সোমবার, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

মানচিত্রের শীর্ষে ইত্যাদি

হানিফ সংকেত

মানচিত্রের শীর্ষে ইত্যাদি

বাংলাদেশের মানচিত্রের উপরিভাগে অর্থাৎ একদম শীর্ষে পাখির ঠোঁটের মতো যে স্থানটি রয়েছে সেটিই হচ্ছে দেশের সর্বোত্তরের স্থান তেঁতুলিয়া। এখানেই রয়েছে জিরো পয়েন্ট। আর এ জিরো পয়েন্টের অবস্থান হচ্ছে তেঁতুলিয়ার এক নম্বর বাংলাবান্ধা ইউনিয়নে। বাংলাবান্ধা হচ্ছে দেশের অন্যতম প্রধান স্থলবন্দর। যার তিন দিকেই রয়েছে ভারতীয় সীমান্ত। আর এসব কিছুরই অবস্থান হচ্ছে পঞ্চগড় জেলায়। বলা হয় পঞ্চগড়ের এ তেঁতুলিয়া থেকেই বাংলাদেশের সীমানা শুরু। জাতীয় সংসদের ১নং সংদসীয় আসনটিও শুরু হয়েছে এখান থেকে। পঞ্চগড় জেলার ব্র্যান্ডিং স্লোগান হচ্ছে ‘উত্তরের প্রবেশ দ্বার, সবুজ চায়ের সমাহার’। দেশের এ প্রবেশদ্বারেই আমরা ধারণ করেছি ইত্যাদির তেঁতুলিয়া পর্ব। অর্থাৎ আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা, সংস্কৃতি, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র এবং মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় স্থানগুলোতে গিয়ে ইত্যাদি ধারণের ধারাবাহিকতায় এবার আমরা গিয়েছিলাম আমাদের মানচিত্রের শীর্ষে অবস্থিত উত্তর দুয়ারী বলে খ্যাত পঞ্চগড়ের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবদীপ্ত উপজেলা তেঁতুলিয়ায়। তেঁতুলিয়াকে বলা হয় মুক্তাঞ্চল। স্বাধীনতার তীর্থত্রে।

অনুষ্ঠান ধারণের আগে গত ডিসেম্বর মাস থেকেই ইত্যাদির টিম পঞ্চগড় এবং তেঁতুলিয়ায় ধারণস্থান খুঁজতে থাকে এবং ২/৩টি স্থান নির্বাচনও করে। সে সময় তেঁতুলিয়ার তাপমাত্রা ছিল ৭/৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। প্রচন্ড ঠান্ডা। তার ওপর কুয়াশা এবং হিমালয়ের হিমেল বাতাস। শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে। এর মধ্যেই চূড়ান্ত স্থান নির্বাচন এবং সরেজমিনে দেখার জন্য ডিসেম্বরের ২৩ তারিখে পঞ্চগড় এক্সপ্রেসে যাত্রা শুরু করলাম পঞ্চগড়ের উদ্দেশে। রাত ১২টায় ট্রেন ছাড়ার কথা থাকলেও ছেড়েছে রাত প্রায় ৩টার দিকে। এ ডিজিটাল যুগে ট্রেনের এই বিলম্ব দেখে ট্রেনের সময়সূচি নিয়ে পুরনো সেই প্রচলিত বাক্যটি আবারও মনে পড়ল, ‘৯টার ট্রেন কটায় ছাড়বে?’। যাই হোক ভেবেছিলাম বিমানে গেলে সৈয়দপুর বিমানবন্দরে নেমে তেঁতুলিয়া পৌঁছুতে পৌঁছুতে দুপুর হয়ে যাবে, বরং ট্রেনে গেলে সকাল সকাল পৌঁছে যাব এবং সারা দিনে কাজগুলো সেরে রাতের ট্রেনে ঢাকা ফিরব। কিন্তু ট্রেন পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেজে গেল দুপুর প্রায় আড়াইটা। দিনের অর্ধেক শেষ। সকালের নাস্তা আর হলো না। বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের এ রেলগাড়ি সম্পর্কে দু-একটি কথা না বললেই নয়। কমলাপুর থেকে ১২টার ট্রেন কেন ২টার পরে ছাড়ল তা বোধগম্য নয় এবং এ ব্যাপারে কারও কোনো জবাবদিহিতাও নেই। এরপর রয়েছে যাত্রীদের নানান সমস্যা। বগিগুলোতে যাত্রীসংখ্যা অনুযায়ী টয়লেট অপ্রতুল। তার ওপর পানি সংকট। নির্দিষ্ট সময় পরে পানি শেষ হয়ে যাওয়ায় টয়লেটেও অসম্ভব দুর্গন্ধ এবং ব্যবহার অনুপযোগী। এরপর আছে খাদ্য সমস্যা। প্রায় ১২/১৩ ঘণ্টার দীর্ঘ ট্রেনযাত্রা অথচ ট্রেনের ক্যান্টিনটিও মানসম্মত নয়। সেই প্রাচীন আমলের বেঁধে দেওয়া মেন্যু-কাটলেট এবং পোড়া চিকেন এখনো আছে, সঙ্গে ২/৩ পিস পাউরুটি। এত বছরেও ট্রেনের এ খাদ্য তালিকার কেন পরিবর্তন হলো না তাও আমার বোধগম্য নয়। অনেককেই দেখেছি চিপস খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করছে। কারণ ট্রেনের এই দীর্ঘ বিলম্ব কারোরই জানা ছিল না। সবারই ধারণা ছিল ট্রেনটি নির্দিষ্ট সময়ে ছাড়বে এবং যথারীতি সকালেই পৌঁছবে। সুতরাং খাবার নিয়ে বাড়তি চিন্তা ছিল না। তাই নিজেরাও কোনো ড্রাইফুড বা অন্য খাবার নিয়ে আসেনি। অনির্ধারিত কারণে ট্রেনেও খাদ্য মজুদ নেই। শিশুদের কষ্ট হয়েছে খুব বেশি। সুতরাং রেলের সংখ্যা বাড়ালেই চলবে না, যাত্রীসেবার মানও বাড়াতে হবে। ট্রেনের এ সময় সংকট যেহেতু কর্তৃপক্ষের জানা, সুতরাং যাত্রী দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে এ ব্যাপারে তাদের আরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন ছিল। রেল কর্তৃপক্ষের কাছে বিনীত অনুরোধ অনুগ্রহ করে ভবিষ্যতে এসব দিকে দৃষ্টি দেবেন।

স্টেশন থেকে জেলা প্রশাসকের পাঠানো গাড়িতে পৌঁছলাম সার্কিট হাউসে। দুপুরের খাবার প্রস্তুত ছিল। আমাদের বিলম্ব দেখে তিনি বেশ কবার টেলিফোনে খোঁজ নিয়েছেন। আমার দেখা প্রথম নারী জেলা প্রশাসক। নাম সাবিনা ইয়াসমিন। বেশ কর্মঠ। নির্ধারিত সময় পৌঁছাতে না পারায় তিনিও অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তবে ফেরার সময় ট্রেন স্টেশনে এসে দেখা করেছেন। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আবদুল মান্নান আমাদের সঙ্গ দিলেন। খাওয়া-দাওয়া শেষে রওনা দিলাম তেঁতুলিয়ার উদ্দেশে। পঞ্চগড় থেকে তেঁতুলিয়া পৌঁছাতে সময় লাগল প্রায় ৪০ মিনিট। তখন ৪টার বেশি বাজে। বেশকটি লোকেশন দেখার পর পছন্দ হলো- তেঁতুলিয়া সরকারি পাইলট মডেল উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠটি। এটি একটি ঐতিহাসিক মাঠ। আমরা সাধারণত কোনো খোলা মাঠ বা উন্মুক্ত স্থানে ইত্যাদি ধারণ করি না, ধারণ স্থানটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বকেই আমরা প্রাধান্য দিয়ে থাকি। তেঁতুলিয়ার এ স্কুল মাঠটিরও রয়েছে তেমনি ঐতিহাসিক গুরুত্ব। প্রায় ২০০ বছর আগে অর্থাৎ ১৮১৬ থেকে ১৮২৮ সালে ডাকবাংলোর পাশ থেকে এ স্কুল মাঠ পর্যন্ত ছিল একটি ব্রিটিশ ক্যান্টনমেন্ট। ১৮৬০ সাল থেকে দীর্ঘদিন এ মাঠে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলাও বসত। পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের এমনকি ইউরোপীয় পণ্যদ্রব্যও এখানে বেচাকেনা হতো। আর আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের একটি ট্রানজিট স্টেশন হিসেবে এ মাঠটি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।

এ মাঠেই মুক্তিযোদ্ধাদের বাছাই করে ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার দুর্গম এলাকায় অবস্থিত মূর্তি গেরিলা ক্যাম্পে পাঠানো হতো। ৭ জুলাই এ মাঠেই ভাষণ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, সঙ্গে ছিলেন সেনাপ্রধান জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী। সামরিক শক্তি যাচাইয়ের জন্য এ মাঠেই সেনাদের পরিদর্শনে এসেছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান। যুদ্ধের সময় বিভিন্ন সামরিক অস্ত্র, গোলাবারুদ এখানে মজুদ করে রাখা হতো। তাছাড়া এখান থেকেই পরিচালিত হতো যাবতীয় প্রশাসনিক কাজ।

সুতরাং আমরা গর্বের সঙ্গে বলতে পারি, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল মুক্ত করার যাত্রা শুরু হয়েছিল এ মাঠ থেকেই। গত ১৭ জানুয়ারি এখানেই লক্ষাধিক দর্শকের উপস্থিতিতে ধারণ হয় ইত্যাদির তেঁতুলিয়া পর্ব। মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বাক্ষর বহনকারী ঐতিহাসিক এ মাঠে ইত্যাদি ধারণ করতে পেরে আমরাও গর্বিত।

উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে যে চারটি এলাকা মুক্তাঞ্চল ছিল তার মধ্যে তেঁতুলিয়া অন্যতম। কারণ অন্যান্য স্থানে কিছু সময়ের জন্য শত্রুপক্ষ প্রবেশ করতে পারলেও এক মুহূর্তের জন্যও হানাদার বাহিনী তেঁতুলিয়ার কোথাও পা রাখতে পারেনি। তাই একে বলা হয় মুক্তাঞ্চল। শুধু মুক্তাঞ্চল হিসেবেই তেঁতুলিয়া গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, বরং মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃতি নির্ণয়ে এখানে গৃহীত হয় বহু পরিকল্পনা।

এ তেঁতুলিয়ায় রয়েছে প্রায় ৩০০ বছরের প্রাচীন একটি ডাকবাংলো। যেটি নির্মাণ করেছিলেন কুচবিহারের রাজা। এর মূল কাঠামো অনেকটা মোগল সম্রাট শেরশাহের আমলের সরাইখানার মতো। বাংলাদেশ এবং ভারতের সীমানা রেখার মতো প্রবাহিত মহানন্দা নদীর তীর ঘেঁষে ১৫ থেকে ২০ মিটার উঁচু টিলার ওপর এটি নির্মিত।

মুক্তাঞ্চল হিসেবে তেঁতুলিয়ার গুরুত্ব অনুধাবন করে মুজিবনগর সরকারের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, বিদেশি প্রতিনিধি, দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একাধিকবার এ বাংলোতে আসেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেনÑঅস্থায়ী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামারুজ্জামান, অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, বিশ্বখ্যাত সাংবাদিক মার্ক টালি ও উইলিয়াম ক্রলিসহ আরও অনেকে। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধকালীন অনেক পরিকল্পনা সভা হতো এই ডাকবাংলোতেই।

