বৃহস্পতিবার, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

আওয়ামী লীগ কি চরিত্র বদল করছে?

মনজুরুল আহসান বুলবুল

আওয়ামী লীগ কি চরিত্র বদল করছে?

‘এই যে সাংবাদিক, শোনেন, আওয়ামী লীগ কি তার চরিত্র বদল করছে?’ ফালগুনের শুরুতে কুয়াশা কাটা ভোরে প্রাতঃভ্রমণে বিঘ্ন হলেও প্রবীণ প্রশ্নকর্তা ও প্রশ্ন কোনোটাই এড়াতে পারি না। এই ভোরে এ রকম একটা প্রশ্ন নিয়ে আলোচনার সঠিক সময় নয়। তবে বয়সের ভারে নুয়ে পড়া কিন্তু অভিজ্ঞতায় টনটনে প্রবীণকে পাশ কাটিয়ে যেতেও পারি না। তিনি আমাকে স্মরণ করিয়ে দেন মাত্র কয়েক মাস আগে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের সময় দলটি নিয়ে তার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিষয়ে আলোচনার কথা। তিনি প্রথামাফিক রাজনীতি করেন না, তবে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ আর নেতা হিসেবে শেখ মুজিব- এর বাইরে কিছু ভাবেন না।  তিনি ওই ভোরে কিছুটা ক্ষোভ, কিছুটা হতাশা, কিছুটা বিষাদমাখা গলায় আমার পথ আটকে দাঁড়ান। হাত ধরে পাশের বেঞ্চিতে বসান, বলেন : আওয়ামী লীগ তো অসাম্প্রদায়িক মধ্যবিত্ত মানুষের দল; সাম্প্রদায়িক পুঁজিপতিদের মুসলিম লীগের বিপরীতেই তো এর জন্ম। আওয়ামী লীগের প্রাণভোমরা তো দেশের অসাম্প্রদায়িক মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যেই। এর পর দীর্ঘ সময় নিয়ে যে বক্তব্য তার মোদ্দা কথা : মধ্যবিত্তের দল আওয়ামী লীগ কেন মধ্যবিত্তের সঙ্গে এমন আচরণ করছে? মধ্যবিত্তের বাইরের কেউ তো আওয়ামী লীগের স্থায়ী মিত্র হতে পারে না। জানি তর্ক করা বৃথা। কিন্তু প্রবীণের ক্ষোভমিশ্রিত বক্তব্য এড়িয়ে যাওয়ার জো নেই।

ভোর যেভাবেই শুরু হোক পত্রিকায় খবরটি দেখে মনটা ভালো হয়ে যায়। রিপোর্ট বলছে : দেশে স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রমের আওতায় খুদে শিক্ষার্থীদের ব্যাংক হিসাব ও সঞ্চয় দুই বাড়ছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে স্কুল শিক্ষার্থীদের নামে ১৯ লাখ ৮০ হাজার হিসাব খোলা হয়েছে। এসব হিসাবে সঞ্চয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা। স্কুল ব্যাংকিং ও কর্মজীবী শিশু-কিশোরদের ব্যাংক হিসাব পরিচালনা ংক্রান্ত সভায় এ তথ্য জানানো হয়। স্কুল শিক্ষার্থীরা ব্যাংক হিসাবে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ সঞ্চয় করছে এ তো খুবই আশার কথা।

কিন্তু ভোরের সেই প্রবীণের হতাশামাখা মুখটি ভেসে উঠল। আজকের শিক্ষার্থীরা যদি জানতে পারে সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে তাদের জন্য কী ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে তাহলে তাদের এ উৎসাহ থাকবে কিনা প্রশ্নটি ধাক্কা দিল জোরেশোরে। গত সপ্তাহে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে ডাকঘর সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে সুদের হার প্রায় অর্ধেক কমানো হয়েছে। তিন বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ সুদহারের জায়গায় এখন ৬ শতাংশ পাওয়া যাবে। প্রজ্ঞাপন জারির তারিখ থেকেই এ সুদহার কার্যকরের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, এখন থেকে এক বছর মেয়াদে সুদহার হবে ৫ শতাংশ, আগে যা ছিল ১০ দশমিক ২০ শতাংশ। দুই বছর মেয়াদের সঞ্চয়পত্রে সুদহার হবে ৫ দশমিক ৫০ শতাংশ। আগে যা ছিল ১০ দশমিক ৭০ শতাংশ। আর তিন বছর মেয়াদের সঞ্চয়পত্রে সুদের হার হবে ৬ শতাংশ, যা আগে ছিল ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। আমানতকারী প্রতি ছয় মাস অন্তর মুনাফা উত্তোলন করতে চাইলে সে ক্ষেত্রে প্রথম বছরে ৪, দ্বিতীয় বছরে সাড়ে ৪ এবং তৃতীয় বছরে ৫ শতাংশ হারে মুনাফা পাবেন। আগে যা ছিল যথাক্রমে ৯, সাড়ে ৯ ও ১০ শতাংশ।

তবে এ ঘোষণায় বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখে ব্যাখ্যা দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। বলেছে, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার সরকার কমায়নি; কমেছে ডাকঘরে যে সঞ্চয় কর্মসূচি (স্কিম) রয়েছে এবং সেই কর্মসূচির আওতায় মানুষ যে আমানত রাখছে তার সুদের হার। সরকারি ব্যাংককে সুদের হারের সমপর্যায়ে নিয়ে আসতে ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকে আমানতের সুদের হার কমানো হয়েছে বলে যুক্তি দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

ওই বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ডাকঘর থেকে যেমন সঞ্চয়পত্র কেনা যায়, তেমন ডাকঘর সঞ্চয় স্কিমের আওতায়ও টাকা রাখা যায়। সুদের হার কমেছে ডাকঘরের সঞ্চয় স্কিমের মেয়াদি হিসাব ও সাধারণ হিসাবে। সাধারণ হিসাবের ক্ষেত্রে সুদের হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। আর তিন বছর মেয়াদি ডাকঘর সঞ্চয় স্কিমের সুদের হার হবে ৬ শতাংশ, যা এত দিন ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ ছিল। মেয়াদপূর্তির আগে ভাঙানোর ক্ষেত্রে এক বছরের জন্য সুদ পাওয়া যাবে ৫ শতাংশ, আগে যা ছিল ১০ দশমিক ২ শতাংশ। এ ছাড়া দুই বছরের ক্ষেত্রে তা হবে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ, আগে যা ছিল ১০ দশমিক ৭ শতাংশ।

কিন্তু এ ব্যাখ্যায় আশ্বস্ত হতে পারেননি সঞ্চয়পত্রের ওপর যাদের জীবন নির্ভরশীল সেই নিরীহ গোবেচারা গ্রাহকরা।

বিভিন্ন সূত্র বলছেন : ক্রমবর্ধমান ঋণের চাপে সঞ্চয়পত্র বিনিয়োগ নিরুৎসাহ করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এ বছর ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর উৎসে আয়কর কর্তনের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। ব্যাংকগুলোর স্থায়ী আমানতের ক্ষেত্রেও সুদের ওপর উৎসে করের হার ১০ শতাংশ এবং যাদের টিআইএন নেই, তাদের ক্ষেত্রে এ হার ১৫ শতাংশ। এ ছাড়া ১ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সঞ্চয়পত্র নিয়ে এই লেজেগোবরে শুরু হয়েছে গত বাজেটের পরই।

প্রাতঃভ্রমণের সেই প্রবীণের প্রশ্ন : সরকারের আয় বাড়ানোর নানা উপায় থাকতে কেন মধ্যবিত্তের ‘পেটে লাথি মারা’ হবে। ডাকঘর সঞ্চয় স্কিমের গ্রাহকরা প্রধানত বড় শহরের বাইরের। এদের অনেকেরই পুঁজি এমন নয় যে তারা বড় বিনিয়োগে যেতে পারেন। আর বয়স বা সামাজিক অবস্থার কারণেও তারা ঝুঁকি না নিয়ে নিরাপদ আয় নিশ্চিত করতে চান। বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রাহক হচ্ছেন স্বল্প আয়ের মানুষ, অনেক ক্ষেত্রে বিধবা, পেনশনভোগী মানুষ, যাদের আয়ের কোনো উৎস নেই, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী যাদের সুরক্ষা দেয় না, কিন্তু বেঁচে থাকার দায় থেকে যাদের মুক্তি নেই। সরকারের সিদ্ধান্ত কি এই সীমিত আয়ের মধ্যবিত্ত গ্রাহকদের বিপদগ্রস্ত করছে? এ প্রশ্ন উঠেছে জোরেশোরে। সরকার কি বুঝতে পারছে এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কারা।

খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, এর মধ্যেই আরও দুঃসংবাদ আসছে। তা হচ্ছে : সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে আয়কর রেয়াত কমানো হচ্ছে। সরকারের ঋণ ব্যবস্থাপনার ঝুঁকি ও ব্যয় হ্রাসের জন্যই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এজন্য আগামী অর্থবছরের বাজেটে অর্থবিলের মাধ্যমে আয়কর অধ্যাদেশে সংশোধনী আনা হবে। ক্যাশ অ্যান্ড ডেট ম্যানেজমেন্ট (সিডিএমসি) কমিটির গত ৫ ডিসেম্বর সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় সঞ্চয়পত্রে কর রেয়াত যৌক্তিকীকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভায় বলা হয়, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীরা একদিকে যেমন উচ্চহারে সুদ পাচ্ছেন, অন্যদিকে আয়কর রেয়াত পাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা ডাবল বেনিফিট পাচ্ছেন। এ ধরনের দ্বৈত সুবিধাপ্রাপ্তি আয়কর রেয়াত যৌক্তিকীকরণের মাধ্যমে হ্রাস করা যেতে পারে।

 

                লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর