শনিবার, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গাদের পক্ষে রায় : অতঃপর?

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

রোহিঙ্গাদের পক্ষে রায় : অতঃপর?

গত ২৩ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক আদালত যে রায় দিয়েছে, তা আক্ষরিক অর্থেই উল্লাস করার মতো। বঙ্গবন্ধু বর্ষের শুরুর মাসে বাংলাদেশের জন্য এর চেয়ে বেশি গৌরবের কোনো উপহার হতে পারত না। এই অন্তর্বর্তীকালীন রায় বিশ্বমানবতার জয়, মানবাধিকারের জয়, জয় বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সার্থক কূটনীতির।

এ রায় বাংলাদেশের মানুষের মনে একদিকে যেমন স্বস্তি ও প্রশান্তি এনেছে, অন্যদিকে তেমন ছড়িয়ে দিয়েছে অগণিত প্রশ্ন যার ভিত্তি এ রায়ের অনিশ্চিত ভবিষ্যতে। অনেকের মনেই প্রশ্ন এ রায়ে আমরা কী পেলাম, রায়ের ভবিষ্যৎ কী ইত্যাদি।

একজন আশাবাদী হিসেবে আমার ধারণা ইতিবাচক। প্রথমত ২৩ তারিখের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ছিল এই মর্মে ঘোষণা যে, এ মামলাটি আইসিজেতে চলতে পারে। এ মামলাটি আইসিজেতে চলতে পারে না এ কথাটি বলার জন্যই স্বয়ং সু চি দ্রুততম গতিতে ছুটে চলে গিয়েছিলেন হেগে। তিনি সম্ভবত তার কৌঁসুলিদের কাছ থেকে এ মর্মে ভ্রান্ত উপদেশ পেয়েছিলেন যে মামলাটি চলতে পারে না।

আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞদের ধারণার প্রতিফলন ঘটিয়ে আইসিজে সু চির এ যুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছে। এ মামলা মূল শুনানিতে যেতে বেশ কয়েক বছর লাগবে বিধায় সেদিন যে চারটি অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশনা আইসিজে দিয়েছে সেগুলো বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ কেননা মূল শুনানি শেষে চূড়ান্ত আদেশ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের পাথেয় হচ্ছে এই অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশনাসমূহ। সৌভাগ্যবশত এ নির্দেশনাগুলো পূরণ হলে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার কিছু পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে কেননা এই চার নির্দেশনার অন্যতম হচ্ছে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ পরিস্থিতি সৃষ্টি করা। আইসিজে এ নির্দেশনা দিয়েছে মিয়ানমার যেন ১৯৮৪ সালের গণহত্যা কনভেনশন অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। এ ছাড়া এ ব্যাপারে মিয়ানমার কী কী পদক্ষেপ নিল নিয়মিত তা আইসিজেকে জানানো। আরও যে নির্দেশনা রয়েছে তা হলো, অচিরেই অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা এবং তথ্য-প্রমাণ যেন নষ্ট না হয়, তার নিশ্চয়তা। অনেকে মনে করছেন আইসিজে এই মর্মে রায় দিয়ে দিয়েছে যে, মিয়ানমারে গণহত্যা হয়েছে। এ ধারণা ভুল। যে আদেশগুলো দেওয়া হয়েছে সেগুলো অন্তর্বর্তীকালীন। মামলার চূড়ান্ত শুনানি শেষ হওয়ার আগে কোনো আদালতই মূল প্রশ্নের ব্যাপারে ঘোষণা, অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে গণহত্যা হয়েছে মর্মে ঘোষণা, দিতে পারে না। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে চূড়ান্ত শুনানির পর। আইসিজে আরও কটি অন্তর্বর্তী আদেশ দিতে পারত, কিন্তু দেয়নি যা গাম্বিয়া চেয়েছিল, যেমন মিয়ানমারে পর্যবেক্ষক পাঠানোর নির্দেশ। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশনা যা গাম্বিয়া চেয়েছিল কিন্তু আদালত দেয়নি তা হলো এই মর্মে আদেশ যে, মিয়ানমারে যেসব অপরাধ ঘটানো হয়েছে যথা- গণহত্যা, বিচারবহির্র্ভূত হত্যা, যৌন সহিংসতা এবং ঘরবাড়ি ধ্বংসকে জেনোসাইড কনভেনশনের অপরাধ হিসেবে গণ্য করে অন্তর্বর্তীকালীন ঘোষণা।

পর্যবেক্ষক নিয়োগের আদেশ দিলে সেটি খুবই ফলপ্রসূ হতো এ কারণে যে, মিয়ানমার আইসিজের আদেশমতো কাজ করছে কিনা, পর্যবেক্ষকরা তা নিশ্চিত করতে পারতেন। যা হোক, গাম্বিয়া প্রয়োজনে ভবিষ্যতে পর্যবেক্ষক নিয়োগের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন দরখাস্ত করতে পারবে, কেননা রায়ে আইসিজে বলেছে, মিয়ানমারকে পর্যায়ক্রমে রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে প্রতিবেদন দিতে হবে এবং গাম্বিয়া সে প্রতিবেদন পাওয়ার পর আইসিজের দ্বারস্থ হতে পারবে। তাই ভবিষ্যতে পর্যবেক্ষক পাঠানোর অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ চেয়ে আবেদনের পথ খোলা থাকবে। অনেকের মনে প্রশ্ন, মিয়ানমার আইসিজের রায় ও নির্দেশনা মানতে বাধ্য কিনা। আইসিজে হচ্ছে জাতিসংঘের ছয়টি অঙ্গের একটি। জাতিসংঘ সনদের ৯৪ অনুচ্ছেদে এই মর্মে পরিষ্কার নির্দেশনা রয়েছে যে, প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রই আইসিজের রায় এবং আদেশ মানতে বাধ্য। সুতরাং আইসিজের আদেশ অমান্য করা মানে শুধু আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করাই নয়, বরং জাতিসংঘের সনদ লঙ্ঘন করা। তবে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় আদালতসমূহ যেমন তাদের রায় পুলিশ এবং অন্যান্য কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে পারে, আন্তর্জাতিক বিচারব্যবস্থায় তা সম্ভব নয়, কেননা সব রাষ্ট্রই সার্বভৌম বিধায় কোনো প্রয়োগকারী বাহ্যিক কর্তৃপক্ষকে কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্রে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে পাঠানো সম্ভব নয়। (নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত ছাড়া) তা ছাড়া জাতিসংঘের কোনো পুলিশ বাহিনীও নেই আইসিজের রায় বাস্তবায়নের জন্য। অনেকে ভুল করে ইন্টারপোলকে জাতিসংঘের পুলিশ বলে মনে করে। এটি ঠিক নয়। ইন্টারপোল বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পুলিশ বাহিনীসমূহের একটি সমিতি মাত্র। যদিও বিভিন্ন দেশের এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন দাফতরিক নথিতে ইন্টারপোলের উল্লেখ রয়েছে, তবু পৃথিবীর কোনো দেশেই ইন্টারপোলের কোনো স্টেচুটারি অবস্থান নেই। আইসিজের রায় অমান্য করার অর্থ জাতিসংঘের সনদ লঙ্ঘন করা বিধায় আইসিজের রায় অমান্য করার ঘটনা খুবই কম। তবে রায় লঙ্ঘনের কিছু নজির যে নেই, তা নয়। আইসিজে ১৯৮৪ সালে নিকারাগুয়ার পক্ষে রায় দিলে স্বয়ং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সে রায় লঙ্ঘন করেছিল। ১৯৭৩ সালে ফ্রান্স আইসিজের অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করে আণবিক পরীক্ষা চালিয়েছিল, ১৯৪৫ সালে আইসিজে যুক্তরাজ্যকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করার জন্য আলবেনিয়াকে নির্দেশ দিলেও আলবেনিয়া তা মান্য করেনি।

আইসিজের রায় অমান্য করলে একমাত্র প্রতিকার হচ্ছে নিরাপত্তা পরিষদের দ্বারস্থ হওয়া। জাতিসংঘ সনদের ৯৪(২) অনুচ্ছেদ রায়প্রাপ্ত দেশকে এ অধিকার দিয়েছে। তবে নিরাপত্তা পরিষদ কী সিদ্ধান্ত নেবে বা আদৌ কোনো সিদ্ধান্ত নেবে কিনা তা সম্পূর্ণরূপে নিরাপত্তা পরিষদের ব্যাপার, যেখানে ভোট ও ভেটো দুটোই চলে। আইসিজে নিরাপত্তা পরিষদকে বাধ্য করতে পারে না। আইসিজের দেওয়া চারটি আদেশই বিচারপতিদের সর্বসম্মত নির্দেশনা হওয়ায় এগুলো অনেক ভারিক্কি ওজনের। তাই মিয়ানমার আন্তর্জাতিকভাবে প্রচ- চাপের মুখে পড়বে এই নির্দেশনাসমূহ মান্য করতে। চূড়ান্ত আদেশের জন্য গাম্বিয়া তার আরজিতে যা চেয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণটি হলো- এই মর্মে ঘোষণা এবং নির্দেশনা যে, বিতাড়িত বা বিতাড়িত হতে বাধ্য করা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্বের পূর্ণ অধিকার এবং মর্যাদাসহ নিরাপদে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি করা এবং ঘটিত অপরাধসমূহের পুনরাবৃত্তি যেন না হয় তার নিশ্চয়তা। গাম্বিয়া তার আরজিতে এই মর্মে নালিশ করেছে যে, মিয়ানমার জাতিগত নিধন (এবহড়পরফব) করেছে, তা করার ষড়যন্ত্র করেছে, জনগণকে এসব করার জন্য উৎসাহিত করেছে, এসব অপরাধ বন্ধ করতে, অপরাধীদের সাজা দিতে এবং প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নে ব্যর্থ হয়েছে। আরজিতে আরও বলা হয়েছে, অপরাধীদের যেন ফৌজদারি বিচারের আওতায় আনা হয়।

আইসিজের রায় বা নির্দেশনার বিরুদ্ধে কোনো আপিল হয় না। অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশনাগুলো থেকে এটা আশা করা যায় যে, চূড়ান্ত আদেশেও গাম্বিয়ার প্রার্থিত আদেশসমূহ থাকবে, বিশেষত এই কারণে যে, অন্তর্বর্তীকালীন আদেশসমূহ হয়েছে ১৭ বিচারপতির সবার সর্বসম্মতিক্রমে।

মিয়ানমারের প্রাথমিক ধারণা ছিল, আইসিজেতে এ মামলা চলতে পারে না বলে তাদের প্রার্থনা গৃহীত হবে। কিন্তু আদালত তাদের সেই যুক্তি নাকচ করায় মিয়ানমারের মোহভঙ্গ হয়েছে। অনেক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, মিয়ানমার, বিশেষ করে সু চি আরও অধিক আন্তর্জাতিক লাঞ্ছনা ও নিন্দা এড়ানোর জন্য সম্ভবত চূড়ান্ত শুনানির আগেই রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অপরাধসমূহ বন্ধ করে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে উদ্যোগী হবেন। বিশেষজ্ঞদের এ ধরনের মতামতের পক্ষে যুক্তি রয়েছে। একদিকে আইসিজে যেমন অপরাধীদের ফৌজদারি বিচারের নির্দেশনা দিয়েছে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের (আইসিসি) প্রসিকিউটরও এরই মধ্যে উক্ত আদালতের প্রাকবিচার চেম্বারের অনুমোদন পেয়ে তদন্তকাজ শুরু করে দিয়েছেন। আইসিসি জাতিসংঘের অংশ নয়, এটি রোম চুক্তি নামক একটি বহুজাতিক চুক্তির সৃষ্টি। এ আদালত জেনোসাইড এবং মানবতাবিরোধী অপরাধসহ চারটি অপরাধের বিচার করতে পারে। তবে অপরাধ হতে হবে চুক্তিভুক্ত দেশে। মিয়ানমার চুক্তিভুক্ত দেশ না হলেও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করতে পারবে এই কারণে যে, মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞার মধ্যে রয়েছে দেশান্তর করা আর এই অপরাধ তখনই সংঘটিত হয় যখন বিতাড়িত ভুক্তভোগী অন্য দেশের মাটিতে পা রাখেন, অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে। বাংলাদেশ রোম চুক্তিভুক্ত হওয়ায় এ অপরাধটি বাংলাদেশের মাটিতে ঘটে যাওয়ায় আইসিসি এ অপরাধের জন্য সু চিসহ মিয়ানমারের সেসব ব্যক্তি এ অপরাধ সংঘটনে ভূমিকা পালন করেছেন বা অপরাধ ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছেন, তাদের বিচার করতে এবং সাজা দিতে পারবে। আইসিসি আইসিজের মতো দেওয়ানি আদালত নয়। এটি ফৌজদারি আদালত, যেটি সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদন্ডের আদেশ দিতে পারে।

তদন্ত শুরু হয়ে যাওয়ায় এখনই প্রসিকিউটর সু চিসহ অন্য অপরাধীদের গ্রেফতারের জন্য পরোয়ানা জারির আদেশ চাইতে পারেন। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির সঙ্গে সঙ্গে আইসিসি রোম চুক্তিভুক্ত সব দেশকে বলতে পারে পরোয়ানায় নামীয় ব্যক্তিদের গ্রেফতার করে আইসিসির কাছে হস্তান্তর করতে। এমন একটি পরোয়ানা সুদানের সম্প্রতি ক্ষমতাচ্যুত রাষ্ট্রপতি ওমর আল বশিরের ওপর জারি রয়েছে যার কারণে বশির রাষ্ট্রপতি থাকাকালে এ ভয়ে কোনো দেশে যেতেন না যে সে দেশ তাকে আইসিসিতে সোপর্দ করে দিতে পারে। সু চির এবং তার অপরাধী জেনারেলদেরও একই অবস্থা হতে পারে- এই ভয়ে তারা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়া এবং অপরাধসমূহ বন্ধ করার প্রস্তুতি নিতে পারেন বিষয়টি বেশি দূরে গড়ানোর আগে। তা ছাড়া আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে হওয়ার সম্ভাবনা তো রয়েছেই। তার পরও বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে। মিয়ানমার যদি রায় বা নির্দেশনা না মানে তবে গাম্বিয়াকে নিরাপত্তা পরিষদে যেতে হবে এবং এজন্যই নিরাপত্তা পরিষদে জোরালো কূটনৈতিক প্রচেষ্টার প্রয়োজন রয়েছে। প্রাথমিক ঘোষণা ও নির্দেশনার পর চীন এবং রাশিয়া তাদের মত পরিবর্তন করতে পারে বলেও অনেক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন।

               লেখক : সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।

সর্বশেষ খবর