিনিময়ে শহরের স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির লোকজনকে ম্যানেজ করে চাকরি বাগিয়ে ফেলতে শুরু করলেন। তেমন একজন বিএসসি মাস্টার আমার চেনা-জানার তালিকায় ছিলেন। উনি গ্রামের স্কুল ছেড়ে ঢাকার একটা চলনসই স্কুলে চাকরি নিয়ে খুব অল্প সময়ে কোচিং বাণিজ্যে পসার জমিয়ে ফেলেছিলেন। প্রথম দিকে তিনি কোচিং ক্লাসে নিজে ছাত্রছাত্রীদের পড়াতেন। পরে ফিজিক্সের মাস্টার হিসেবে তার ব্র্যান্ড চালু হয়ে গেলে তিনি বিকালে নিজের রুমে শুয়ে ভিসিআরে গরম মসলা জাতীয় হিন্দি ফিল্ম দেখতেন আর কোচিং ক্লাসে তার লেকচারের টেপ বাজানো হতো। এটা অনেকটা গুলিস্তানে ওষুধ বেচার কায়দা। আধুনিক ওষুধ বিক্রেতারা কষ্ট করে ওষুধের গুণাগুণ বয়ান করা বন্ধ করে দিয়েছিল। ওষুধ বেচার বক্তৃতা তারা টেপরেকর্ডারে রেকর্ড করে রেখে দিত। ওষুধ বিক্রির সময় রেকর্ড বাজালে তাতে খুঁজলি-পাঁচড়া-দাদ শব্দগুলো বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এক লোক লাঠির মাথা দিয়ে নির্দিষ্ট কৌটার গায়ে টোকা মেরে কোন রোগে কোন ওষুধ তা দেখিয়ে দিত। আমার জানা ফিজিক্স মাস্টারও গুলিস্তানের হকারের কেতায় তার কোচিং ক্লাস চালাতেন। ফিজিক্স মাস্টারের ক্লাস লেকচারের রেকর্ড কোচিং ক্লাসে যখন বাজানো হতো তখন তার বেতনভুক সহকারী কাঠির মাথা ব্লøাকবোর্ডে লেখার গায়ে ছুঁয়ে ছাত্রদের বিদ্যা পোক্ত করে দিত। এভাবে লোকটার সৌভাগ্যের সূর্য যখন মধ্যগগনে গনগন করে জ্বলছে সে সময় কী এক অসুখে তাকে কাবু করে ফেলল। সামাজিক দায়িত্ব পালনের খাতিরে আমি তাকে হাসপাতালে দেখতে গেলাম। লোকটির কথাবার্তা শুনে মনে হলো অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আসা তার জন্য এক দারুণ সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এমন নামিদামি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে লোকটার প্রতিদিন কত খরচ হচ্ছে সবাইকে সে সম্পর্কে বিস্তারিত বলার আনন্দে সে তখন মাতোয়ারা। এরপর বলল, ঢাকায় আসার পরে সে বাজার করে বড় আনন্দ পাচ্ছে। গ্রামের বাজারে জিনিসপত্রের দারুণ আকাল। ওখানে মনে চাইলেই ১০টা হাঁস কিংবা ১০০ কই মাছ একবারে কিনতে পাওয়া যায় না। ঢাকার বাজারে মাছ-মাংসের অঢেল সাপ্ল­াই আছে বলে সে মনের সাধ মিটিয়ে মাছ-মাংস কিনতে পারছে। সেদিন, যতক্ষণ আমি হাসপাতালে রোগাক্রান্ত বিএসসি মাস্টারের শয্যাপাশে বসা ছিলাম ততক্ষণ সে তার টাকার গল্পে মশগুল হয়ে ছিল। লোকটির গল্প শুনে আমার মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য কালকেতু উপাখ্যানের কথা মনে পড়ল। কাহিনীর নায়ক সাধারণ শিকারি কালকেতু দেবীর বর পেয়ে যখন রাজা হয়ে গেল তখন সে হাতির পিঠে চড়ে বাজারে গিয়ে এক মণ চিঁড়া আর এক মণ গুড় কিনে নিয়ে এলো। মাস্টার সাহেব কোচিং বাণিজ্য করে অনেক টাকার মালিক হয়ে অনেক হাঁস অনেক কই মাছ কিনলেন সে কথা তার নিজ বয়ানে জানতে পারলাম। সব শুনে আমার মনে একটি প্রশ্ন খচখচ করে বিঁধছিল যার জবাব আমি কার কাছে পাব ভেবে পাচ্ছিলাম না। আমি ভাবছিলাম, কোচিং বাণিজ্য করে মাস্টার ধনী হলো, তাকে আর গরিব স্কুলমাস্টার বলে কেউ হেলা করতে পারবে না। কিন্তু দিনের শেষে ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যা-শিক্ষা-নীতি-নৈতিকতার অবস্থা কী দাঁড়াল? আমার দেখা সেই মাস্টার অনেক আগে দামি হাসপাতালের ব্যয়বহুল কেবিনে শুয়ে মারা গেছেন। আমার প্রশ্নের জবাব আজও দেশের নীতিনির্ধারকদের কাছে পেয়েছি এমন দাবি করতে পারি না। তবে সমাজে নীতি-আদর্শের দুর্দশা দেখে বুঝি নগদ টাকায় কেনা বিদ্যার বিষবৃক্ষ দিনে দিনে মহিরুহ হয়ে তাতে ভয়ানক বিষফল ফলেছে। আমার দেখা বিএসসি মাস্টার এবং তার সমগোত্রীয় শিক্ষকরা যেসব ছাত্রের কাছে নগদ টাকায় বিদ্যা বিক্রি করেছিল সেই ছাত্রদের অনেকে এখন স্কুল-কলেজে মাস্টারি করে। ছাত্রজীবনে তারা যে মাস্টারের কাছে কোচিং ক্লাস করে সার্টিফিকেট পেয়েছে সেই মাস্টারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে মাস্টারি পেশায় এসে এরাও নিশ্চয়ই কোচিং বাণিজ্যে যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। যেসব ছাত্র মাস্টারি পেশার বাইরে অন্যান্য পেশায় ব্যস্ত তাদের নৈতিকতার মানও মাশা আল্লাহ শিক্ষকদের সঙ্গে বেশ মিলে যাচ্ছে। দুর্নীতির রাক্ষস দেশটাকে কীভাবে গিলে খেয়েছে তা এ দেশের মানুষ প্রতিনিয়ত হাড়ে-হাড্ডিতে টের পায়। ছাত্রজীবনে বিদ্যা কেনার পেছনে যার যত টাকা খরচ হয়েছে পেশাজীবনে এসে সে হিসাব বহুগুণে উশুল করার বাইরে তারা আর কিছু ভাবতে পারে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় আমাদের দেশ এখন পৃথিবীর অংশ নয়। দুর্নীতির দুষ্ট বলয়ে ঘেরা এটি মূর্তিমান শনিগ্রহ। শনির বলয়ের প্রাথমিক চক্র নিয়ে কথা হলো, রয়ে গেল আরও অনেক চক্র যা গুনে শেষ করা কঠিন। দুর্নীতির সব চক্র আমরা এক দিনে ভাঙতে পারব না এ কথা সত্য। তবে সরকার আন্তরিক হলে শিশুদের শিক্ষকদের দুর্নীতির হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব। দেশে বিদ্যা বেচাকেনার দুষ্ট চক্র একদিন ভাঙবে আমরা অনেক বছর ধরে সেই প্রতীক্ষায় আছি। দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে কোচিংয়ের বন্দীদশা থেকে শিশুদের উদ্ধার করতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযানে এটি হোক প্রথম পদক্ষেপ।

            লেখক : কথাসাহিত্যিক

সর্বশেষ খবর