মঙ্গলবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

বিজয়ের মাসে আনোয়ারুল আলম শহীদ

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

বিজয়ের মাসে আনোয়ারুল আলম শহীদ

কাদেরিয়া বাহিনীর বেসামরিক প্রধান আনোয়ারুল আলম শহীদ সেদিন আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। তার জীবনে আগে-পরে যত ব্যর্থতাই থাকুক মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীর বেসামরিক প্রশাসন পরিচালনায় তুলনা নেই। মৃত্যুর স্বাদ সবাইকে পেতে হবে। আল্লাহ তাকে ভালো রাখুন, মাফ করে দিন এটাই কামনা করি। ঢাকায় না হয়ে তার জন্মভূমি টাঙ্গাইলে দাফন করা হলে মানুষ অনেক বেশি খুশি হতো। তার টাঙ্গাইলে কবর হবে এটা বহু মানুষ চেয়েছিল। কেউ কেউ বলছে, তার পরিবার-পরিজন নাকি বলেছে টাঙ্গাইলে নেওয়ার টানাহেঁচড়া করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কেউ কেউ আমার কাছে দুঃখ করে চোখের পানি ফেলেছেন। এখন আর আমি কী করতে পারি? যাদের পরিজন তাদের ইচ্ছার বাইরে যাওয়ার সুযোগ কোথায়? আবার এই গতকাল আমার প্রিয় এক যোদ্ধা কাটোরার নাসির করোনায় আক্রান্ত হয়ে চলে গেল। নাসিরের ছোট ভাই তায়েব ফোন করে জানাল। নাসিরের চলে যাওয়া সম্পর্কে প্রস্তুত ছিলাম না। করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আছে জানতাম, কিন্তু এভাবে চলে যাবে জানতাম না। নাসির, সুলতান, লতিফ ওরা ছিল ত্রিরত্ন। সুলতান অনেক আগেই চলে গেছে। নাসির গেল গতকাল। শুধু লতিফ রয়ে গেছে। জামুর্কী-পাকুল্লার আরেক বীর যোদ্ধা গাজী লুৎফর ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধযুদ্ধে দারুণ ভূমিকা রেখেছিল। সে স্বগোত্রীয়দের হাতে আশির দশকে নিহত হয়। ওই অঞ্চলে এখন আর আমাদের তেমন কেউ রইল না। আল্লাহ নাসির ও আনোয়ারুল আলম শহীদকে মাফ করুন এবং তাদের বেহেশতবাসী করুন।

