বুধবার, ১ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় প্রার্থনা বনাম চিকিৎসা

শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় প্রার্থনা বনাম চিকিৎসা

সারা বিশ্ব যখন কভিড-১৯ করোনাভাইরাসের আক্রমণে থরথর করে কাঁপছে; তখন এর উৎপত্তি ও বিস্তারের কারণ, চিকিৎসা পদ্ধতি, এর প্রতিরোধে সতর্কতা, অর্থনীতি ও রাজনীতির ওপর এর ফলাফলসহ নানা বিষয়ে আলোচনা ও বিশ্লেষণ চলছে। বিশেষজ্ঞ, যুক্তিশীল ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, দল ও গোষ্ঠীর মানুষ তাদের নিজ নিজ বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গি, জানাশোনার পরিধির ওপর ভিত্তি করে ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবে তাদের মতামত ব্যক্ত করছেন। কেউ কেউ আতঙ্ক ছড়াচ্ছেন, কেউ কেউ করছেন দোষারোপের রাজনীতি।

ডোনাল্ড ট্রাম্প দোষারোপ করছেন চীনকে, চীন বলছে নাটের গুরু হচ্ছে আমেরিকা! কিছু গবেষক বলছেন, বাদুড় থেকে প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের উৎপত্তি; আবার অনেকেই দুষছেন বায়োলজিক্যাল উয়েপন বা জৈব অস্ত্রকে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে গিয়ে ইতালি, স্পেন, চীন, আমেরিকা, কানাডা, ব্রিটেনসহ উন্নত দেশগুলোকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। পুরো দেশ লকডাউন করে, সেনা মোতায়েন করেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২২ মার্চ বলেছে, শুধু লকডাউন করে করোনাভাইরাস মোকাবিলা করা যাবে না। সংস্থাটির ভাষ্যমতে, লকডাউনের সঙ্গে সঙ্গে জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পদক্ষেপগুলোও প্রয়োজন; কেননা, পরবর্তীতে এ ভাইরাসটি যেন আবার ছড়িয়ে পড়তে না পারে। বিবিসির অ্যানড্রিউ মার শোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি বিশেষজ্ঞ ড. মাইক রাইয়ান বলেন, ‘যেদিকে আমাদের সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত তা হচ্ছে যারা (ইতিমধ্যে) অসুস্থ হয়েছেন, যারা ভাইরাসটি বহন করছেন, তাদের আলাদা করে ফেলা এবং যারা (অসুস্থ ও ভাইরাস-বহনকারীদের) সংস্পর্শে এসেছেন, তাদেরও (অন্যদের কাছ থেকে) পৃথক করে ফেলা।’

ড. রাইয়ান সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘যদি আমরা এখন থেকে শক্তিশালী জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পদক্ষেপগুলো না নিই, তাহলে লকডাউন ও জনগণের চলাফেরার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া বা শিথিল করা হলে, রোগটি তখন লাফিয়ে আগের অবস্থায় ফিরে আসবে।’

১৯৮টি দেশে প্রায় ৫ লাখ লোকের আক্রান্ত হওয়া ও ২২ হাজারের বেশি মৃত্যু (২৬ মার্চ রাত ১০টা পর্যন্ত), ও দেশে দেশে লকডাউন ও কারফিউ জারির পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ শুধু বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা, সতর্কতা ও ডাক্তারি চিকিৎসার ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। অনেকেই ঘরে বসে ইবাদত-বন্দেগি করছেন; অনেকেই প্রার্থনা করতে ছুটে যাচ্ছেন মসজিদ, মন্দির, গির্জা, সিনাগগসহ উপাসনালয়ে।

এমনকি ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের গোঁড়া অংশ জোর দিয়ে বলতে শুরু করেছে, একমাত্র প্রার্থনা এবং দোয়াই মানবজাতিকে এ পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করতে পারে। লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, খ্রিস্টধর্মের বৈাশ্বক কেন্দ্র ভ্যাটিকান সিটিতে ওই ধর্মের সর্বোচ্চ গুরু পোপ বসবাস করেন, সেই ভ্যাটিকান সিটি যে ইতালিতে অবস্থিত সেটি এখন মৃত্যুপুরী। মুসলমানদের সবচেয়ে পবিত্র স্থান সৌদি আরব, যেখানে মক্কা ও মদিনা অবস্থিত, সেই দেশের অবস্থাও ভালো নয়। সৌদি সরকার দুটি মসজিদ বাদে সব মসজিদের জামাত বন্ধ করে দিয়েছে, বন্ধ করে দিয়েছে ওমরাহ। আরও দুটি বড় ধর্ম হিন্দু বা সনাতন ধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম, যে দুটি ধর্মের উৎপত্তি ভারতে, সেই ভারতে ২৬ মার্চ পর্যন্ত অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন; এবং ভারত সরকার ২১ দিনের লকডাউন ঘোষণা করেছে।

অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বৈশ্বিক মহামারী হলে সেটি ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, লিঙ্গ, জাতীয়তা, নৃতত্ত্ব, ধনী-গরিব, দলিত ও আদিবাসী কিছুই মানে না। তবু ধর্মবিশ্বাসীদের গোঁড়া অংশ সতর্কতা ও চিকিৎসা বাদ দিয়ে করোনা থেকে মুক্তি পেতে শুধু প্রার্থনার কথা বলছে। এমন এক পরিস্থিতিতে গবেষকরা মহামারী প্রতিরোধে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কিছু প্রাজ্ঞ ও সুবিবেচনাপূর্ণ উপদেশ ও নির্দেশনার রেফারেন্স দিচ্ছেন, যে নির্দেশনাগুলো কভিড-১৯ করোনাভাইরাস প্রতিরোধে যথেষ্ট কার্যকর বলে মনে করা হচ্ছে।

রাইস বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং The Humani.y of Muhammad: A Christian View (Blue Dome Press, 2020), I Islam in America: Exploring the Issues (ABC-CLIO 2019) গ্রন্থের লেখক ড. ক্রেইগ কনসিডাইন গত ১৭ মার্চ নিউজউইকে প্রকাশিত তার এক কলামে লিখেছেন, রোগ-প্রতিরোধ বিদ্যাবিদ ড. অ্যান্থনি ফসি (Immunologis. Dr. Anthony Fauci) এবং চিকিৎসা সাংবাদিক ড. সঞ্জয় গুপ্তর (Medical Reporter Dr. Sanjay Gupta) মতো বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কভিড-১৯-এর মতো মহামারী প্রতিরোধে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও কোয়ারেন্টাইন হচ্ছে সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার।

এরপর তিনি প্রশ্ন করেছেন, ‘আপনারা কি জানেন যে, আর কে মহামারীর সময়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও কোয়ারেন্টাইনের কথা বলেছিলেন?’ পরের বাক্যে ড. ক্রেইগ কনসিডাইন এ প্রশ্নের উত্তরে বলছেন, তিনি হচ্ছেন ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা.), যিনি ১৪০০ বছর আগে এ কথা বলেছিলেন।

ড. ক্রেইগ কনসিডাইনের মতে, তিনি কোনোভাবেই প্রাণঘাতী রোগ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। তথাপি মুহাম্মদ (সা.) প্রাণঘাতী রোগ ও মহামারী মোকাবিলায় যেসব উপদেশ দিয়েছেন সেগুলো কভিড-১৯ করোনাভাইরাস প্রতিরোধে যথেষ্ট প্রজ্ঞাপূর্ণ ও সুবিবেচনাপ্রসূত বলে বিবেচিত হতে পারে। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা যদি শুনতে পাও, কোনো ভূখন্ডে প্লেগ দেখা দিয়েছে, তাহলে সেই ভূখরন্ড প্রবেশ কোর না; কিন্তু তুমি যদি দেখতে পাও, তুমি যেখানে বাস কর সেখানে প্লেগ দেখা দিয়েছে, তাহলে সেই স্থান ত্যাগ কোর না।’ কভিড-১৯ করোনাভাইরাস মোকাবিলায় আজ বিশ্বব্যাপী যে ‘কোয়ারেন্টাইন’ বা করোনা রোগী ও ভাইরাস বহনকারীদের আলাদা করা ও থাকার কথা বলা হচ্ছে, তার সঙ্গে কি মুহাম্মদ (সা.)-এর এই প্রাজ্ঞ নির্দেশনার মিল পাওয়া যাচ্ছে না?

রসুলুল্লাহ (সা.) ছোঁয়াচে রোগ সম্পর্কে বলেছেন, ‘যারা ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের স্বাস্থ্যবানদের থেকে আলাদা রাখতে হবে।’ মুহাম্মদ (সা.) পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ওপর অত্যন্ত জোর দিয়েছেন, যা মানুষকে সংক্রমণ থেকে দূরে রাখে। প্রাসঙ্গিকভাবে কিছু হাদিসের উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন, ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইমানের অঙ্গ’; ‘ঘুম থেকে ওঠার পর তোমার হাত ধুয়ে ফেল; কেননা, তুমি জান না যে, ঘুমের মধ্যে তোমার হাত কোথায় স্পর্শ করেছে’; ‘খাবারের রহমত ও বরকত নিহিত রয়েছে খাওয়ার আগে ও পরে হাত ধোয়ার মধ্যে’।

