শিরোনাম
মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

অফিস আদালতে বঙ্গবন্ধুর ছবি

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

অফিস আদালতে বঙ্গবন্ধুর ছবি

১০ মহররম আশুরা মুসলিম জাহানের সবচেয়ে চরম বেদনাবিধুর দিন। ফোরাতের তীরে রসুল (সা.)-এর দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রা.)-এর ছিন্নমস্তক বর্শার ডগায় লাগিয়ে সিমার যখন দামেস্কে ইয়াজিদের কাছে নিয়ে গিয়েছিল তার তখন অনেক কিছু পাওয়ার লোভ ছিল। কিন্তু সে কিছুই পায়নি। মুয়াবিয়া-পুত্র ইয়াজিদের আশা পূর্ণ হয়নি। অন্যদিকে ভারতের স্বাধীনতা বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর ক্লাইভের হাতে তুলে দিয়েছিল। মিরন, মোহাম্মদী বেগ সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করেছিল। তারা কেউ বাঁচেনি। কেউ মরেছে কুষ্ঠ রোগে, কেউ মরেছে বজ্রপাতে। ’৭৫-এ যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল তাদের কারও ভবিষ্যৎ ভালো হয়নি। জীবনে শান্তি ও স্বস্তি আসেনি। সত্য সত্যই। ন্যায়-সত্যকে পদদলিত করে অস্বীকার করে কেউ কোনো দিন পার পায়নি, ভবিষ্যতেও পাবে না। ইমাম হোসাইনরা চিরকাল আল্লাহর প্রিয়, প্রিয়ই থাকবে। মহান এই দিনে, এই গভীর শোকের দিনে মুসলিম জাহানের স্বস্তি, সুস্থিতি ও হারানো গৌরব ফিরে পাওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি। করুণাময় পরম দয়াময় আল্লাহ ইমাম পরিবারের কল্যাণ করুন।

২৬ আগস্ট প্রেস ক্লাবে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের শোকসভা ছিল। ড. কামাল হোসেন, আ স ম আবদুর রব, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, আবুল হাসান চৌধুরী কায়সার অংশ নিয়েছিলেন। ব্যাপক সমাগম ছিল শোকসভায়। আমি বলেছি, জাতীয় এক ঐতিহাসিক পরিবর্তনের প্রত্যাশায় ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ যোগ দিয়েছিল। কিন্তু আস্তে আস্তে জোটের মূল নেতৃত্ব ড. কামাল হোসেন ও অন্যান্য জাতীয় নেতার হাত থেকে বিএনপির হাতে চলে গিয়েছিল। আর সেই বিএনপির নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব ছিল ইংল্যান্ডে বসবাসরত তারেক রহমানের হাতে। নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্টের যেখানে মনোনয়ন দেওয়ার কথা সেখানে শেষ পর্যন্ত বিএনপির কাছ থেকে ঐক্যফ্রন্টের অন্যান্য শরিক দলকে মনোনয়ন ভিক্ষা করতে হয়েছিল। এ ছিল খুবই দুর্ভাগ্যজনক! এমনকি ২৪-২৫ জন জামায়াত নেতাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল; তেমন হওয়ার কথা ছিল না। মনোনয়ন নিয়ে অনেক কেলেঙ্কারি হয়েছে। নির্বাচন বর্জন করে পরে বিএনপির ছয় ও গণফোরামের দুজনের সংসদে যাওয়া দেশবাসীর সঙ্গে চরম প্রতারণা। তাই সবকিছু বিবেচনা করে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করেছে। তবে ড. কামাল হোসেনকে প্রত্যাখান করেনি, তার বিশ্বাসের অমর্যাদা করেনি, তার প্রতি শ্রদ্ধা প্রত্যাহার করেনি। সেই সভায় এক পর্যায়ে বলেছিলাম, আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে তারেক রহমানকে নেতা বানাতে রাজনীতি করি না, করব না। কেউ কেউ বলছেন, এ কথাটা না বললেই নাকি ভালো করতাম। কিন্তু এটা যে সত্য কথা। বেগম খালেদা জিয়াকে দেশনেত্রী মানি। কিন্তু শেখ হাসিনার পরিবর্তে তারেক রহমান কল্পনাতেও নেই। একজন রাজনৈতিক নেতার চোখ-কান খোলা থাকার কথা, প্রসারিত উদার দৃষ্টিভঙ্গি থাকার কথা।

তার কথাবার্তা চাল-চলনে লন্ডন থেকে দলকে নিয়ন্ত্রণ দেখে তেমন মনে হয় না। তিনি নিশ্চয়ই বিএনপির নেতা হতে পারেন এবং একচ্ছত্র নেতা হতে পারেন সেখানে আমাদের বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। আমাদের আপত্তি দেশের নেতা হতে হলে মানুষের নেতা হতে হলে শুধু বিএনপি থেকে আরও একটু ওপরে উঠতে হবে; তা তারেক রহমান এখনো পারেননি।

দীপ-কুঁড়ি গ্রিনহেরাল্ড থেকে বেরিয়েছে। কুশি এখন সেখানে পড়ে। গত বৃহস্পতিবার অ্যাসেম্বলি ক্লাস করতে গিয়ে রোদের তাপে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল। আমি ছিলাম টাঙ্গাইলে। খবর পেয়ে খুবই বিচলিত হয়ে তখনই চলে আসতে চেয়েছিলাম। পরদিন আমাদের নেতা আতোয়ারের দোয়া মাহফিল ও শোকসভা ছিল। তাই ঠিক করেছিলাম দোয়া ও শোকসভা শেষে পরদিন চলে আসব। কিন্তু অ্যাডভোকেট রফিক হঠাৎই জানায় রবিবার কোর্টে কাজ আছে। সেই কাজ সেরে প্রতিদিনের লেখাটা তৈরি করে পরদিন সোমবার ঢাকা ফিরব। মেয়ের জন্য মনে অবশ্যই একটা চাপ ছিল। তার চাইতে বেশি গরম ছিল দুই দিন। সোমবার লেখালেখির যে পরিকল্পনা ছিল তা কাজে লাগাতে পারিনি। ঘুম থেকে উঠতে পারছিলাম না, বিছানার পাশে বাথরুমে যেতে পারছিলাম না। কী করে সোমবার সারা দিন গেছে বুঝতে পারিনি। সহকর্মী ফরিদ বার বার টাঙ্গাইল সদর হাসপাতালে যেতে বলছিল। আমি হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা জানি। গা করিনি। টাঙ্গাইলের ভালো ডাক্তারদের প্রায় সবাই এসেছিলেন। রক্ত পরীক্ষা করে সোডিয়ামের মাত্রা কিছুটা কম পেয়েছিলেন। গত ২০ বছর বেশ কয়েকবার ইলেকট্রোরাল ইনব্যালান্স হয়েছে; যাতে ফ্লোরে পা ফেলতেও শরীর সাড়া দেয়নি। মঙ্গলবার সকালেই বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩১১ ভিভিআইপি কেবিনে আমার জায়গা হয়েছে। এখন এখানে কিছু নেই। আগে প্রাণ গোপাল ভিসি ছিলেন, তারপর কামরুল, এখন কনককান্তি বড়ুয়া। ভিআইপি কেবিনের যে দশা দেখলে করুণা হবে। লোকজন আছে, কিন্তু কেউ কাজ করে না। তবে ডাক্তার, নার্স অসাধারণ। কি অবাক কান্ড! অনেকদিন পর আমরা দুই ভাই এক ছাদের নিচে। আমি ১১-তে, বড় ভাই ১২-তে। ভাবতে অবাক লাগে যে লতিফ সিদ্দিকীরা না জন্মালে বঙ্গবন্ধু হতেন না, বঙ্গবন্ধু না হলে