নদীবিধৌত পঞ্চগড় জেলায় প্রতি বছর নদী থেকে কয়েক কোটি ঘনফুট উন্নত বালু ও নুড়ি পাথর সংগ্রহ করা যায়। এ এলাকার বালু ও মাটির গুণ বা বৈশিষ্ট্যের কারণেই এখানে পাথর সৃষ্টি হয়। আবার, নদীর স্রোতেও ভেসে আসে বিভিন্ন রঙের পাথর। ২০/৩০ বছর আগেও এ এলাকায় আবাদ হতো না। পাথর উত্তোলনই ছিল এ অঞ্চলের মানুষের প্রধান জীবিকা। তেঁতুলিয়ার মহানন্দা নদী বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তসীমান্ত নদী। বলা যায় দুই দেশকে বিভক্তকারী নদী এ মহানন্দা। এ নদী থেকে প্রতিদিন অনেক নারী-পুরুষ জীবিকার তাগিদে পাথর সংগ্রহ করেন। এখনো মহানন্দা নদীতে প্রচুর নারী-পুরুষ স্রোতে ভেসে আসা পাথর সংগ্রহ করেন। স্থানীয় পাথর সংগ্রহকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, প্রতিদিন একজন সংগ্রহকারী ১৫ থেকে ২০ সিএফটি পাথর সংগ্রহ করেন। প্রতি সিএফটি পাথর বিক্রি করেন ১৫ থেকে ২০ টাকা। ফলে এক একজনের আয় প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। অন্যদিকে স্থলভাগের আট/দশ ফুট মাটি খুঁড়লেও পাথর পাওয়া যায়। কিন্তু পরিবেশবান্ধব নয় বলে বর্তমানে এ ধরনের পাথর উত্তোলনকে নিরুৎসাহিত করা হয়।

পাথরের জন্য বিখ্যাত এ পঞ্চগড়ে রয়েছে দেশের একমাত্র পাথরের মিউজিয়াম-রকস্ মিউজিয়াম। পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ ডা. নাজমুল হক ১৯৯৭ সালে ব্যক্তিগত উদ্যোগে এ কলেজ চত্বরে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। বলা হয় পুরো মিউজিয়ামটিতে উত্তরাঞ্চলের সাড়ে চার হাজার বছরের ইতিহাস পাথরের গায়ে জীবন্ত হয়ে আছে।

বিচিত্র ধরনের পাথর রয়েছে এ মিউজিয়ামে। বলা যায় পাথর সংক্রান্ত সব তথ্যই পাওয়া যাবে এখানে। এক টন থেকে দুই টন ওজনের পাথর, ছোট-বড় পাথর, বেলে পাথর, কাদা পাথর, গ্রানাইট, ব্যাসল্ট, সিস্ট, কার্বন, কোয়ার্জাইট, সিলিকন, প্যাট্রিফাইড ইত্যাদি নানান আকৃতি ও প্রকৃতির পাথর থরে থরে সাজানো রয়েছে এ জাদুঘরে। এখানকার সব পাথরেই রয়েছে বিশেষত্ব। এ মিউজিয়ামের প্রতিষ্ঠাতা নাজমুল হক জানান, ক্লে রকস অর্থাৎ কাদা থেকে রূপান্তরিত পাথরের যে নিদর্শন সংগৃহীত হয়েছে তার বয়স কম করে হলেও ২০ লাখ বছর। বৃক্ষ জমাট বেঁধে রূপান্তরিত পাথর অর্থাৎ প্যাট্রিফাইড বা ফসিল পাথরের বয়স প্রায় ২৫ লাখ বছর। পঞ্চগড়ের মতো সমতল স্থানে গ্রানাইট পাথরের সন্ধান বিস্ময়কর। এ মিউজিয়ামে প্রদর্শিত কোয়ার্জাইট হচ্ছে পৃথিবী সৃষ্টির আদিকালের শিলা। এর বয়স কোটি কোটি বছর। এসব পাথর ছাড়াও প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বসম্পন্ন অনেক পাথর রয়েছে এখানে, যেগুলো আয়তনে অনেক বড়। এসব পাথরের অনেকগুলোতে খোদাই করা রয়েছে নানান ধরনের নকশা, বর্ণ, লিপি, তীর, ধনুক, চোখ ও জ্যামিতিক নকশা। যদিও লিপিগুলো দুর্বোধ্য। মিউজিয়ামের আকর্ষণীয় জিনিস হচ্ছে সহস্রাধিক বছরের পুরনো জোড়াবিহীন এক কাঠের সুদীর্ঘ দুটি নৌকা। বড়টি ৩৫ ফুট লম্বা এবং ছোটটি ২৫ ফুট। রয়েছে ১০ রকমের বালি ও ৮ রকমের মাটির নমুনা। এ এলাকার বালি অত্যন্ত উৎকৃষ্ট মানের। এখানে প্রায় ১ হাজারের বেশি লোকজ বস্তু সংগ্রহ রয়েছে। প্রতিনিয়তই পর্যটকেরা এ পাথরের মিউজিয়ামটি দেখতে আসেন।

তেঁতুলিয়ায় অবস্থিত বাংলাবান্ধা দেশের একমাত্র স্থলবন্দর, যেখান থেকে চারটি দেশের অর্থাৎ বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল-ভুটানের মধ্যে পণ্য আদান-প্রদানের সুবিধা রয়েছে। প্রায় ১০ একর জমিতে ১৯৯৭ সালে নির্মিত হয় এ বন্দর। এই বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্টে সপ্তাহের ৬ দিন বিকালে একটি নির্দিষ্ট সময়ে দুই দেশের সীমান্তবর্তী বাহিনী অর্থাৎ বাংলাদেশের বিজিবি ও ভারতের বিএসএফ সদস্যদের অংশগ্রহণে জয়েন্ট রিট্রিট সেরিমনি অর্থাৎ একটি যৌথ বিরতি অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের যৌথভাবে কুচকাওয়াজ এবং করমর্দনের মাধ্যমে এই অনুষ্ঠানে একসঙ্গে পতাকা নামানো হয়। দুই দেশের সীমান্তে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার জন্যই মূলত এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

তেঁতুলিয়ার আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছেÑ সমতল ভূমিতে চা উৎপাদন। বাংলাদেশের একটি অর্থকরী ফসল হচ্ছে চা। ব্রিটিশদের হাত ধরে ১৮৫৪ সালে প্রথম সিলেটের মালনীছড়ায় পরীক্ষামূলকভাবে এবং পরবর্তীতে ১৮৫৭ সালে বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয়।

তবে দেশের উত্তরাঞ্চলের পঞ্চগড়ে চা চাষ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। হিমালয়কন্যা খ্যাত দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে চা চাষ শুরুর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল একটি ভাবনা থেকে, তা হলো-যেহেতু মাটির গুণাগুণ এক, সীমান্তের ওপারে চা বাগান হলে এপারে নয় কেন?

১৯৯৬ সালে তৎকালীন এবং বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পঞ্চগড় সফরে এসে চা চাষের সম্ভাবনার কথা বলেন। সেই থেকেই শুরু। অতঃপর সেই সময়ের জেলা প্রশাসক মো. রবিউল ইসলামের তত্ত্বাবধানে পরীক্ষামূলকভাবে প্রথমে টবে, পরে জমিতে চা চাষ করা হয়। সে সময় পঞ্চগড় মহিলা কলেজের ভিতর প্রদর্শনীর জন্য দ্রুত পরিসরে প্রথম চা-বাগানটি করেন কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ নাজমুল হক। যে বাগানটি আজও রয়েছে।