কেউ অসুস্থ হলে মুহাম্মদ (সা.) কী উপদেশ দিতেন? তিনি বলতেন, ‘অসুস্থ হলে চিকিৎসা করতে হবে; কেননা, আল্লাহ প্রতিকার ছাড়া কোনো রোগ সৃষ্টি করেননি। একমাত্র ব্যতিক্রম যে রোগটি সেটি হচ্ছে- বার্ধক্য’। এ হাদিসের মধ্য দিয়ে এটি প্রতীয়মান হয় যে, তিনি জানতেন কখন বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্তির সমন্বয় ঘটাতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক গোঁড়া ধার্মিক এমন কথাও বলেছেন, কোয়ারেন্টাইন, সামাজিক দূরত্ব (ও প্রয়োজনীয় জনস্বাস্থ্য সতর্কতা) বাদেই শুধু প্রার্থনা বা দোয়া মানুষকে করোনাভাইরাস থেকে নিরাপদ রাখবে! এ ব্যাপারে নবী মুহাম্মদ (সা.) কী বলেছেন?

নবম শতাব্দীর পার্সিয়ান পন্ডিত আল-তিরমিজি বর্ণিত এ হাদিসটির কথা বিবেচনা করুন। আল-তিরমিজি বর্ণিত হাদিসটি এ রকম- ‘একদিন নবী মুহাম্মদ (সা.) লক্ষ্য করলেন, এক বেদুইন পুরুষ তার উটকে না বেঁধে উন্মুক্ত অবস্থায় রেখে দিয়েছেন। তিনি বেদুইনকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি তোমার উটকে বাঁধলে না কেন? তখন বেদুইন উত্তর দিলেন, আমি সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস রেখেছি এবং সৃষ্টিকর্তাই আমার উটকে রক্ষা করবেন। তখন নবী মুহাম্মদ (সা.) বললেন, প্রথমে তোমার উট বাঁধো, তারপর সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস স্থাপন কোর।’ লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, রসুলুল্লাহ (সা.) মহান আল্লাহর ওপর বিশ্বাস এবং ধর্মের নৈতিকতা, শুদ্ধাচার ও পালনীয় ব্যাপারে যেমন নিষ্ঠতা দেখিয়েছেন; আবার যুক্তিবিচ্যুতও হননি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও ডাবলু ডাবলু ডাবলু বা বৈশি^ক তন্তু বা জালের এই যুগে এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ; অর্থাৎ ‘ফেইথ ও র‌্যাশনালিটি’র সমন্বয়।

উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে তাবৎ বিংশ শতাব্দীর একটি মৌলিক তর্ক হচ্ছে ‘ফেইথ ভারসেস র‌্যাশনালিটি’ এবং ‘বিজ্ঞান বনাম ধর্ম’। একবিংশ শতাব্দীতেও তর্কটি চলমান; এবং করোনাভাইরাস কর্তৃক বৈাশ্বক সংকটের সময়ে আবারও তর্কটি জোরদার হয়েছে। বিশেষ করে সতর্কতা ও চিকিৎসা ছাড়া প্রার্থনা করেই করোনা থেকে মুক্তি মিলবে কিনা, সে বিতর্কটি জোরেশোরেই চলছে। এ ব্যাপারে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনদর্শন, প্রাত্যহিক জীবনচর্চা, নির্দেশনা ও কা-জ্ঞান বিশ্বের সব মানুষের জন্য অনুসরণীয় হতে পারে।

মুহাম্মদ (সা.) ধর্মের ব্যাপারে যেমন দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, তেমনি স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা ও সবার কল্যাণের জন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ারও তাগিদও দিয়েছেন। বিশ্বে উগ্রতা, বর্ণবাদ, জঙ্গিবাদ, ঘৃণা ও যুক্তিবিবর্জিত ধর্মান্ধতা যেভাবে বিস্তৃত হচ্ছে; সেই মুহূর্তে ‘ফেইথ’ বা বিশ্বাস বা ধর্মের ন্যায়নিষ্ঠ চর্চা ও ‘র‌্যাশনালিটি’ বা যুক্তির চর্চা এবং বিশ্বাস ও যুক্তির সমন্বয় ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে যেমন সব মানুষের ইহজাগতিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক কল্যাণ বয়ে আনতে পারে; তেমনি রাষ্ট্রিক ও বৈশ্বিক পরিবেশকেও করে তুলতে পারে সহনশীল, শান্তিপূর্ণ ও সব মানুষের জন্য নিরাপদ।

 

লেখক : অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর