বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

মনোজগৎকে বিকশিত করে গ্রন্থাগার

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

মনোজগৎকে বিকশিত করে গ্রন্থাগার

সম্প্রতি পশ্চিম বাংলার শহর বরানগরে অবস্থিত বনহুগলি লাইব্রেরির শতবর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে একজন অতিথি হয়ে গিয়েছিলাম কলকাতায়। সেখানে আমার প্রদত্ত বক্তব্যটিই এ লেখার মূল বিষয়বস্তু। অনুষ্ঠানটির অন্য বক্তা ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের সাবেক রাজ্যপাল ও এলাহাবাদ হাই কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি জাস্টিস শ্যামল কুমার সেন। অত্যন্ত জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব। সামাজিক, রাজনৈতিক ও আইনগত বিষয়ে তাঁর দখল অপরিসীম। ২৮ সেপ্টেম্বর আমার স্ত্রী নাফিসা বানু ও বন্ধু বিচারপতি রুহুল কুদ্দুসসহ কলকাতায় পৌঁছি রাত ৮টায়। পরদিন বরানগরের অনুষ্ঠানে যোগ দিই বিকাল ৫ টায়। অনুষ্ঠান শুরু হতে একটু বিলম্ব হয়। অনুষ্ঠানটির কলেবর খুব বড় না হলেও এর বিষয়বস্তু ছিল সময়োপযোগী। আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ‘গ্রন্থাগারই রেনেসাঁসের একমাত্র ধারক’। বাংলার রেনেসাঁকে জাগ্রত রাখতে বা পুনঃজাগ্রত করতে গ্রন্থাগার বা লাইব্রেরি যে একটি বাতিঘর হিসেবে কাজ করে এ সত্য সামনে রেখেই সেমিনারের বিষয়ের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য কিছু কথা ও আমার কিছু নিজ ভাবনা তুলে ধরি উত্তর কলকাতার এই সুধীসমাজের মিলনমেলায়। ফিরে যাই আমার সেদিনের বক্তব্যে।

লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগার কী, কীভাবে এর বিকাশ এবং বিশেষ করে এই উপমহাদেশে গ্রন্থাগারের প্রসার কী পথ পরিক্রমায় হয়েছে তা-ই তুলে ধরেছিলাম এই আলোচনায়। লাইব্রেরি হচ্ছে এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে বই, জার্নাল, পত্রপত্রিকাসহ গবেষক ও জ্ঞানপিপাসু পাঠকদের জন্য বিভিন্ন রকমের তথ্য সংরক্ষিত থাকে। লাইব্রেরি শব্দটির আদি শব্দ ‘Liber’. এটি একটি ল্যাটিন শব্দ যার অর্থ হলো বই। ‘Liber’ শব্দটির আরেকটি প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘Libraium’ যার অর্থ হচ্ছে বই সংরক্ষণের জায়গা। Anglo-French ভাষায় Librarie শব্দের অর্থ Collection of books বা বইয়ের সমাহার।

বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে পুরনো লাইব্রেরি হিসেবে মিসরের St. Catherine’s Monastery Library-কে গণ্য করা হয়। এ লাইব্রেরিটি অনুমান ৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত হয়েছিল। পুরনো পান্ডুলিপি সংরক্ষণের দিক থেকে ভ্যাটিকান লাইব্রেরির পরই এর অবস্থান। ভারতবর্ষের সবচেয়ে পুরনো লাইব্রেরি Saraswathi Mahal Library। এটি তামিলনাড়ুর তানজোরে অবস্থিত। ইতিহাসবিদরা একে এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে পুরনো লাইব্রেরি হিসেবে গণ্য করেন। এ লাইব্রেরিতে তালের পাতা ও পুরনো কাগজের ওপর তামিল ও সংস্কৃত ভাষায় লিখিত কিছু পান্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে। ভারতের আরও কিছু ভাষায় লিখিত পান্ডুলিপিও এ লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে বলে জানা যায়। গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত এসব উপকরণ ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিকাশের পরিক্রমা জানতে পথ দেখায়। মনোজগৎকে করে বিকশিত।

ভারতের সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি National Library of India কলকাতায় অবস্থিত। এখানে ২০ থেকে ২২ লাখ বই সংরক্ষিত আছে বলে জানা যায়। ১৮৩৬ সালে ‘ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরি’ হিসেবে এর যাত্রা। ১৯০৩ সালে এ লাইব্রেরির নামকরণ হয় ‘ইমপেরিয়াল লাইব্রেরি’। ১ ফেব্র“য়ারি, ১৯৫৩ থেকে লাইব্রেরিটি National Library of India নামে পরিচিতি লাভ করে। এটি ভারতের সব ভাষার গ্রন্থসম্ভারে সমৃদ্ধ একটি লাইব্রেরি।