এ মাসে আমরা স্বাধীন হয়েছি। শত শত বছরের পরাধীনতার জিঞ্জির ভেঙে বিজয়ের স্বাদ গ্রহণ করেছিলাম। দিন পেরিয়ে সূর্য উঠলেই আমরা পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজিত ও বন্দী করেছিলাম। ১৫ তারিখ আমাদের কাছে দিন-রাতের কোনো তফাত ছিল না। ১৫ তারিখ সারা দিন ছিলাম ঢাকাকে চারদিক থেকে গলা টিপে ধরায় ব্যস্ত। মুক্তিযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর ঢাকা দখলের কোনো পরিকল্পনা ছিল না। তাই অনেক জেনারেলকে প্ল্যানটিকে ফল্টি প্ল্যান বলতে শুনেছি। ১৩ তারিখের রাত পর্যন্ত আমাদের জানা ছিল না, উত্তর দিক থেকে আসা মিত্রবাহিনীর ঢাকা দখলের কোনো পরিকল্পনা নেই। তাদের টাস্ক নবীনগর পর্যন্ত এগিয়ে উত্তরবঙ্গ থেকে যাতে হানাদাররা পিছিয়ে আসতে না পারে তা নিশ্চিত করা। অন্যদিকে আর একদলের চৌরাস্তা বোর্ডবাজার বড়জোর টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত হানাদারদের নড়াচড়া ঠেকিয়ে রাখা। ১৩ তারিখ যখন ব্যাপারটা বুঝতে পারি তখন খুবই বিরক্ত হয়েছিলাম। মেজর জেনারেল নাগরা হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করছিলেন। গভীর রাতে নির্দেশ আসে, উত্তর দিক থেকে এগিয়ে যাওয়া বাহিনী ঢাকার উপকণ্ঠে পৌঁছতে পারলেই তাদের টাস্ক পূর্ণ হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হবে। যদি আরও এগোতে হয় সেটা যারা যুদ্ধ ক্ষেত্রে আছেন তাদের বিবেচনা। আসলে মিত্রবাহিনীর পরিকল্পনা ছিল আগরতলার দিক থেকে ধেয়ে আসা শক্ত-সমর্থ ডিভিশন সম্ভব হলে ঢাকা দখল নেবে। উত্তর দিক থেকে একটা মাউন্টেন ডিভিশন নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চীন সীমান্ত থেকে সে ডিভিশন শেষ পর্যন্ত সরিয়ে আনা যায়নি। তখন এখান ওখান থেকে কুড়িয়ে দুটি ব্রিগেড খাড়া করা হয়। একটির নেতৃত্ব দেন ব্রিগেডিয়ার সানসিং বাবাজি। যার সৈন্য সংখ্যা ছিল দেড়-দুই হাজার, সঙ্গে ৪-৫ হাজার মুক্তিবাহিনী। অন্যদিকে আরেকটি ব্রিগেড লিড করেন ব্রিগেডিয়ার হরদেও সিং ক্লের। তার ব্রিগেড ইনট্যাক্ট ছিল। আর এদের আরও শক্তি বৃদ্ধি করেছিল ১০ তারিখ টাঙ্গাইলের পুংলী-চিনামুড়া-সহদেবপুরে এক ব্যাটালিয়ন প্যারাট্রুপস নেমে। উত্তরে হালুয়াঘাট থেকে ময়মনসিংহের ওপর দিয়ে টাঙ্গাইল হয়ে সাভার পর্যন্ত এগোতে ব্রিগেডিয়ার সানসিংয়ের কলাম কোথাও বাধা পায়নি। মানকারচরের দিক থেকে আসা ক্লের-এর ব্রিগেড কামালপুরে প্রচ- বাধা পায়। তিন দিন তিন রাত অবিরাম যুদ্ধ করেও কামালপুর হানাদার ঘাঁটির পতন ঘটাতে না পেরে চারদিক থেকে কামালপুরকে ঘিরে রেখে মিত্রবাহিনী জামালপুরের দিকে এগিয়ে আসে। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে এসে তারা থেমে যায়। এক ব্রিগেড সৈন্যের জামালপুর হানাদার ঘাঁটি ছিল দুর্ভেদ্য। সেখানে বিমান থেকে হাজার পাউন্ডের বোমা ফেলা হয়েছিল। হানাদারদের অনেক বাঙ্কার ধসে যায়। তার পরও তারা ঘাঁটি ছাড়েনি। সাধারণ মানুষ এদিক-ওদিক দিয়ে মিত্রবাহিনীকে ব্রহ্মপুত্র পার করে দেয়। ৮ তারিখ আমরাও জামালপুরের দিকে অনেক দূর এগিয়ে ছিলাম। কিন্তু ঢাকার পথে গাড়ি-ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে চলা মিত্রবাহিনীর সঙ্গে পায়ে হেঁটে এঁটে উঠব না, পিছিয়ে পড়ব বলে গোপালপুর-ঘাটাইলে ফিরে এসেছিলাম। ৯ তারিখ সকাল থেকে হানাদারদের আমরা পদে পদে বাধা দিই। ১০ তারিখ সারা দিন চলে হানাদারদের পালানোর পালা। আমাদের অনুরোধে মিত্রবাহিনী ঘাটাইল-গোপালপুর-ফুলতলা-এলেঙ্গায় বিমান আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানিরা তছনছ হতে থাকে। সাড়ে ৩টা-৪টার দিকে নিরাপদে ছত্রীবাহিনী নামা শুরু হয়। এত দিন হানাদাররা চলত মূল রাস্তা দিয়ে, আমরা গ্রামগঞ্জের আতর বাতর দিয়ে। আমাদের আক্রমণে হানাদাররা মূল রাস্তা ছেড়ে গ্রামগঞ্জের পথ ধরে। এক দিনেই তারা সমস্ত শৃঙ্খলা হারিয়ে ফেলে। খাওয়ার অভাবে মাটির নিচ থেকে কচু-ঘেচু-মুলা-আলু তুলে খাওয়া শুরু করে। মাঝেমাঝে এখানে সেখানে দলছুট হানাদাররা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে, সাধারণ বীর জনতার হাতে ধরা পড়ে। ১১ তারিখ ১০টা-১১টার মধ্যে টাঙ্গাইলের প্রায় সব এলাকা হানাদারমুক্ত হয়ে যায়। আমরা এগোতে থাকি পুব-উত্তর দিক থেকে, পশ্চিমন্ডদক্ষিণ দিক থেকে কয়েক হাজার মুক্তিবাহিনী। দুপুরের আগেই টাঙ্গাইল পুরান শহর আমাদের দখলে এসে যায়। পড়ে থাকে জেলা সদর। বিকালে তারও পতন ঘটে আমাদের হাতে। বর্তমান মন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক বলেছে, সে নাকি টাঙ্গাইল থানায় পতাকা উঠিয়েছে। হতেও পারে। ক্যাপ্টেন নিয়ত আলী, মেজর মাইনুদ্দিন, শামসু, বায়জিদ, সোলেমান, লায়েক আলম এরা অনেকেই ছিল। আবদুর রাজ্জাক যদি টাংগাইল থানায় পতাকা তুলে থাকে কোনো দোষের কথা নয়। মুক্তিযুদ্ধটা ছিল সমষ্টিগত। যার যেখানে দায়িত্ব ছিল সেখানে সত্যিই সে ছিল সর্বেসর্বা।

১৬ ডিসেম্বর যেমন আমরা পাকিস্তানি উপনিবেশ থেকে মুক্ত হয়েছি, ঠিক তেমনি এবার ১০ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুতে সর্বশেষ স্প্যান বসানো হয়েছে। বিষয়টা খুবই আনন্দের, গৌরবের, বুক চিতিয়ে বলার মতো। পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগে মন্ত্রী আবুল হোসেন পদ হারিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আবুল হোসেন, আবুল হাসান, নিক্সন চৌধুরী সবাই বেকসুর প্রমাণিত হয়েছেন। বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ ছিল অবান্তর। হ্যাঁ, মনে মনে কোনো চিন্তা করলে আল্লাহ তার বিচার করতে পারেন। কিন্তু ভালো-মন্দ চিন্তার প্রকাশ ঘটার আগে তার ফল নিরূপণ করা যায় না, বিচার করা যায় না। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাপারে সেটাই করা হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর দৃঢ়তায় নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিয়ে এক মহা প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছেন। তবে অনেকেই মনে করেন, পদ্মা সেতুর ব্যয় যুক্তিসংগত নয়। এক টাকার ঘোড়াকে ১০ টাকার দানা খাওয়ানো হলো কিনা, বিষয়টা বিবেচনা করা দরকার। পদ্মা সেতুর সফল স্প্যান স্থাপনের জন্য সেতুমন্ত্রী প্রিয় ওবায়দুল কাদেরকে ১০ তারিখ ৮টার পর ১০-১২ বার ফোন করেছিলাম। এমনটা কখনো হয়নি। সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে ফোন করলে ধরেননি এমন কোনো দিন হয়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনেক সময় বিদেশেও ফোন করেছি, সঙ্গে সঙ্গে ধরেছেন অথবা একটু পরই ফিরতি ফোন করেছেন। সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত ১০-২০ বছর ফোনে তাকে পাইনি এমন হয়নি। কিন্তু ১০ তারিখ অনেক চেষ্টা করেও না পেয়ে তার পিএ মতিনকে ফোন করেছিলাম। সে বলেছিল, মন্ত্রী মহোদয়কে খবর দিচ্ছি। রাত ৯টার দিকে মতিন ফোন দিয়ে জানতে চেয়েছিল মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে কিনা। না, হয়নি। পদ্মা সেতু সফল বাস্তবায়নে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ায় হয়তো খুবই ব্যস্ত। সে জন্য তাকে পাইনি। তাই এ কদিন আর বিরক্ত করার চেষ্টা করিনি। দেশের প্রায় সব নেতান্ডনেত্রীই পরিচিত। সে জন্য ফোনে কাউকে পাই না তেমন নয়। তোফায়েল ভাই, আমির হোসেন আমু অন্য মানুষ, মোহাম্মদ নাসিম ছিলেন আলাদা একজন। জনাব আবদুল জলিলের কথা একেবারেই বলার মতো নয়। অমন মানুষ খুব একটা হয় না। এখনো যারা মন্ত্রী তাদের ফোন করলে পাই, কথা হয়। তাদের দরদি কথাবার্তায় অনেক সময় প্রভাবিত হই। আমার প্রিয় সহকর্মী কৃষিবিদ ড. আবদুর রাজ্জাককে যখনই ফোন করেছি তখনই পেয়েছি। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, তাকেও সহজে পাওয়া যায়। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী জনাব ফরহাদ হোসেনকেও। আমার মেয়ে কুঁড়ির ইংল্যান্ড থেকে ফেরার সময় বিমানমন্ত্রী শাহজাহান কামালের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তার কথাবার্তা শুনে ভীষণ অভিভূত হয়েছিলাম। তাই যখন যাকে প্রয়োজন, এমনকি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক গাজীপুরের মানুষ। তার স্ত্রী ছিলেন অসাধারণ মানুষ। তাকেও পেতে কোনো কষ্ট হয় না। তাই কেন যে সেদিন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে পদ্মা সেতুর ৪১তম স্প্যান সফল স্থাপনে অভিনন্দন ও সাধুবাদ জানাতে পারিনি সেটা আল্লাহই জানেন।