বাংলাদেশ হতো না, আমি কাদের সিদ্দিকী হতাম না, ওদিকে বড় বড় বীর জিয়াউর রহমান, সফিউল্লাহ, খালেদ মোশাররফ, শাফায়াত জামিল কোনো যোদ্ধার জন্ম হতো না, অস্তিত্ব থাকত না। দুদকের ডাইরেক্টররা ঘুষ খান, ধরা পড়ে জেলে যান। তারা একটা মামলা দিয়েছেন লতিফ সিদ্দিকীর নামে। যার কোনো অস্তিত্ব নেই। দেশের জন্য অবদান কেউ মনে রাখে না। সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মণি, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, কে এম ওবায়দুর রহমান, খালেদ মোহাম্মদ আলী, নীলফামারীর রউফ কেন যেন কারও কোনো নাম নেই। যাদের হওয়ার কথা ছিল সম্মানিত নাগরিক তারা অবহেলিত, কোথাও কোথাও নিন্দিত। তোফায়েল আহমেদ, আমীর হোসেন আমু আওয়ামী লীগে আছেন। কোনো কোনো সময় বিবেকবর্জিত কথাবার্তাও বলেন, ভালো লাগে না। ধীরে ধীরে সব মূল্যবোধ কেমন যেন ম্রিয়মাণ হয়ে যাচ্ছে, অস্তিত্বহীন হয়ে যাচ্ছে। গত ১৬ ডিসেম্বর নির্বাচন উপলক্ষে আতোয়ারকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। আতোয়ার একজন প্রবীণ বীর মুক্তিযোদ্ধা। দুই হাতে হ্যান্ডকাফ লাগিয়েছিল। হ্যান্ডকাফ লাগানোর বিধিবিধান এক আসামি হলে আসামির হাতে এক হ্যান্ডকাফ, পুলিশের হাতে আরেক হ্যান্ডকাফ। কোনো মানুষের দুই হাতে একসঙ্গে হ্যান্ডকাফÑ এটা আইনবিরোধী। তবু তা-ই করা হয়েছে। সেই মানুষটার মৃত্যুতে পুলিশ যখন সম্মানি সালাম জানায়, অন্তিম সম্মান জানায়, আমার খুব ঘৃণা লেগেছে। লতিফ সিদ্দিকীর ব্যাপারটাও তাই। যেভাবে মামলা দেওয়া হয়েছে, যেখানে মামলাই হয় না সেখানে বিচারক তার জামিনই মঞ্জুর করেননি! আজ চার-পাঁচ মাস হাই কোর্টে। প্রথম কারণ দর্শানোর নোটিস, সে নোটিসের পর প্রায় দুই মাস। কখনো ছুটি কখনো অন্য কিছু। মামলাটি কোর্টে ওঠে না। এ এক নাগরিক অধিকার খর্ব। ভালো আছি দুই ভাই পাশাপাশি। জানি না শেষ শয্যা কোথায় হবে। তবে আমি আমার শেষ শয্যা গ্রামের বাড়ি ছাতিহাটিতে মা-বাবার পায়ের কাছে স্থির করে রেখেছি। জন্মের পর নাড়ি কেটে যে জুমাঘরের পাশে পুঁতেছিল সেখানেই আমার কবর হবে। তাতে পুলিশ বিদায়ী সালাম দিতে পারবে না, দক্ষিণ প্লাজায় জানাজা পড়া যাবে না- এ অভিপ্রায় সরকারকে আগেই জানিয়েছি, সংসদকে জানিয়েছি।

কেন যেন ধীরে ধীরে আমাদের সব সুকোমল প্রবৃত্তি এবং অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে চলেছে। আমরা এখন আর অনেক কিছুতেই আকার-বিকার করি না। যে বাঙালি জাতি একসময় ছিল হৃদয়বৃত্তিতে বিশ্বসেরা, সেই বাঙালি কেমন যেন ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েছে। আসল-নকলের পার্থক্য নেই, সত্য-মিথ্যার বিচার নেই। যেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হবেন সবার, সেখানে তিনি আজও বিতর্কিত। কেন যেন মীমাংসিত কিছু নেই। সব নিয়ে টানাটানি। সত্য বললেই যত সব মুশকিল। এবার শোকের মাস আগস্টে যে রংবেরং দেখলাম বড় দুর্ভাবনায় আছি।

’৭৫-এর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত আমাদের কোনো শোক ছিল না। বরং পরম আনন্দ। তবে কেন এখন ১ আগস্ট থেকেই মাতম করতে গিয়ে দানবনৃত্য করি? কত বললাম কেউ শুনল না, কেউ বুঝতে চাইল না। কাজ করানো কামলাকেও মজুরি দিতে হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর দুর্ভাগ্য, রাতদিন তার ৭ মার্চের ভাষণ বাজানো হয়, কারও কোনো আকার-বিকার নেই। কারও কবরে ৭ মার্চের ভাষণ বাজানো কতটা যুক্তিযুক্ত কাউকে বোঝাতে পারলাম না। ২৮ আগস্ট টাঙ্গাইল শহীদস্মৃতি পৌর উদ্যানে যুবলীগের কোনো অনুষ্ঠান ছিল। শুরু ১১টায়, শেষ হয়েছিল আড়াই-৩টায়। লোকসংখ্যা ছিল ৩৬১ জন সেটাও আবার খাওয়ার সময়। সকাল ৭টায় প্রথম বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনলাম। শেষ হতে আবার, তারপর আবার। এক নাগাড়ে তিনবার। তারপর ‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই’ আবার ৭ মার্চের ভাষণ। প্রায় সাড়ে ৯টা পর্যন্ত না হলেও ২০ বার ভাষণটি বাজানো হয়েছিল। কেন যেন মনে হচ্ছিল, হায়রে কপাল! জাতির পিতার মরেও শান্তি নেই। তারই শোকের দিনে তারই মর্যাদাময় ইউনেস্কোর স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ৭ মার্চের ভাষণ লোক সংগ্রহ করতে বার বার বাজানো হচ্ছে। বলার কেউ নেই। লুঙ্গি পরেই পৌর উদ্যানে গিয়ে মাইকম্যানকে বলেছিলাম, ওষুধ বিক্রির ক্যানভাসের মতো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাজিয়ে তোমাদের লোক সংগ্রহ করতে কে বলেছে? লোকটি আমতা আমতা করছিল। বলেছিলাম, আর একবার যদি এভাবে যখন তখন ৭ মার্চের ভাষণ বাজাও তোমার বিচার হবে। ৭ মার্চের ভাষণের কত মর্যাদা কেন যেন কেউ বুঝতে চায় না। এই তো আর কদিন পর বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী পালন করা হবে। এটা সারা দেশের সব মানুষের হলে কতই না ভালো হতো। কিন্তু তা হবে না, হবে গোষ্ঠী, পরিবার আর সরকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। যেটা আমাদের বড় বেশি হতাশ করে। সাজঘরে শিল্পীর তুলিতে আঁকা কোনো ছবি আমাদের নেতা নয়, টুঙ্গিপাড়ার শেখ লুৎফর রহমান আর সায়েরা খাতুনের সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের পিতা, আমাদের নেতা। কি দুর্ভাগ্য! ইদানীং সব অফিস-আদালতে বঙ্গবন্ধুর নকল ছবি। ওই ছবি তো আমাদের নেতার নয়, বঙ্গবন্ধুর নয়। আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধুর বাঁ গালে ছিল জ্বলজ্বলে উজ্জ্বল তিল; যা আমাদের মোহিত করত, উজ্জীবিত করত। আমাদের বঙ্গবন্ধু আমাদের পিতা আমাদের নেতা আর আজকের ছবির বঙ্গবন্ধু মোটেই এক নয়। কোটি কোটি সরকারি টাকা খরচ করে নকল ছবি ছেপে জাতিকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে; এর প্রতিকার কী? জাতির পিতাকে নিয়ে জাতির নেতাকে নিয়ে যা খুশি তা করা যায় না। আমার যেমন পরিচিতি চিহ্ন ডান হাতের অনামিকা ও মধ্যমায় ক্ষত, ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধুর পরিচিতি চিহ্ন তাঁর বাঁ গালে জ্বলজ্বলে উজ্জ্বল তিল। সেটা কোনো শিল্পীর পন্ডিতিতে ধুয়েমুছে সাফ করে দিলে কে তার বিচার করবে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দয়া করে কি একটু দেখবেন?

লেখক : রাজনীতিক।

www.ksjleague.com

সর্বশেষ খবর