লাইব্রেরি বা পাঠাগার মানব চেতনা ও মননকে সমৃদ্ধ করার এমন একটি উৎসঘর যেখানে বই, জার্নাল, পত্রপত্রিকা সংরক্ষিত থাকে জ্ঞানপিপাসু ও গবেষকদের জন্য। ইতিহাস-ঐতিহ্যের পথ ধরে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে অনন্য ভূমিকা রাখে লাইব্রেরি, যার উপকরণ কেবল বই এবং বই।

রেনেসাঁ বা নবজাগরণের মধ্য দিয়ে বিকশিত চেতনাকে মূর্ত করে তুলতে অবদান রেখেছে উভয় বাংলার শতবর্ষের পুরনো ঐতিহ্যবাহী গ্রন্থাগারগুলো। কুসংস্কারকে দূরে সরিয়ে যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদকে সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ধারণ করে সভ্যতা, মানুষের চিন্তা ও মননকে স্ফুরিত ও জাগ্রত করেছে এই নবজাগরণ। একমাত্র গ্রন্থে মুদ্রিত তথ্য, গবেষণা, জ্ঞান, যুক্তি এসবই এই জাগরণকে নব নবরূপে এগিয়ে নিয়েছে। এসব ধ্রুপদি বিদ্যা চর্চা মানুষের মনোজগতের ভাবনাচিন্তা ও যুক্তিকে বিশুদ্ধ হতে ও জেগে উঠতে প্রেরণা দেয়।

সামাজিক সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন যা বঙ্গীয় রেনেসাঁ হিসেবে গণ্য তা শুরু হয় রাজা রামমোহন রায়ের সময়। শেষে আসেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যাঁর সাহিত্য ও কবিতায় উদ্ভাসিত বিষয়গুলো সৃজনশীলতা এবং শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে ভিন্ন এক জাগরণের সূচনা করে। এসব আমাদের জানতে হবে। জানতে হবে কীভাবে রেনেসাঁর শক্তি সমাজ-সভ্যতা এবং মানবতাবাদী চিন্তা-মননকে প্রগতি ও সংস্কারের পথে নিয়ে যাচ্ছে। আর তা জানার জন্য ছুটতে হবে গ্রন্থাগারে এবং শুধু গ্রন্থাগারেই। তাই ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মোড়কে আচ্ছাদিত পুস্তকসম্ভারে সমৃদ্ধ হতে হবে গ্রন্থাগার বা লাইব্রেরিকে। কেবল তবেই পুস্তকের ভান্ডার এই লাইব্রেরিই হতে পারে রেনেসাঁ বা নবজাগরণের দৃঢ় ধারক ও পথিকৃৎ। দেশ ও সমাজকে করতে পারে প্রগতিমনা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সমৃদ্ধ। সাবেক আমলে রাজা, রাজ-পরিবারের সদস্য ও সম্ভ্রান্ত জনগোষ্ঠীই সাধারণত জানা ও শেখার জন্য লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগার ব্যবহার করতেন। সাধারণ মানুষ সেখানে তাদের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে পিছিয়ে ছিল। কিন্তু সময় ও সামাজিক বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এবং মুদ্রণযন্ত্র, কলম, কালি এবং কাগজের আবির্ভাব ও প্রসারের পথ ধরে একটা সময় সাধারণ মানুষেরও লাইব্রেরির সঙ্গে নৈকট্য সৃষ্টি হয়।

আমাদের বাংলাদেশেও পুরনো পান্ডুলিপি ও পুঁথি সংগ্রহের প্রবণতা দেখা যায়। এসব পান্ডুলিপি সাধারণত লেখা হয়েছে হয় তালের পাতায়, নয় গাছের ছালে অথবা চামড়া-জাতীয় কোনো বস্তুর ওপর। পুরাতন কালে অনেক সময় পোড়া মাটির থালার ওপরও লেখা হতো। এসব পান্ডুলিপি পুঁথি সাধারণত ধর্মীয় উপাসনালয়ে সংগৃহীত হতো। খ্রিস্টপূর্ব তিন দশকের কিছু পুরনো পান্ডুলিপি ও পুঁথি সম্প্রতি বাংলাদেশে পাওয়া গেছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মধ্যযুগে হোসাইন শাহি বংশধররা প্রথম রাজকীয় লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে মিশনারির লোকজন হুগলি জেলার শ্রীরামপুরে প্রথম একটি লাইব্রেরি স্থাপন করেন, যেখানে মুদ্রিত বই ও পান্ডুলিপি রাখা ছিল। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা ও বেনারসে হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় মিশনারিজদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে কলা ও বিজ্ঞাননির্ভর লাইব্রেরি স্থাপিত হয় ১৮০৫ সালে। একই বছর এশিয়াটিক সোসাইটি কলকাতায় আরেকটি লাইব্রেরি স্থাপন করে।

ব্যক্তিগত উদ্যোগে ১৮৫৪ সালে অবিভক্ত বাংলার পূর্ববঙ্গ বর্তমান বাংলাদেশে চারটি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয়। সেগুলো হলোÑ বগুড়া উডবার্ন লাইব্রেরি, রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি, যশোহর ইনস্টিটিউট লাইব্রেরি ও বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরি। ১৮৭১ সালে ঢাকায় স্থাপিত হয় রাজা রামমোহন রায় লাইব্রেরি, ১৮৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় নর্থব্র“ক হল লাইব্রেরি, ঢাকা; সিরাজগঞ্জ পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৮২ সালে, রাজশাহীর সাধারণ গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৮৪ সালে, কুমিল্লা বীরচন্দ্র গণগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৮৫ সালে। ১৮৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় অন্যদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি। ১৮৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় রাজশাহীর শাহ মখদুম পাবলিক লাইব্রেরি। ১৮৯০ থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত বিভিনসময়ে বর্তমান বাংলাদেশ তদানীন্তন পূর্ববঙ্গে যে লাইব্রেরিগুলো প্রতিষ্ঠিত হয় তা হলোÑ নোয়াখালী টাউন হল ও পাবলিক লাইব্রেরি (১৮৯৬), উমেশ চন্দ্র পাবলিক লাইব্রেরি (১৮৯৬), প্রাইজ মেমোরিয়াল লাইব্রেরি, সিলেট (১৮৯৭), ভিক্টোরিয়া পাবলিক লাইব্রেরি, নাটোর (১৯০১), চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটি পাবলিক লাইব্রেরি (১৯০৪), রামমোহন পাবলিক লাইব্রেরি (১৯০৬), হরেন্দ্রনাথ পাবলিক লাইব্রেরি (১৯০৮) প্রভৃতি।

প্রযুক্তিনির্ভর বর্তমান সামাজ জীবনের সঙ্গেও লাইব্রেরির এক সেতুবন্ধ রয়েছে। এখনো লাইব্রেরি বা পাঠাগার জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-সংস্কৃতি, ইতিহাস সংরক্ষণের এক জাদুঘর। পাঠাগার যেন মানবসমাজ ও সভ্যতার উত্থান-পতনের ছবিকেই প্রতিফলিত করে। এটি অন্তহীন জ্ঞান ও সভ্যতা বিকাশের আগার। বিবর্তিত মানবসভ্যতা ও জ্ঞান বিকাশের অক্ষয় সব কীর্তির প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাওয়া যায় কেবল গ্রন্থসম্ভারে। আর এই গ্রন্থসম্ভারে আলোকিত ঘরটিই গ্রন্থাগার বা লাইব্রেরি।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লাইব্রেরি সম্পর্কে বলেছেন, ‘লাইব্রেরির মধ্যে আমরা সহস্র পথের চৌমাথার উপরে দাঁড়াইয়া আছি। কোনো পথ অনন্ত সমুদ্রে গিয়াছে, কোনো পথ অনন্ত শিখরে উঠিয়াছে, কোনো পথ মানব হৃদয়ের অতল পর্শে নামিয়াছে। যে যেদিকে ইচ্ছা ধাবমান হও, কোথাও বাধা পাইবে না। মানুষ আপনার পরিত্রাণকে এতটুকু জায়গার মধ্যে বাঁধাইয়া রাখিয়াছে।’

’৭০-এর দশকের গোড়ার দিকে আমি যখন স্কুলের ছাত্র তখন দেখেছি আমাদের স্কুলে একটি ছোট লাইব্রেরি ছিল। তখনকার সময়ে প্রায় প্রতিটি স্কুল বা কলেজেই একটি করে লাইব্রেরি বা পাঠাগার থাকত। শিক্ষার্থীদের ওই পাঠাগার ব্যবহারের জন্য উৎসাহিত করা হতো। কোনো শিক্ষকের অনুপস্থিতির কারণে কোনো ক্লাস না হলে ক্লাসের ওই সময়টুকু ছাত্ররা সাধারণত পাঠাগারেই কাটাত। জানি না, এ চর্চা আজ রয়েছে কিনা।

আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে নীলক্ষেত নামক স্থানটি পুরনো বইয়ের ভান্ডার হিসেবে পরিচিত। মূল বইয়ের জেরক্স কপিও পাওয়া যায় এখানে। নীলক্ষেত থেকে সস্তায় বই সংগ্রহ করে অতীতে অনেক ছাত্রই নিজ বাড়িতে ছোটখাটো পাঠাগার গড়ে তুলত। কিন্তু এখন আর সেই প্রবণতা দেখা যায় না। ঢাকার একজন সাংবাদিক (একরাম কবির) তাঁর একটি লেখায় লিখেছেন, Working for a digital company, I roamed around the districts of Bangladesh and visited a few public libraries outside Dhaka. I was awed by the sheer collection of books in those libraries. These libraries are rich. However, there’s hardly a reader or a student or a reference-seeker sitting in those huge empty halls. আমার মনে হয় ডিজিটাইজেশনের কারণে ভৌতিক অবকাঠামোর লাইব্রেরি বা পাঠাগার এখন আর অনেকেই অপরিহার্য মনে করেন না। তাই এই সাংবাদিক বন্ধু লাইব্রেরি হলগুলোকে পাঠকশূন্য অবস্থায় দেখতে পেয়েছেন।

শুনেছি ঢাকার ব্রিটিশ কাউন্সিল সরকারের সঙ্গে একত্রিত হয়ে ‘ন্যাশনাল লাইব্রেরি ডে’ হিসেবে একটি দিবস পালনের উদ্যোগ নিয়েছে। উদ্দেশ্য, মানুষ যেন লাইব্রেরির প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে না ফেলে। এখন প্রশ্ন হলো, সাধারণ লাইব্রেরি বা পাঠাগারগুলো যদি ধীরে ধীরে পাঠকশূন্য হয়ে পড়ে তাহলে ন্যাশনাল লাইব্রেরি ডে পালন করে সত্যিই কি কিছু অর্জিত হবে? তার পরও আমরা এটি মনে করতেই পারি, সংস্কৃতির বিকাশের লক্ষ্যে গ্রন্থাগারের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টিতে এ ধরনের ‘জাতীয় লাইব্রেরি দিবস’ বা ‘ন্যাশনাল লাইব্রেরি ডে’ পালন করার প্রয়োজনীয়তা আছে বইকি।

আমার বিশ্বাস, এমনকি বর্তমান ডিজিটাইজেশনের যুগেও এখনো পুস্তকসম্ভারে সমৃদ্ধ লাইব্রেরি বা পাঠাগারের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পায়নি। আমাদের দেশে এখনো শতকরা ৫০ ভাগের বেশি মানুষের অবস্থান ইন্টারনেট প্রযুক্তির বাইরে। তাই মানুষ লাইব্রেরি নামের খেয়াঘাটে এখনো নিত্য নোঙর করে চলেছে তথ্য ও জ্ঞান আহরণের পিপাসায়। মনোজগতে বিশুদ্ধ চেতনা ধারণ করতে এখনো নিবিষ্ট হয় বইয়ের মুদ্রিত পাতায়। তাই পুস্তকসম্ভারে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারের মতো বাতিঘরের এখনো অনেক অনেক প্রয়োজন সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। সৃজনশীল ভাবনায় নিজেকে ও সমাজ-সংস্কৃতিকে আলোকিত করার জন্য।

গুটিকতক নির্ধারিত পাঠ্যবই পড়ে নম্বর পাওয়া যায়, একটা সার্টিফিকেট পাওয়া যায়। কিন্তু জ্ঞানের পরিধি কি কেবল এতেই বিস্তৃত হয়? না, হয় না। শেখা ও জানা একটি চলমান প্রক্রিয়া যার কোনো অন্ত নেই। নিজেকে যোগ্য করে সমাজে অবদান রাখতে, জ্ঞান-সমৃদ্ধ সৃজনশীল ধারণার মোড়কে চারপাশকে সাজাতে প্রয়োজন বই, বই শুধু বই। আর সেজন্যই সভ্যতা ও জ্ঞান বিকাশের সঙ্গে বইয়ের আগার লাইব্রেরির ভূমিকা অবিচ্ছেদ্য। সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের সঙ্গে সঙ্গে বৈশ্বিক সেতুবন্ধ তৈরি করতে পারে লাইব্রেরি।

দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে উপলব্ধি করেছি, কেবল বিধিবদ্ধ কিছু আইন জানাটাই যথেষ্ট নয়। নানা বিষয়ভিত্তিক বই হাতে নিতে হয়। সঠিক ও যৌক্তিক বিচারিক প্রতিকার প্রদান ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সঙ্গে বিবর্তিত এবং বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক, মানবিকতা, মানব মনস্তত্ত্ব, সৃজনশীলতাও গভীরভাবে সম্পর্কিত। একজন বিচারকের মনোজগতে এসব বিষয়ে অনুসন্ধিৎসা থাকতেই হবে। বিচারক হিসেবে বিশ্বাস করি, এসব বিষয়ে ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং বিবর্তিত ও প্রতিষ্ঠিত নীতি অনুসন্ধান অনিবার্য। এই দায়িত্ববোধের কারণে আমি নিজেও চেষ্টা করি নানা বিষয়ভিত্তিক বইয়ের আশ্রয় নিতে। রেনেসাঁ বা নবজাগরণের মধ্য দিয়ে বিবর্তিত ও বিকশিত সভ্যতা, সংস্কৃতি, মানবতা ও চেতনায় মূর্ত মানব মনস্তত্ত্ব আবিষ্কারে নিবিষ্ট হই। তাই শুধু নির্দিষ্ট কোনো বিধিবদ্ধ আইনের পুস্তক নয়, বরং নানা বিষয়ভিত্তিক পুস্তকসম্ভারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতেই হয় আমাদের।

কেবল তরুণ প্রজন্ম নয়, জ্ঞানসমৃদ্ধ সমাজ ও দেশ বিনির্মাণে সব পেশায় নিয়োজিতদের বইয়ের জগতে বিচরণটা অপরিহার্য। এর মাধ্যমে কেবল সভ্যতার পথে হাঁটা নয়, এই বিচরণ একই সঙ্গে দলমত-জাতি-ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে মানবসভ্যতাকে নিরাপদ রাখতে সহায়তা করে। এ কথা বলতে গিয়ে স্মরণ করছি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুলের একটি বিখ্যাত কবিতার কটি চরণ; যেখানে বিশ্বমানবতাবাদী দর্শন মূর্তভাবে উঠে এসেছে-

‘গাহি সাম্যের গান-

যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান

যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ, মুসলিম-ক্রিশ্চান।

গাহি সাম্যের গান!’

সমাজে সভ্যতা, মানবিকতা, সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় সাম্য অনিবার্য। এটি নিজ মনন ও চেতনায় ধারণ করতে বার বার ফিরে যেতে হবে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের অনিন্দ্য মানবিক সাহিত্যকর্মে। এজন্য প্রয়োজন তাঁদের অমর কীর্তির সংগ্রহশালাগুলোর সঙ্গে বন্ধন সৃষ্টি।

আমাদের দেশের মানুষের ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি অভিন্ন। আমরা সবাই চিন্তা-চেতনা ও মানবিকতায় একে অন্যের খুবই কাছাকাছি। আমরা বৈশ্বিকভাবে বাঙালি হিসেবেই পরিচিত। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী আমাদের সমাজ এর বন্ধন ও নৈকট্য অটুট রাখবে, আরও দৃঢ় করবে। গ্রন্থাগার কেবল জ্ঞানের উৎসঘর নয়, জাতি-ধর্মবর্ণ-ভাষা নির্বিশেষে তা মানুষে মানুষে বন্ধনও সৃষ্টি করে। সভ্যতার পথে এগিয়ে যেতে পথও দেখায়।

আমরা বাংলাদেশের বাঙালিরা ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাহসী ও দূরদর্শী নেতৃত্বে একটি অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছি। আর এই অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে আরও গভীর ও দৃঢ় করতে পাঠাগার বা লাইব্রেরির ভূমিকা অপরিসীম। সারা বিশ্বের মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় গ্রন্থাগার বা লাইব্রেরির ভূমিকা হবে উজ্জ্বল ও উচ্চকণ্ঠ। আমার বিশ্বাস, এই বাংলার প্রতিটি গ্রামে একদিন একটি করে গ্রন্থাগার পড়ে উঠবে এবং এ গ্রন্থাগার থেকে সংগৃহীত জ্ঞানের দ্যুতি দিয়েই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একদিন এ দেশকে সত্যিকারের সোনার বাংলায় পরিণত করতে পারবে।

                লেখক : বিচারপতি।

সর্বশেষ খবর