গত পর্বে একই খরচে যমুনা রেলসেতুর ওপর আরেকটা সড়কসেতু করা যায় কিনা ভেবে দেখতে বলেছিলাম। অনেক মানুষ আলোচনাটির সারবত্তা খুঁজে পেয়েছেন। অনেক প্রকৌশলী জানিয়েছেন প্রস্তাবটি খুবই প্রশংসনীয়। যাদের সেতু নিয়ে কারবার তাদের কেউ কেউ বলেছেন রেলসেতুর জন্য যে ফাউন্ডেশন তাতে সড়কসেতু যোগ করলে লোড বিয়ারিং কেমন হবে একটু দেখা দরকার। তবে প্রস্তাবটি যুক্তিযুক্ত। এক-দেড় শ কিলোমিটার বেগে রেল যাতায়াত করতে পারলে কম্পনসহনীয় ক্ষমতা অনেক বেশি হবে। ফাউন্ডেশনে হয়তো কিছুই করতে হবে না। দু-চার মিটার পাইল লেন্থ হয়তো বাড়াতে হতে পারে। না বাড়ালেও কোনো অসুবিধা হবে বলে মনে হয় না। ওপরে স্টিল স্ট্রাকচারের তেমন কোনো পরিবর্তন আনতে হবে না। স্টিল স্ট্রাকচারের লোড নেওয়ার ক্ষমতা পদ্মা সেতুর স্ট্রাকচারের চাইতে কোনো অংশেই কম হবে না। বরং ওপরে স্টিল স্ট্রাকচার খালি পড়ে থাকার চাইতে রোডস্ স্ল্যাব বসলে স্ট্রাকচারটি আরও মজবুত হবে। এ ক্ষেত্রে খরচ যা হওয়ার রোডস্ স্ল্যাবের জন্য হবে। তাই ব্যাপারটি কর্তৃপক্ষকে গভীরভাবে ভেবে দেখতে বলছি। আমরা বড় বড় কাজ করতে গিয়ে হেলাফেলা করে বহু অর্থ নষ্ট করে ফেলি। রাষ্ট্রীয় অর্থ নষ্ট করা কোনো কাজের কথা নয়। তাই আবারও বিষয়টি ভেবে দেখতে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি।

লেখক : রাজনীতিক।

www.ksjleague.com

সর্বশেষ খবর