পরবর্তীতে ২০০০ সালে সর্বপ্রথম তেঁতুলিয়া টি কোম্পানি লিমিটেড এবং কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট লিমিটেড বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু করে। তবে সম্পূর্ণ সমতল ভূমিতে ভিন্ন আদলে বাংলাদেশের প্রথম ও শতভাগ কেমিক্যালমুক্ত অরগানিক চা বাগানের যাত্রা শুরু করেন কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক কাজী শাহেদ আহমেদ। তার প্রতিষ্ঠিত কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট লি. বিশ্ববাজারে তেঁতুলিয়া অরগানিক টি নামে পরিচিত। যার নামকরণ করা হয়েছে তেঁতুলিয়ার নামে। বিভিন্ন ধরন এবং ফ্লেভারের চা পাওয়া যায় এখানে। যা বিশ্ববাজারে সমাদৃত। টেলিভিশন অনুষ্ঠানে শাহেদ আহমেদকে খুব একটা দেখা যায় না। তবে আমরা ইত্যাদির জন্য তার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। দীর্ঘদিন পর দর্শকরা তার কাছ থেকে সমতল ভূমিতে অরগানিক চা-উৎপাদনের বিস্ময়কর সব তথ্য জানতে পেরেছেন। তিনি জানান, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উৎসাহেই তিনি এ চা বাগান শুরু করেন এবং এ বাগান করতে গিয়ে তাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। অবাক বিস্ময়ে তার পরিশ্রমের কথা শুনলাম। চা গাছের চাষের জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন জমির, তাই প্রথমেই তিনি কিনেছেন ১৫ হাজার বিঘা জমি। জমিকে উর্বর করার জন্য পদ্মার পাড় থেকে ট্রাকে ট্রাকে কেঁচো এনে ছেড়ে দিয়েছেন সেই শুকনো মাটিতে, যাতে তারা বিস্তার লাভ করতে পারে। প্রয়োজন গোবর, তাই কিনেছেন ১ হাজার গরু। জমির উর্বরতা বাড়ানোর জন্য প্রয়োজন পাখি, হাজার হাজার পাখি কিনেছেন। কিছুদিন নিজে পুষে পরে এখানেই ছেড়ে দিয়েছেন। ওরা জমিতে পোকামাকড় খেয়ে ফেলে জমির উর্বরতা বাড়ায়। সে সময় ১ লাখ গাছ লাগিয়েছেন, ঝরে পড়া শুকনো পাতার জন্য। যে গাছ এখন ৭ লাখেরও বেশি হয়েছে। এভাবেই হাজার হাজার বিঘা সমতল ভূমিতে অরগানিক চা গাছের চাষ করে বাংলাদেশের চায়ের বিশ্ব বাজার তৈরিতে অবদান রেখেছেন। প্রতি বছর এখানে ৫ লাখ কেজি চা উৎপন্ন হয়। যা স্থানীয় চা প্রেমিকদের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হয়।

উল্লেখ্য, এ এলাকার প্রান্তিক চাষিরাও আস্তে আস্তে তাদের খন্ড খন্ড জমিতে চা চাষ শুরু করেন। প্রতি বছর জমি চাষ ও রোপণের ঝামেলা না থাকায় অনেকেই বাড়ির আশপাশে উঁচু পতিত জমিতে শাকসবজির বদলে চা চাষ করে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছেন। এক বছর চা-গাছ লাগালেই ৫০-৬০ বছর পর্যন্ত অর্থনৈতিকভাবে ফলন পাওয়া যায়। চা চাষের ফলে এখানে ১০/১২ হাজার লোকের কর্মসংস্থানও হয়েছে। এ তেঁতুলিয়া থেকেই হেমন্ত ও শীতকালে উপভোগ করা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্য। যা পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। তবে হিমালয় অঞ্চলের শৈত্যপ্রবাহের কারণে এ অঞ্চলে শীতের তীব্রতা খুব বেশি।

অদ্ভুত সুন্দর আমাদের এ বাংলাদেশ। তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ সর্বত্র ছড়িয়ে আছে এ সৌন্দর্য। যা পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য যথেষ্ট সমৃদ্ধ। আমরা আমাদের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তার কিছুটা হলেও তুলে ধরতে চেষ্টা করি। তবে প্রতিটি স্থানে গিয়েই উপলব্ধি করেছি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করলে বাংলাদেশও হতে পারে পর্যটকদের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় একটি স্থান।

                লেখক : গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

সর্বশেষ খবর